সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা সংকট কোন দিকে মোড় নিচ্ছে

মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

রোহিঙ্গা সংকট কোন দিকে মোড় নিচ্ছে

২২ আগস্ট নির্ধারিত দ্বিতীয় দফার প্রত্যাবাসনের কর্মসূচি সফল হয়নি। ২৫ আগস্টে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা বিশাল এক সমাবেশের মাধ্যমে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে পূর্বশর্ত হিসেবে পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করেছে। সরকারের কোনো কোনো জায়গা থেকে বলা হচ্ছে, মোনাজাত করার অনুমতি নিয়ে তারা বিশাল সমাবেশ ঘটিয়েছে এবং উত্তেজনাকর বক্তব্যসহ তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরেছে। মোনাজাতের অজুহাতে বিশাল সমাবেশকে ইনোসেন্ট বা সরল চোখে দেখার সুযোগ নেই। ঘটনার পরম্পরা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এটা ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত শো-ডাউন। অনেকে বলার চেষ্টা করেছেন শো-ডাউন হলেও সেটা হয়েছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এবং বিশ্ব স¤প্রদায়কে কঠিন বার্তা দেওয়ার জন্য এটা নিয়ে বাংলাদেশের ভাবার কিছু নেই। আসলেই কি তাই। কৌতুক করে বলা হয়ে থাকে আজরাইলকে নিজের বাড়ির রাস্তা চিনাতে নেই। যদি ধরে নিই এই শো-ডাউন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। তাহলে কি মিয়ানমারের অবস্থানের সামান্য কোনো পরিবর্তন হবে নাকি অনাস্থা অবিশ্বাসের দিগন্ত আরও প্রসারিত হবে। কেউ কেউ বলছেন, অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টির জন্যই এটা করা হয়েছে। আমরা জানি ঊহফ লঁংঃভু ঃযব সবধহং, অর্থাৎ লক্ষ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন কাজ করা হলে লক্ষ্য অর্জনের পথ আরও জটিল হয়ে যায়। তাই প্রশ্ন উঠেছে, আলোচ্য মহাসমাবেশের দ্বারা কতটুকু চাপ সৃষ্টি হবে। ১৯৬২ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ৫৭ বছর, মিয়ানমারের ইতিহাস বলে দেয় চীন যত সময় তাদের পিছনে কংক্রিট দেওয়ালের মতো দাঁড়িয়ে আছে ততদিন অন্য কিছু কর্ণপাত না করলেও চলবে। উপরন্তু মিয়ানমারের ক্ষমতায় সেনাবাহিনী, যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ক্ষমতায় থাকা, জনগণের নিরাপত্তা, উন্নতি বা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব অটুট রাখা নয়। রাখাইন রাজ্যে এখন শুধু রোহিঙ্গাদের নিয়ে সমস্যা নয়। সেখানকার জাতিগত রাখাইন স¤প্রদায়, যারা ধর্মীয়ভাবে বৌদ্ধ, তারাও মিয়ানমারের মিলিটারি কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। আরাকান আর্মি নামের সশস্ত্র সংগঠনের আক্রমণে প্রায়শই মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীতে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। তারপর শান, কারেন্ট ও কাচিন অধ্যুষিত অঞ্চলে সেই ১৯৪৮ সাল থেকে গৃহযুদ্ধ চলছে। মাঝে মাঝে নিস্তেজ হলেও এর কোনো স্থায়ী শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়নি। মিয়ানমার সেনাবাহিনী চায় না বলেই এসব সশস্ত্র বিদ্রোহের কোনো সমাধান হয় না। বহুল প্রচলিত অভিমত হলো, সেনাশাসিত দেশে ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে সেনাবাহিনী দেশের অভ্যন্তরে অথবা প্রতিবেশীর সঙ্গে একটা যুদ্ধাবস্থা বজায় রাখতে চায়। মিয়ানমারের বেলায়ও এ কথাটি সত্য। কৌশলে জাতিগতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ বার্মিজদের সেনাবাহিনী বোঝাতে সক্ষম হয়েছে, বার্মিজ জাতি ও সেনাবাহিনী ঐক্যবদ্ধ হয়ে অন্যান্য ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না রাখতে পারলে মিয়ানমারের ভ‚খÐগত নিরাপত্তা রক্ষা করা যাবে না। সুতরাং সেনাবাহিনী এবং বার্মিজ স¤প্রদায়ের সঙ্গে একটা আনহোলি বা অশুভ আঁতাত গড়ে উঠেছে। যার ফলে বার্মিজ বৌদ্ধরা ধর্মান্ধ উগ্রবাদী হয়ে উঠেছে, যেমনটি দেখা যায় পাকিস্তানে মোল্লা আর মিলিটারির আঁতাত। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়কে সতর্ক করার জন্য শো-ডাউনের মাধ্যমে আদৌ কি অতিরিক্ত কিছু অর্জিত হবে। আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় তো শুরু থেকেই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তার ব্যাপারে সব রকম ও সব পন্থায় সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে শো-ডাউনের কী অর্থ হতে পারে। সুতরাং শো-ডাউনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে বাহ্যিকভাবে যা শোনা যাচ্ছে আসলেই কি তাই, নাকি এর পিছনে সূ² কোনো চাল ছেড়েছে অন্য কোনো পক্ষ। এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা দরকার। যে গোষ্ঠী ও পক্ষ এই শো-ডাউনে সার্বিক সহায়তা দিয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে তারা নাকি সেই গোষ্ঠী যারা রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরে বাধা দিয়েছে এবং বহু রকম প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে যাতে প্রত্যাবাসনের জন্য সহজ পথ বের না হয়। শুধু তাই নয়, দিন দিন যে বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে তাহলো, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো এই অঞ্চলে নিজ নিজ ভ‚-রাজনৈতিক স্বার্থের প্রাধান্যতা বজায় রাখার জন্য অনেক রকম ছদ্মবেশী গুঁটি চালছে, যেটি আমরা বুঝতে পারছি কি পারছি না তা স্পষ্ট নয়। ২৫ আগস্টে আলোচ্য সমাবেশটি নিয়ে বাংলাদেশের একটি প্রধান দৈনিক বিস্তারিত প্রতিবেদন ছেপেছে। এই লাখো রোহিঙ্গার সমাবেশ ঘটাতে পাকিস্তান ভিত্তিক সংস্থা আল খিদমত ফাউন্ডেশন অর্থের জোগান দিয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। এর থেকে শঙ্কার বার্তা আর কী হতে পারে। এই রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের দুরভিসন্ধির কথা কে না জানে। এই সমাবেশের প্রধান নেতা ও বক্তা ছিলেন মুহিবুল্লাহ নামের একজন রোহিঙ্গা। কে এই মুহিবুল্লাহ তা নিয়েও পত্রিকায় লম্বা প্রতিবেদন বেরিয়েছে। ১৯৯২ সালে সে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে চলে আসে। রোহিঙ্গাদের ভিতর থেকে তৈরি হওয়া জঙ্গি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে মুহিবুল্লাহর বিরুদ্ধে। এই মুহিবুল্লাহ কিছুদিন আগে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। সুতরাং এই মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভিতর লাখো লোকের সমাবেশের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য আরও একটি অতিরিক্ত ফ্রন্ট খুলে গেল। সমস্যা সমাধানের পথে আরও কিছু অতিরিক্ত বাধার সৃষ্টি হলো। দ্বিতীয় দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগটি যেভাবে এবং যেসব কারণে বিফলে গেল তা নিয়ে সত্যিই উদ্বেগের কারণ আছে। প্রায় সাড়ে তিন হাজারের তালিকাটি যখন করা হয় তখন তালিকাভুক্তদের পক্ষ থেকে বলা হয়নি তারা ফেরত যাবে না। সেরকম হলে তো তালিকাই করা যেত না। তালিকাটি করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার লোকজন। ঘটনার বৃত্তান্তে বোঝা যায় বিষয়টি প্রথম দিকে গোপন রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও প্রত্যাবাসনের তারিখ ও তালিকা সম্পর্কে আগেভাগে কিছু বলা হয়নি। বোঝা যায় গোপন রাখার সঙ্গত কারণ তারা অনুমান করতে পেরেছিলেন। খবরটি প্রথমে বের হয় প্রত্যাবাসনের জন্য নির্ধারিত ২২ আগস্টের তিন-চার দিন আগে। রয়টার সংবাদ মাধ্যমে তারা প্রকাশ করে এবং তারা সূত্র হিসেবে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম উল্লেখ করে। এখানে মিয়ানমারের চাতুর্য রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই সংবাদটি আগাম প্রকাশ করে দিয়েছে। এই সংবাদ প্রকাশের পরপরই রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। পত্রিকার খবরে জানা যায়, কিছু এনজিও, দেশি-বিদেশি ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী, ক্যাম্পগুলোকে ঘিরে ড্রাগ ও মানব পাচারকারী এবং অস্ত্র চোরাচালানি সিন্ডিকেট উঠে পড়ে লেগে যায় যাতে কোনো রোহিঙ্গা ফেরত না যায়। শোনা যায় তালিকাভুক্ত পরিবারগুলোকে রাতের বেলায় অস্ত্রের মাধ্যমে ভয়ভীতি দেখানো হয়, প্রত্যাবাসনে রাজি হলে তাদের রক্ষা নেই। সুতরাং দেখা যাচ্ছে প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে যতগুলো বাধা শুরু থেকে আছে, তার সঙ্গে দিনে দিনে নতুন নতুন বাধা তৈরি হচ্ছে, বলা যায়, উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা হচ্ছে। প্রথমত, মিয়ানমারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা আগেও ছিল না, এখনো নেই। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় কর্তৃক মিয়ানমারের ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টির পথে প্রবল অন্তরায় হয়ে আছে চীনের অবস্থান। তৃতীয়ত, সা¤প্রতিক ঘটনায় তো প্রমাণই হলো ক্যাম্পগুলো ঘিরে হীনস্বার্থের বিসারিতে বহু পক্ষ প্রত্যাবাসনের পথে এখন প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা এখন রোহিঙ্গাদেরই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করবে এই সমস্যাকে জিইয়ে রাখার জন্য। চতুর্থত, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিবর্গ রোহিঙ্গা সংকটকে পুঁজি করে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ, উভয়ের কাছ থেকে নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করবে সেটাই স্বাভাবিক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের এক নম্বর বা একমাত্র পরাশক্তি। মুখে তারা অনেক কথাই বলছে। কিন্তু ইরান ও ভেনেজুয়েলার বেলায় যত শক্ত অবস্থান, তার কিছুই দেখা যাচ্ছে না মিয়ানমারের বেলায়। মিয়ানমারের শাসক গোষ্ঠী নিজ দেশের জনগণের ওপর যে রকম সীমাহীন হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ করেছে তার একাংশও তো ইরান ও ভেনেজুয়েলার শাসকরা করেনি। তাহলে মিয়ানমারের ওপর সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞা কেন আসছে না। এ প্রশ্নের উত্তর কারও কাছে নেই। মাত্র কয়েকজন জেনারেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেই আমেরিকা ক্ষান্ত। গত বছর জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইল্ডিং মিশনের প্রতিবেদনে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকা সত্তে¡ও এ সম্পর্কে চীন-ভারতের প্রতিক্রিয়া মানুষের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। এই রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। বৃহৎ শক্তিবর্গের ভ‚-রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে বিশ্বের সর্বত্রই মানবতা ও সভ্যতা আজ পরাজিত এবং ভ‚লুণ্ঠিত। একটি স্বল্পোন্নত দেশ হয়ে বাংলাদেশের মানবতায় সবাই মুগ্ধ হলেও রোহিঙ্গা শরণার্থী চাপ থেকে মুক্ত করার বেলায় সবাই নিজ নিজ ভ‚-রাজনৈতিক স্বার্থের জায়গায় অটুট থাকছে। এই সমস্যায় বাংলাদেশ তো কোনো পক্ষ নয়। দেশের ভিতর ও বাইরে থেকে অনেক গোষ্ঠীর শত উসকানি সত্তে¡ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অপার দূরদৃষ্টির কৃপায় বাংলাদেশ আরও বড় সংকট থেকে রক্ষা পেয়েছে। বাংলাদেশ কোনো পক্ষ নয় এবং মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা, এই পক্ষের কারও পক্ষে বা বিপক্ষে বাংলাদেশ নয়, এই অবস্থানটি ধরে রাখা জরুরি। অবস্থাদৃষ্টে আমার কাছে মনে হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান দিনে দিনে আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মহাসমাবেশ বা শো-ডাউন তারই একটি আলামত। বার্মিজ সম্প্রদায়ের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘদিনের সংঘাত, সংঘর্ষ ও রক্তক্ষরণের যে ইতিহাস রয়েছে তার পথ ধরে দুই পক্ষের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। গত দুই বছরে উদ্বাস্তু রোহিঙ্গা ও আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের আস্থা অর্জনের জন্য মিয়ানমার কিছুই করেনি। অন্যদিকে রোহিঙ্গারাও শক্তি প্রদর্শন করতে শুরু করেছে। তাই রোহিঙ্গা সংকট আগামীতে কোন দিকে ধাবিত হবে তা নিয়ে শান্তিকামী মানুষের শঙ্কা বাড়ছেই, কমছে না।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর