রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

নাগরিক যন্ত্রণা ও দুর্ভোগের শহর

মাহমুদুর রহমান সুমন

আমাদের প্রিয় শহর ঢাকা সম্প্রতি বিশ্বপরিসরে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। ভালো খবর হলে আনন্দ পাওয়া যেত। কিন্তু সে গুড়ে বালি। বসবাস-অযোগ্যতার দিক থেকে ২০১৮ সালে ঢাকার অবস্থান ছিল ২ নম্বরে। এবার এক ধাপ উন্নতি হয়েছে। বিশ্বের ১৪০টি শহরের এই তালিকাটি প্রকাশিত হয় ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯। তালিকাটি করেছে লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট। স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি, পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামো ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় রেখে এ তালিকা প্রস্তুত করা হয়। ঢাকা এখন অবস্থান করছে ১৩৮ নম্বরে। প্রায় ২ কোটি জনসংখ্যার প্রচন্ড চাপে শহরের অবস্থা ত্রাহি মধুসূদন। এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, দেশের গরিব মানুষের এক- তৃতীয়াংশ বাস করে ঢাকায়। সে তুলনায় অবকাঠামো বৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ-আয়োজন চোখে পড়ে না। আবর্জনার স্তূপে রাস্তাঘাট নোংরা, অপরিচ্ছন্ন। সড়কের বেহালদশা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কহতব্য নয়। যানজট আরও তীব্রতর হয়ে উঠছে বোধগম্য কারণে। জনচাপ বাড়ছে দিন দিন। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণের প্রচ-তাও ক্রমবর্ধমান। রাজধানী ঢাকা বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দূষিত বায়ুর শহরে পরিণত হয়েছে। ঢাকার রাস্তার ধুলায় সর্বোচ্চ মাত্রায় সিসা, ক্যাডমিয়াম, দস্তা, ক্রোমিয়াম, নিকেল, আর্সেনিক, ম্যাঙ্গানিজ ও কপারের উপস্থিতি আছে। দেশের বাতাসে দূষণ প্রতিদিনই বাড়ছে। অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ, তীব্র যানজট, মেয়াদোত্তীর্ণ মোটরযান ও শিল্পকারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত ভারী ধাতু ধুলার সঙ্গে যোগ হচ্ছে। এই দূষণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে মাত্রাতিরিক্ত ধুলা। নগরের বিভিন্ন স্থানে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ধুলা হয়ে উঠেছে নিত্যসঙ্গী। বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বায়ুদূষণে শিশুমৃত্যুর হারের দিক থেকে পাকিস্তানের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। বিশ্বে যেসব কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়, তার মধ্যে বায়ুদূষণ রয়েছে পঞ্চম স্থানে। শহরের প্রায় সব এলাকাতেই শব্দ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে ২ থেকে ৩ গুণ বেশি। ঢাকা যে বহুমাত্রিক সমস্যায় কণ্টকিত, জর্জরিত তা থেকে বের হয়ে আসার জন্য বাস্তবোচিত, সময়োপযোগী, আন্তরিক, সমন্বিত কোনো উদ্যোগ নেই। ঢাকার যানজট ক্রমেই দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। সড়ক দুর্ঘটনার হারও বেড়েছে আশঙ্কাজনকহারে। কেউ ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকলেও তার জীবনের নিরাপত্তা নেই। যে কোনো সময় যে কোনো যানের তলায় পড়ে পৈতৃক প্রাণটা বেঘোরে হারাতে হতে পারে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের হিসাবমতে, ঢাকা শহরে সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা যায় তার প্রায় সবাই পথচারী। ফুটপাথ দিয়ে পথচারীরা যে নিরাপদে নির্বিঘেœ হাঁটবেন, তার জো নেই। আর রাস্তার দুই ধার দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলেছে শত শত পথচারী। ফুটপাথ থেকেও নেই। প্রশাসনের কর্তাদের উৎকোচ দিয়ে অবৈধ দখলদারদের দখলে ঢাকার ফুটপাথ। যানজট দেশকে, দেশের অর্থনীতিকে পিছিয়ে দিচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে অগণন কর্মঘণ্টা। প্রতি বছর ২ থেকে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার জন্য দায়ী করা হয় এই ভয়াবহ যানজটকে। অধৈর্য মোটরসাইকেলওয়ালারা ফুটপাথ দিয়েই গন্তব্যে পৌঁছানোর কোশেশ করেন। ঢাকায় বসবাসের কড়া মাশুল গুনতে হচ্ছে সবাইকে। ভিআইপিদের তো কথাই নেই। সুতরাং তাদের পক্ষে আমজনতার কষ্ট-লানত বোঝা সম্ভবপর নয়। ‘কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে/কভু আশীবিষে দংশেনি যারে?...’

পুরান ঢাকায় বসবাসের অযোগ্য ভবন রয়েছে অনেক। সেখানে কেমিক্যাল কারখানা থেকে সৃষ্ট অগ্নিকা-ে ব্যাপক প্রাণহানি, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অগুনতি সমস্যার বেড়াজালে প্রতিনিয়ত নাকাল-পর্যুদস্ত হচ্ছেন নগরবাসী। বর্ষার সময় পানি-কাদা, সিন্দাবাদের বুড়োর মতো কাঁধে চেপে বসা জলাবদ্ধতা, শুকনোর সময় ধুলাবালির দৌরাত্ম্য, বছরভর মশার উপদ্রব তো আছেই, পলিথিনে পলিথিনে ড্রেন-স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার বারোটা বেজে গেছে। পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থার প্রত্যাশিত উন্নয়ন-আধুনিকায়ন দূরে থাক, কোনোমতে ঠেকা দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। একসময় বেশ কিছু খাল ছিল এই নগরীতে। সব গ্রাস করে ফেলেছে। ফলে দুঃসহ জলাবদ্ধতা এই নগরীতে স্থায়ী অভিশাপ হিসেবে আসন পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। ঢাকা কতখানি বাসযোগ্য শহর? ইকোনমিস্ট প্রকাশিত প্রতিবেদনের আলোকে বিবিসি নিউজ দক্ষিণ সিটি কর্তৃপক্ষের ভাষ্য নিয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ইকোনমিস্ট এ ধরনের কোনো জরিপের জন্য তাদের কাছ থেকে কোনো তথ্য নেয়নি। তিনি বলেন, ঢাকা যেহেতু বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর, সে হিসাবে আমরা সার্বিক সেবা প্রদান করে এটার বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট কাজ করছি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে আন্তর্জাতিক মানের ৩১টি খেলার মাঠ আছে এমন দাবি করে তিনি বলেন, ঢাকার সিটি গ্রিনারি, পার্ক, খেলার মাঠ, রাস্তা, স্ট্রিট লাইট এগুলোর ব্যাপারে অনেক কাজ চলছে।

সিটি করপোরেশন ও সরকার যৌথভাবে ঢাকাকে আরও বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিবিসি নিউজের কাছে তিনি স্বীকার করেন, মেট্রোরেলের মতো বড় আকারের প্রকল্পের কারণে নাগরিকদের কিছুটা দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তবে এ দুর্ভোগ সাময়িক। বস্তি ঢাকার উন্নয়নে বড় প্রতিবন্ধক। নিঃস্ব, নিরাশ্রয়, হতদরিদ্র মানুষের বস্তিবাস ছাড়া গত্যন্তরও নেই। বিপুলসংখ্যক বস্তিবাসীকে হিসাবের বাইরে রেখে, তাদের সংখ্যা চাহিদা না জেনে কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন নিতান্ত বেকুবি ও আহাম্মকি।

লেখক : কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর