শিরোনাম
রবিবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

হৃদরোগ : প্রতিরোধই সর্বোত্তম উপায়

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ

হৃদরোগ : প্রতিরোধই সর্বোত্তম উপায়

২৯ সেপ্টেম্বর সারা বিশ্বে পালিত হয় বিশ্ব হার্ট দিবস। প্রতিবারই একটি করে সুনির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য থাকে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়, ‘প্রতিজ্ঞার মাধ্যমে আমাদের বন্ধুবান্ধব, পরিবার-পরিজন, রোগী ও কর্মীদের কাছে আমরা হার্টের হিরো হতে পারি’- অর্থাৎ আমরা সবাই আমাদের হার্টের সুস্থতার জন্য যা করণীয়, সে কাজগুলো করার এবং ক্ষতিকর কাজগুলো বর্জনের প্রতিজ্ঞা করার মাধ্যমে সবার কাছে আমরা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারি। বর্তমানে সমগ্র বিশ্বে হৃদরোগ ও স্ট্রোক সবচেয়ে বড় ঘাতকব্যাধি হিসেবে আবির্ভূত। অসংক্রামক রোগের ১২.৫ ভাগ মৃত্যু হয় হৃদরোগে, যার মধ্যে শতকরা ৮২ ভাগ মৃত্যু হয় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের জনগণের। কারণ এর চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল। সাধারণ কিংবা মধ্যবিত্ত রোগীর পক্ষে এ ব্যয় বহন করা অনেক সময় সম্ভব হয়ে ওঠে না।

হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালির রোগসমূহ : মানবদেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হার্ট বা হৃৎপিন্ড। হৃদরোগের ঝুঁকির ব্যাপারটি নির্ভর করে একজন মানুষ কীভাবে জীবনযাপন করছে তার ওপর। অতিরিক্ত ধূমপান, শুয়ে-বসে সময় কাটানো, শরীর চর্চাহীন অলস জীবনযাপন ও চর্বিযুক্ত খাবার গ্রহণের কারণে চর্বি জমা হয়ে ধমনিগুলো সরু হতে থাকে। হৃৎপিন্ডের রক্তনালিতে রক্ত চলার পথ বা ধমনির ভিতর রক্ত প্রবেশের পথ আংশিক বা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে হৃৎপিন্ডকে অক্সিজেন দিতে ব্যর্থ হলেই ঘটতে পারে হার্ট অ্যাটাকের মতো জটিল রোগ।

হৃদরোগের রিস্ক ফ্যাক্টর বা ঝুঁকিসমূহ : বিভিন্ন কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যাকে বলা হয় রিস্ক ফ্যাক্টর বা ঝুঁকিগুলো কিছু কিছু সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য, আর কিছু অনিয়ন্ত্রণযোগ্য। অনিয়ন্ত্রণযোগ্য রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো হলো বয়স, লিঙ্গ ও বংশগত। নিয়ন্ত্রণযোগ্য রিস্ক ফ্যাক্টরের মধ্যে রয়েছে ধূমপান, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে কলেস্টেরলের আধিক্য, ডায়াবেটিস, মুটিয়ে যাওয়া, কায়িক পরিশ্রমের অভাব, চর্বিজাতীয় খাদ্য বেশি ও আঁশজাতীয় খাদ্য কম খাওয়া, মানসিক চাপ, মদপান, জন্মনিয়ন্ত্রক পিল খাওয়া ইত্যাদি।

কী করে বুঝবেন হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন কিনা? : * মাঝে মাঝে বুকে সামান্য ব্যথা বা চাপ চাপ ভাব অনুভব করেন। বিশেষ করে পরিশ্রম বা হাঁটাচলা, সিঁড়িতে ওঠানামা করলে এমনকি খাওয়ার সময়ও বুকের ব্যথা বা চাপ অনুভূত হয়, আবার বিশ্রাম নিলে কমে যায়। * হঠাৎ বুকের মাঝে খুব বেশি ব্যথা অনুভূত হওয়া, যা বাঁ-হাতের দিকে এমনকি গলা বা চোয়ালেও ছড়িয়ে যায়। হঠাৎ কাশি বা তীব্রতর শ্বাসকষ্ট, অস্বস্তিবোধ, দুর্বলতা বা ক্লান্তিবোধ হওয়া। * বুকের ব্যথার সঙ্গে বমি বমি ভাব এমনকি বমি হওয়া, শরীরে অতিরিক্ত ঘাম, হঠাৎ মাথা ঘোরানো এমনকি অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, বুক ধড়ফড় করা এবং হৃদক্রিয়ার ছন্দ বেড়ে যাওয়া। * কোনোরকম ব্যথা ছাড়াও হঠাৎ শ্বাসকষ্ট অনুভূত হওয়া এবং বিছানায় চিত হয়ে শুতে গেলে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যাওয়া। * ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে বুকে তীব্র ব্যথা অনুভূত নাও হতে পারে। তবে শরীর থেকে প্রচুর ঘাম ঝরা, মাথা ঘোরা ও ক্ষণিকের জন্য চেতনাহীন হয়ে পড়াটাই এই রোগীদের হার্ট অ্যাটাকের পূর্বলক্ষণ। * হঠাৎ করে পেটে ব্যথা বা গ্যাস হওয়া, বমি, বদহজম-জাতীয় লক্ষণ হতে পারে, যাকে অনেকেই সাধারণ গ্যাস্ট্রিক মনে করে অবহেলা করেন।

কী করবেন, যদি মনে হয় হার্ট অ্যাটাক হয়েছে : * ওপরের যে কোনো লক্ষণ অনুভূত হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত, বিশেষ করে যারা আগে থেকেই কোনো না কোনো হৃদরোগে ভুগছেন। এমনকি উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রক্তে অতিমাত্রায় কলেস্টেরল রোগীদের বেলায়ও এসব লক্ষণ অনুভূত হলে অবহেলা করা উচিত নয়। জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

কীভাবে হৃদরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব : হৃদরোগের চিকিৎসা প্রায়ই ব্যয়বহুল। একবার আক্রান্ত হলে সারা জীবন এই মারাত্মক ব্যাধি পুষতে হয় এবং অনেক ওষুধ খেতে হয়। তাই এই রোগ প্রতিরোধ করাই উত্তম। নিরাময়যোগ্য রিস্ক ফ্যাক্টরগুলো প্রতিরোধে যথাযথ ব্যবস্থা নিলেই অনেক ক্ষেত্রে হৃদরোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

ধূমপানকে না বলুন : ধূমপান অবশ্যই বর্জনীয়। এমনকি ধূমপায়ীর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকুন। তামাকপাতা, জর্দা, গুল লাগানো ইত্যাদিও পরিহার করতে হবে।

মোটা মানুষের ওজন কমাতে হবে : খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। একবার লক্ষ্য অনুযায়ী ওজনে পৌঁছালে সীমিত আহার করা উচিত এবং ব্যায়াম অব্যাহত রাখতে হবে। ওষুধ খেয়ে ওজন কমানো বিপজ্জনক। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওজন কমানোর ওষুধ না খাওয়াই ভালো।

পরিমিত খাদ্য গ্রহণ : কম চর্বি ও কম কলেস্টেরলযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে। যেমন খাশি বা গরুর গোশত, কলিজা, মগজ, গিলা, গুর্দা, ডিম কম খেতে হবে। কম তেলে রান্না করা খাবার এবং ননি তোলা দুধ, অসম্পৃক্ত চর্বি যেমন সয়াবিন, ক্যানোলা, ভুট্টার তেল অথবা সূর্যমুখীর তেল খাওয়া যাবে। বেশি আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করা ভালো। আটার রুটি ও সুজিজাতীয় খাবার পরিমাণমতো খাওয়া ভালো।

লবণ কম খাবেন : তরকারিতে প্রয়োজনীয় লবণের বাইরে অতিরিক্ত লবণ পরিহার করতে হবে।

মদপান : অতিরিক্ত মদপান পরিহার করতে হবে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ : যাদের ডায়াবেটিস আছে, তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে : নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে রক্তচাপ পরীক্ষা করানো উচিত। যত আগে উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়ে, তত আগে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং জটিল রোগ বা প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। মনে রাখতে হবে, উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ সবসময় নিয়মিত খেতে হবে। এমনকি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এলেও ওষুধ বন্ধ করা যাবে না।

 

লেখক : ইউজিসি অধ্যাপক

মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

সর্বশেষ খবর