পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ও সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠান হলো পরিবার। আদম-হাওয়ার প্রেমময় পরিবার থেকেই আজকের এই বিকশিত ৭৫০ কোটি মানুষের উন্নত ও আধুনিক পৃথিবী এতটা পথ পেরিয়ে এসেছে। আরও কত বছর পৃথিবী টিকে থাকবে তা আমাদের জানা নেই। তবে পরিবারের প্রয়োজনীয়তা ও মানুষের কাছে পরিবারের আবেদন পৃথিবীর শেষাবধি সেই শুরুর মতোই থাকবে- এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তাই আল্লাহ-প্রদত্ত প্রতিটি ধর্মব্যবস্থায় পরিবারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অনেক অনেক বেশি। আজকের পৃথিবীতে এমন কোনো ধর্মের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে পরিবারের কথা গুরুত্বের সঙ্গে বলা নেই। পরিবারের কথা বলা হয়নি এমন ধর্ম অতীতের কোনো কালে থাকার ন্যূনতম যৌক্তিকতাও নেই।
দার্শনিক গুরু অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘মানুষ পশু-পাখির মতো সাধারণ কোনো প্রাণী নয়। শুধু বংশ বিস্তারই মানুষের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। মানুষ সৃষ্টির পেছনে স্রষ্টার অনেক বড় উদ্দেশ্য রয়েছে। আর এ উদ্দেশ্য সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য পরিবারের বিকল্প নেই।’ আল কোরআন থেকে আমরা জানতে পারি, মানুষ সৃষ্টির পেছনে আল্লাহতায়ালার উদ্দেশ্য হলো- পরীক্ষা করে দেখা যে, সৎকর্মে কে সবচেয়ে ভালো। সত্য-সুন্দর আর সৎকর্মের পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য পরিবারের বিকল্প নেই। অ্যারিস্টটলও সে কথা স্বীকার করেছেন। আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে পরিবারের স্পর্শে বেড়ে ওঠা মানুষ অনেক বেশি সুখী, মেধাবী ও নৈতিকবোধসম্পন্ন হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, বহু জটিল রোগ ও মানসিক সমস্যার সহজ সমাধানের একমাত্র নাম পরিবার।
পরিবার ছাড়া মানুষ অনেকটা পশুর মতো। অন্যভাবে বলতে গেলে, পশু ও মানুষের মাঝে একটি পার্থক্য হলোÑ পশুর মাঝে শক্তিশালী পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন নেই, কিন্তু মানুষের মাঝে আছে। যদিও পশুর কোনো কোনো প্রজাতিতে পারিবারিক বন্ধনের কথা পাওয়া যায়, তবে তা ব্যতিক্রম। যেমন মানুষের মাঝেও পরিবারবিরোধী সংগঠক-চিন্তক পাওয়া যায়। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পারিবারিক সম্প্রীতির ব্যাপারে এত বেশি বলেছেন যে, হাদিস ও ফিকহ শাস্ত্রে পরিবার নিয়ে আলাদা অধ্যায় সৃষ্টি হয়েছে। কোরআন পরিবার সম্পর্কে সংক্ষেপে বলেছে, কিন্তু মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ কথা বাদ দেয়নি। সূরা নূরসহ বিভিন্ন সূরায় আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘সামর্থ্যবান নারী-পুরুষের বিয়ে দেওয়াটা জরুরি।’ বিয়ের পর পারিবারিক বন্ধন ও লজ্জাস্থানের হেফাজত রাষ্ট্রীয়ভাবে দেখভালের কথা বলেছে কোরআন। সন্তান গর্ভধারণ, দুধপান, বাবা-মার সঙ্গে ব্যবহার, সন্তানের প্রতি কর্তব্য এবং খুব প্রয়োজন হলে বিচ্ছেদ নিয়ম-কানুন কী হবে তা বিস্তারিত বলেছেন কোরআন।এই যে পরিবার নিয়ে ধর্ম বিশেষ করে কোরআন এবং ইসলাম এত বেশি গুরুত্বারোপ করেছে, এতে আসলে লাভ কার? আল্লাহর? নবীর? না। লাভ পুরোটাই মানুষের। কী লাভ তা বলার আগে আরেকটি কথা বলে নিই। কিছু মানুষের ধারণা, জীবনের ব্যাপারে তারা পুরোপুরি স্বাধীন। কোনো বিধিনিষেধের তোয়াক্কা করার ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তাই তারা অনুভব করে না। তারা ধর্ম ও স্রষ্টাকে পর্যন্ত অস্বীকার করে। তাদের একটি ভুল চিন্তা হলো, পরিবারের প্রয়োজন নেই। অন্যান্য প্রাণীর মতো মানুষও যেমন খুশি তেমনভাবে যৌন কামনা পূরণ করবে। লিভ টুগেটার করবে, গ্রুপ সেক্স করবে, ফ্যামিলি সেক্স করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ চিন্তাটি যে ভুল, বাস্তবতা থেকে একটি চিত্র আপনাদের সামনে তুলে ধরছি তাহলেই বুঝতে পারবেন পরিবারের প্রতি ধর্মের এই গুরুত্বারোপ কত বেশি যৌক্তিক ও প্রয়োজনীয়।
একজন হিন্দু যোগীকে প্রশ্ন করা হলো কেন বিয়ে এত গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবত ইউরোপে তরুণদের একটি সম্মেলনে তিনি এ প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। ভিডিওটি ইউটিউবে আছে। যে কেউ চাইলে ‘সদগুরু’ লিখে সার্চ দিয়ে দেখে নিতে পারেন। তিনি বললেন, ‘আমি যদিও ধর্মে হিন্দু তবে মানবতা এবং মনুষ্যত্বে বিশ্বাসী। আমার পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা ঘোর নাস্তিকদের মধ্যে। এই ইউরোপের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমি ডিগ্রি নিয়েছি। আমি দেখেছি, একজন নারী যিনি যৌবনে বিয়ের কোনো গুরুত্বই অনুভব করেন না, বিভিন্ন যুক্তি দেখিয়ে বলেন বিয়ে করলে এই হয় সেই হয়। নারীকে শিকলে বন্দী করা হয়, অধিকার ক্ষুণœœ করা হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। ওই নারীটি যখন চল্লিশ পেরিয়ে পঞ্চাশের কাছাকাছি চলে আসেন এবং যৌবনের আবরণ তার দেহ থেকে পড়ে যায়, তখন তাকে সেজেগুজে কোনো মদের দোকানে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। কোনো ছেলেবন্ধু তাকে কিছু সময় দেবে আনন্দ বিনোদনের জন্য। যৌনমিলন না করুক অন্তত তার সঙ্গে বসে কথা বলুক, তার সঙ্গে সময় কাটাক এজন্য হলেও একজন পুরুষের খুব প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন ওই নারী।’ তিনি আরও বলেন, ‘দৃশ্যটি আমার খুবই খারাপ লাগে। আমি বহু নারীকে জিজ্ঞাসা করেছি, এখন তোমার কী মনে হয় বিয়ে ভালো নাকি উন্মুুক্ত যৌনতা ভালো? চোখের পানি ছেড়ে তারা বলেছেন, বিয়ে করলে আজ অন্তত পাশে কেউ না কেউ অবশ্যই থাকত। আমাদের জীবনের চরম ভুল ছিল বিয়ে না করা। বিয়ে করা সবার জন্য জরুরি নয়। আবার বিয়ে না করারও কোনো যৌক্তিক কারণ আজও কেউ দেখাতে পারেননি। তবে আমাদের ধর্মবিশ্বাস ও নবী বিয়ের প্রতি যে ধরনের গুরুত্ব দিয়েছেন তা থেকে সহজেই বুঝতে পারা যায়, বিয়েহীন সমাজ অন্তত মুসলমানের সমাজ নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজ ধীরে ধীরে বিয়েহীন, পরিবারবিমুখ হয়ে পড়ছে! এর নানাবিধ কারণও রয়েছে। তরুণরা বিয়ের প্রতি যতই বিমুখ হচ্ছে, ব্যভিচারের প্রতি ততই আগ্রহী হচ্ছে। এর পরিণাম বড়ই ভয়াবহ। আল্লাহতায়ালার শাস্তি থেকে বাঁচতে চাইলে, ভেঙে যাওয়া সমাজ ও পরিবারকে আবার দাঁড় করাতে চাইলে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে ধর্মচিন্তকদের। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন।
লেখক : মুফাস্সিরে কোরআন।