আমাদের সমাজে ইসলামী দিবসের শিরোনামে ‘আখেরি চাহার শোম্বা’ নামে একটি দিবস পালিত হয়ে আসছে। কিছু ব্যক্তি অজ্ঞতাবশত এ দিবসকে ইসলামী দিবস মনে করে একে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আমলও করেন।
এ দিবস ও দিবসসংক্রান্ত আমলগুলো ‘মুকসুদুল মুমিনীন’ কিংবা এ-জাতীয় কিছু বই-পুস্তকে পাওয়া যায়। অথচ এ গ্রন্থগুলো নির্ভরযোগ্যতার মানদন্ডে উত্তীর্ণ তো নয়ই; বরং এগুলো মানুষের ধর্মীয় আবেগকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ব্যবসার পণ্য মাত্র!
পরিতাপের বিষয় হলো, এসব অনির্ভরযোগ্য গ্রন্থ এবং অজ্ঞ ও মূর্খ লোকদের প্রচলনকে ভিত্তি করে আমাদের দেশের অনেক জাতীয় দৈনিকেও এ দিবসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন লেখা ছাপা হয় এবং মানুষকে এ দিবসের পবিত্রতা সম্পর্কে জানানো হয়। অথচ শরিয়াতের মানদন্ডে এ দিবসের যেমন কোনো ভিত্তি নেই, তেমন এ দিবসের আমলেরও কোনো ভিত্তি নেই।‘আখেরি চাহার শোম্বা’ কী?
‘আখেরি চাহার শোম্বা’ অর্থ হলো ‘শেষ বুধবার’। উদ্দেশ্য হলো হিজরি বছরের দ্বিতীয় মাস তথা ‘সফর মাসের শেষ বুধবার’।
অনির্ভরযোগ্য বিভিন্ন কিতাবের বর্ণনা ও দিবস পালনকারীদের প্রচলিত আকিদামতে এ দিবস পালনের প্রেক্ষাপট হলো- ‘নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক ইহুদি জাদু করেছিল। ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এজন্য নবীজি মসজিদে যেতে পারেননি। সফর মাসের শেষ বুধবার নবীজি গোসল করেন এবং সুস্থ হয়ে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করেন। এ গোসলই তাঁর জীবনের শেষ গোসল। নবীজির সুস্থতার পরিপ্রেক্ষিতে সাহাবায়ে কিরাম খুশি হয়ে এ দিন রোজা রেখেছিলেন এবং নফল নামাজ আদায় করেছিলেন। কাজেই উম্মতের জন্যও এ দিন গোসল করে রোজা রেখে নফল নামাজ পড়ে আনন্দ প্রকাশ করা আবশ্যক!!’
এ আকিদা ও বিশ্বাস ধারণ করে আমাদের সমাজের কিছু ব্যক্তি অজ্ঞতাবশত হিজরি সফর মাসের শেষ বুধবারকে ইসলামী দিবস হিসেবে পালন করেন। এমনকি এ দিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়!
শরিয়াতের দৃষ্টিতে ‘আখেরি চাহার শোম্বা’
শরিয়াতের দৃষ্টিতে এ দিবস, দিবস পালনের প্রেক্ষাপট এবং এ দিবসে বর্ণিত কোনো আমলই নির্ভরযোগ্য দলিলের ভিত্তিতে প্রমাণিত নয়। বরং তা একটি গর্হিত বিদাত ও অবশ্য পরিত্যজ্য বিষয়।
এ দিবসের অনির্ভরযোগ্যতার কারণগুলো নিম্নরূপ-
১. রসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক ইহুদি জাদু করেছিল, এ কথা ঠিক। তবে গোসলের মাধ্যমে সুস্থতার তারিখ হিসেবে সফর মাসের শেষ বুধবার কথাটি সঠিক নয়। বরং দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। হাফেজ ইবনে হাজার (রহ.) ও হাফেজ ইবনে কাসির (রহ.) এ দিনটি বৃহস্পতিবার ছিল বলেই উল্লেখ করেছেন। (ফাতহুল বারি, কিতাবুল মাগাজি, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)।
২. দ্বিতীয়ত, এ গোসলের পর নবীজি আর গোসল করেননি- এ কথাও ঠিক নয়। কেননা, সহি হাদিসসমূহে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, নবীজি এরপর এশার নামাজের আগে এক রাতে গোসল করেছিলেন। (মুসলিম, বুখারি)।
৩. তৃতীয়ত, সাহাবায়ে কিরাম খুশি হয়ে এ দিন রোজা রেখেছিলেন এবং নফল নামাজ আদায় করেছিলেন- এ কথাও সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন! এ-জাতীয় কোনো বর্ণনা হাদিসের কোনো কিতাবেই উল্লেখ নেই।
৪. চতুর্থত, কোনো বিশেষ দিনকে ধর্মীয় দিবস মনে করা এবং তাতে বিভিন্ন ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য শরিয়াতের সুনির্দিষ্ট দলিল-প্রমাণ আবশ্যক। অথচ কোরআনে কারিম কিংবা হাদিসে এ দিবসের উল্লেখ দূরের কথা, সাহাবায়ে কিরাম, তাবেইন, তাবে-তাবেইনের যুগ তথা সর্বশ্রেষ্ঠ তিন যুগেও এ দিবস পালনের কোনো রেওয়াজ পাওয়া যায় না।
৫. দাওয়াতুনবীর দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে গিয়ে নবীজি কাফিরদের পক্ষ থেকে অনেক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছেন। আল্লাহ তাঁকে সেসব কষ্ট থেকে নাজাতও দিয়েছেন। এ ছাড়া মহান আল্লাহ তাঁকে অনেক নিয়ামতও দান করেছেন।
নবীজির এ কষ্ট থেকে মুক্তিপ্রাপ্তি কিংবা কোনো নিয়ামত লাভ করা নিঃসন্দেহে উম্মতের জন্য আনন্দ ও খুশির বিষয়। কিন্তু এ খুশির দিনকে ইসলামী দিবস হিসেবে পালন করা হয়েছে- মর্মে সাহাবায়ে কিরামের জীবনীতে এর কোনো উল্লেখ নেই!
সার কথা, ‘আখেরি চাহার শোম্বা’ দিবসের প্রেক্ষাপট হিসেবে বর্ণিত কারণগুলো যেমন ভিত্তিহীন, তেমনি এ দিবসকে ইসলামী দিবস মনে করাও প্রমাণবিহীন! কাজেই বিশেষ কোনো আমলকে এ দিবসের আমল করারও কোনো সুযোগ নেই।
সাহাবায়ে কিরাম, তাবেইন ও তাবে-তাবেইনরা ‘রসুল আনুগত্যের’ যে পথনির্দেশ রেখে গিয়েছেন উম্মতের হিদায়াত ও জান্নাতপ্রাপ্তির জন্য তা-ই যথেষ্ট। এ-জাতীয় মনগড়া দিবসের বিদাতে লিপ্ত হওয়া এবং তাতে নির্ধারিত ইবাদত-বন্দেগিকে দিবসকেন্দ্রিক মনে করা মারাত্মক গুনাহর কাজ। কাজেই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এই ভিত্তিহীন দিবসের যৌক্তিকতা বয়ান করা যেমন ঠিক নয়, তেমন এ দিবসকে কেন্দ্র করে সরকারি ছুটি পালনের কোনো যৌক্তিকতা নেই।
আল্লাহ আমাদের এ গর্হিত বিদাত থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন।
লেখক : প্রধান মুফতি ও শায়খুল হাদিস
জামি‘আ রাহমানিয়া আরাবিয়া
আলী অ্যান্ড নূর রিয়েল এস্টেট, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।