লিখেছিলাম, ‘অফিস-আদালতে বঙ্গবন্ধুর ছবি’। লেখাটি নিয়ে দারুণ আলোচনা হয়েছে। আমরা যেখানে বিশ্বাসযোগ্য সত্যের পেছনে জান কোরবান করেছিলাম সেখানে ধীরে ধীরে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছি যেখানে সত্য-মিথ্যা, আসল-নকল পরখ করার কেউ নেই। ক্ষমতাবান শক্তিশালীরা যখন যা বলে, যা করে তাই যেন চিরসত্য, তাই যেন অলঙ্ঘনীয়। দেশের প্রতি ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের আগ্রহ একেবারে তলানিতে ঠেকেছে। দেশের সাধারণ মানুষের এই বোধ যখন হারিয়ে যায় তখন যা কিছুই হোক তেমন কোনো কাজ হয় না- আমাদের দেশে তেমনটাই হয়েছে। একদিকে সরকার, সরকারি দল সে যে কি মহা উন্নয়নের ঢেঁকুর তুলছে যা বলার মতো নয়। অন্যদিকে সমালোচকরা কোনো কিছুতেই ভালো দেখছেন না। এটা খুবই সত্য, ভালোর চেয়ে খারাপ বেশি। দুর্বার পাল্লা দিয়ে ধাবমান খারাপের সামনে ভালো খুব একটা চোখে পড়ার মতো নয়। সড়ক দুর্ঘটনা লাগামহীন, ডেঙ্গু নিয়ে যে তেলেসমাতি- এসব আমাদের কল্পনার বাইরে। আইনশৃঙ্খলা আল্লাহর হাতে, আল্লাহ যেভাবে চালাচ্ছেন আমরা সেভাবে চলছি। সামাজিক বন্ধন ধীরে ধীরে এত নিম্নপর্যায়ে নেমে গেছে যেটা ভাবার মতো নয়। ৪০-৫০ বছর আগে কারও বাচ্চা হারালে যার বাচ্চা হারাত তার চেয়ে বেশি চিন্তায় পড়ত কোনো বাচ্চা কেউ পেলে। কীভাবে বাচ্চাকে বাবা-মার কাছে পৌঁছানো যাবে এটাই হতো প্রাপকের চিন্তা। যতক্ষণ যার সন্তান তার কাছে পৌঁছাতে না পারত ততক্ষণ প্রাপক স্বস্তি পেত না, শান্তি পেত না। আর এখন শিশু অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে মুক্তিপণ পেয়েও শিশুর জীবননাশ করা হয়। কি দুর্ভাগ্য! কোথায় আমাদের মানবিক মূল্যবোধ? প্রতিটি প্রাণী মায়ের পেট থেকে জন্মায়। নারী সব মানবের মা। মাতাহীন, পিতাহীন এ পৃথিবীতে আসার কোনো বিকল্প নেই। যত বড় দুর্ধর্ষ ক্ষমতাধর পুরুষ হোন না কেন তার জন্ম মায়ের পেটে। আর সব মা-ই নারী। সব নারীই পুরুষের সম্মানের পাত্র। কিন্তু সেই পুরুষরাই নারীকে সবচেয়ে বেশি অপমান-অপদস্থ করে, নির্যাতন-ধর্ষণ-অসম্মান করে। নারীর প্রতি জুলুমে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে। কিন্তু নিষ্ঠুর নির্মম পুরুষের হৃদয় টলে না- এক বলিহারি অবস্থা।
আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম তারা স্বপ্নেও এমন অধঃপতন ভাবিনি। আমরা আমাদের অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মানবিক উন্নতির আশা করেছিলাম। কিন্তু কেন যেন সেই দিকটিতে আমরা বড় বেশি পিছিয়ে পড়েছি। বলা যায় বর্তমান নারীর ক্ষমতায়নের স্বর্ণযুগ। কিন্তু রাস্তাঘাটে, অফিস-আদালতে, গ্রামেগঞ্জে এখনকার মতো আর কখনো নারীরা এত অবহেলিত ছিল না। কি সুন্দর পোশাক পরে মেয়েরা স্কুলে যায়। কত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। আগে ম্যাট্রিক পাস করলে প্রথম বিভাগ পেলে তাকে দেখতে আসত। দশ গ্রাম খুঁজলে একজন এমএ পাওয়া যেত না। আর এখন ঘরে ঘরে এমএ। আমাদের বাড়িতেই তো পাঁচটা না ছয়টা এমএ- একমাত্র আমি ছাড়া। যখন ছোট ছিলাম ম্যাট্রিক পাস কারও সঙ্গে কথা হলে কী যে তৃপ্তিবোধ করতাম আর এখন ভূরি ভূরি এমএ, ডক্টরেটদের সঙ্গে কথা বললে কোনো স্বস্তি পাওয়া যায় না। অনেকে এমএ পাস করে সিক্স-সেভেনের জ্ঞান অর্জন করতে পারেনি। ডিগ্রি অনেক কিন্তু জ্ঞান একেবারে শূন্যের কোঠায়। না বৈষয়িক, না মানবিক- কোনো জ্ঞান নেই। কারও কাছে কোনো কিছু পাওয়া যায় না। পাকিস্তান ছিল আমাদের চোখের কাঁটা। সব সময় খচখচ করত। কিন্তু পাকিস্তানি অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে অনেক ক্ষেত্রেই ভালো লাগত। এখন কথা বলে সেই তৃপ্তি নেই। শুধু অস্বস্তি আর অস্বস্তি। দু-চারজন যে যোগ্য নেই তা নয়, কিন্তু যোগ্যরা অনেক পেছনে। কারণ যোগ্যতা-দক্ষতার এখন আর কোনো দাম নেই। চাটুকারদের স্থান এখন সবার ওপরে। চাটুকার যে আগে ছিল না তা নয়, চাটুকার আগেও ছিল। কিন্তু চাটুকারদের অত প্রাধান্য ছিল না, এত ক্ষমতা ছিল না। এখন চাটুকারদেরই জয়জয়কার। এই অচলায়তন ভাঙতে না পারলে দেশের পরিণতি খুবই খারাপ। এসব নিয়ে যখন ভাবী তখন খুব একটা স্বস্তি পাই না, বড় খারাপ লাগে। আইয়ুবের পতনের আগে আগে উন্নয়নের দশক পালন করা হয়েছিল। তখন আমাদের মাথাপিছু ৪০০-৫০০ টাকা বৈদেশিক ঋণ ছিল। এখন সেই ঋণ লাখ টাকায় পৌঁছে গেছে। গত ১০-১৫ বছর ১০০ টাকার কাজ ১২০০-১৫০০ টাকায় করা হচ্ছে। যার একটা অংশ লগ্নিকারীরা বরাদ্দের সময় পার্সেন্টেজ হিসাবে নিচ্ছে, ক্ষমতাবানদের একটা অংশ, দেখাশোনাকারীদের একটা অংশ, ভাগ-বাটোয়ারা করে যারা কাজ করে তাদের একটা অংশ। প্রাক্কলিত হাজার কোটির এক-দেড় শ কোটি শেষ পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে পৌঁছে। বাকি সব খায় ইন্দুর-বায়তানে। উন্নয়নের নামে আরও কিছুদিন এভাবে লুটপাট চললে একসময় আমরা বিদেশি ঋণে দেউলিয়া হয়ে যাব। আমাদের আর ঋণ শোধের ক্ষমতা থাকবে না। যেমন একসময় ব্যাংকের সুদ ১৬-১৭-১৮ শতাংশ থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে উঠেছিল। লুটেরা ছাড়া কারও হাতে কোনো অর্থ নেই। ব্যাংকের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে সব কটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে দেউলিয়া করার পথে। যত চেষ্টাই করি, হতাশাব্যঞ্জক একটা অবস্থার বাইরে যেতে পারছি না।
অধঃপতন আর কাকে বলে, যে ছাত্রলীগ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুর্বার গণআন্দোলন করে একপর্যায়ে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল সেই ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক দুর্নীতিগ্রস্ত, লোভী, বহিষ্কৃত। সাধারণ ছাত্রদের বা ছাত্রলীগের কাউন্সিলরদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হলে না হয় সান্ত্বনা ছিল, কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের নেতা নির্বাচনে ভুল হয়েছে- কিছুটা হলেও একটা সান্ত্বনা থাকত। কিন্তু তেমন হয়নি। এখন তো চাটুকারিতা ছাড়া, তেল ছাড়া কেউ নেতৃত্ব পায় না। ছাত্রলীগের কমিটি প্রধানমন্ত্রী দ্বারা মনোনীত বা নির্বাচিত। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচন এমন হলে আমরা যাব কোথায়? আমরা কোথায় বিচার পাব? আমাদের ভরসার স্থল কোথায়? চারদিকে অন্ধকার ছাড়া আর তো কিছু দেখা যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের টাকার ভাগ, অন্যান্য প্রজেক্টে কমিশন এসব তো শিক্ষার্থীদের হওয়ার কথা না। শিক্ষার্থীরা হবে পাহারাদার। দেশ ও জাতিকে ঝলমলে আলোর পথ দেখাবে, তারাই যদি এমন হয় পচা-দুর্গন্ধযুক্ত তাহলে আমরা সুবাতাস পাব কোথায়? মানুষের মনে প্রশ্ন, দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ এসবের কি কোনো অংশীদার নেই? নিশ্চয়ই কেউ না তো কেউ আছে। যার আশকারায় নেতারা অমনটা করতে সাহসী হয়েছে। আমরাও তো ছাত্র নেতৃত্ব করেছি। করটিয়া কলেজের ছাত্র থাকতে কলেজ উন্নয়নের ভাগ চাইবার কথা কল্পনায়ও আসেনি। কন্ট্রাক্টরি বা কোনো আর্থিক লাভ স্বপ্নেও ভাবিনি। আর আজকাল নাকি জেলা-উপজেলার নেতা হতে ২০ লাখ খরচ করে ৫০ লাখ উপার্জন করে- এটা কী করে সম্ভব এখনো আমাদের মাথায় আসে না। ছাত্রলীগের সভাপতি অতিসম্প্রতি সিলেট সফরে বিমানবন্দরের কাচের দরজা ভাঙার কথা শুনে বড়ই অবাক হয়েছি। যে যাই বলুক, ঘুষ-দুর্নীতি-সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে ছাত্রলীগ অনেক দক্ষ ও ক্ষমতাবান হলেও সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের কাছে খুব একটা জনপ্রিয় সংগঠন নয়। ২০০-৪০০ মোটরসাইকেল এবং পান্ডাদের নিয়ে বিমানবন্দরের কাচের দরজা ভাঙলে জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে না। জনপ্রিয়তা সম্পূর্ণই আলাদা জিনিস। অনেকে হয়তো ভুলেই গেছেন, ’৯০-এর ১৬ ডিসেম্বর নির্বাসন থেকে ঢাকা ফিরেছিলাম। ঢাকা বিমানবন্দরে এর আগে কোনো দিন অত মানুষ দেখেনি। সেদিন বিমানবন্দরে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। সে সময় গোয়েন্দা বাহিনীর কাছে নাকি খবর ছিল আমাকে ঢাকা বিমানবন্দরে গুলি করে হত্যা করা হবে। সাহাবুদ্দীন সরকার অনেকটা উদ্বিগ্ন ছিল। যেজন্য বিমানে ওঠা পর্যন্ত বাধা দিয়ে চলেছিলেন।। আমি রাজি না হওয়ায় বাধ্য হয়ে আনা হয়েছিল। লাখের ওপর মানুষ বিমানবন্দরের টারমার্কের ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল। আমি বিমান থেকে সিঁড়ির শেষ ধাপে নেমে চমকে গিয়েছিলাম, কী করে মায়ের বুকে পা রাখব। দেশের মাটি আর মা আমার কাছে সমান। স্ত্রী নাসরীন উতালা হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কী হয়েছে, তুমি এভাবে ফিরে এলে যে?’ বলেছিলাম, মায়ের বুকে পা রাখতে ইচ্ছা করছে না, সাহস পাচ্ছি না। আর আমার শরীরও কিছুটা কাঁপছিল। আবার নেমে এসে সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে তপ্ত বিমানবন্দরে গড়িয়ে পড়েছিলাম। বুকে হেঁটে ছিলাম বেশ কিছুটা। গড়াগড়ি গিয়েছিলাম। তখন বেলা ২টা। মানুষ ওখানে খালি পায়ে কংক্রিটের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। আমি অবলীলায় গড়াগড়ি গিয়েছিলাম। কোথাও একটা ফোসকাও পড়েনি। বেরিয়ে আসার সময় হাজার হাজার মানুষের ধাক্কাধাক্কিতে একটা কাচের দরজায় চির ধরেছিল। আমি ভীষণ মর্মাহত হয়েছিলাম। অত উত্তেজনার মাঝেও আমার বক্তৃতার একপর্যায়ে বলেছিলাম, ‘উচ্ছৃঙ্খল কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না, সমৃদ্ধি অর্জন করে না। আমাদের শৃঙ্খলার পরিচয় দিতে হবে।’ জানি না, ছাত্রলীগের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক কতটা জনপ্রিয় যে তার সমর্থকরা বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে বিমানবন্দরের দরজা-জানালা ভেঙে ফেলে। সময় তো আসতেও পারে, সরকার বদল হলে তখন তারা কী করবেন? কতটা বীরত্বের পরিচয় দেবেন বা কতটা শৃঙ্খলার- সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
লেখক : রাজনীতিক।
www.ksjleague.com