সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
সাম্প্রতিক

শিক্ষাঙ্গনে সুস্থতা ফিরে আসুক

মাহমুদুর রহমান সুমন

শিক্ষাঙ্গনে সুস্থতা ফিরে আসুক

শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে। সুনীতির পথ দেখায়। শিক্ষার সঙ্গে দুর্নীতির দূরতম সম্পর্ক থাকার কথা নয়। কিন্তু আমাদের দেশে দুর্নীতি সর্বস্তরে এমনই থাবা বিস্তার করেছে যে শিক্ষাঙ্গনও তা থেকে মুক্ত নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বলা হয় দুর্নীতির মন্ত্রণালয়। আর সে কারণে দুর্নীতি দমন কমিশনও এ ব্যাপারে নড়েচড়ে বসেছে। শিক্ষাঙ্গনের দুর্নীতি নিয়ে বিস্তারিত তদন্ত, গবেষণা, সমীক্ষা চালিয়ে তারা শিক্ষাঙ্গনের দুর্নীতিরোধের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা পাঠিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবরে।

প্রশ্নপত্র ফাঁস, নোট-গাইডের কুফল, কোচিং বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণে দুর্নীতি-গলদ, এমপিওভুক্তি, নিয়োগ-বদলি ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে তাতে। দুদকের একটি প্রাতিষ্ঠানিক টিম কাজ করেছে এ বিষয়ে। এই টিমের বিশ্বাস : তাদের সুপারিশ            বাস্তবায়ন করা গেলে দুর্নীতি অনেকটাই হ্রাস পাবে। এই প্রতিবেদনে দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে ৩৯টি সুপারিশ করা হয়েছে।

বিশ্বের শীর্ষ এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠাঁই হয়নি। লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাঙ্কিং টু থাউজ্যান্ড টুয়েন্টি’ প্রকাশ করেছে সম্প্রতি। সারা বিশ্ব থেকে ৯২টি দেশের ১৩০০ বিশ্ববিদ্যালয় এ তালিকায় স্থান পেয়েছে। শিক্ষার পরিবেশ ও গবেষণাসহ পাঁচটি মানদন্ডে এই তালিকা প্রণীত হয়। দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই। এই তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম যে একেবারেই নেই, তা নয়। রয়েছে তবে এক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরে সেই নাম।

বাংলাদেশে এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অর্ধশতের উপরে। সরকার উদার হস্তে এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশাল অঙ্কের উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দ করছে। কিন্তু শিক্ষা ও গবেষণার মান কী আশানুরূপ হারে বাড়ছে? এ প্রশ্নের একটাই জবাব, না। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠছে, জনগণের কষ্টার্জিত আয় থেকে প্রদত্ত ট্যাক্সের অর্থ কতটা অপচয় হচ্ছে?

বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগের শেষ নেই। ইতিমধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে ৩৩ ধরনের অসঙ্গতি, অনিয়ম। যেসব কারণে সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্চা যাচ্ছে। এই অর্থ চলে যাচ্ছে বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ঠিকাদারসহ সংশ্লিষ্ট লোকজনের পকেটে। সম্মানী নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম দানা বেঁধে উঠছে। আটটি শিক্ষা বোর্ডের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের আয়-ব্যয়ের ওপর স্থানীয় সরকার ও রাজস্ব অডিট অধিদফতর অনুসন্ধান চালিয়ে যে নিরীক্ষা রিপোর্ট তৈরি করেছে তা এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর চাকরিপ্রত্যাশী একজনের কাছে জানতে চেয়েছেন, ‘তোমরা কত টাকা দেওয়ার জন্য রেডি?’ এই ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। চাঞ্চল্যকর এই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে গত ২ অক্টোবর, একটি জাতীয় দৈনিকে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ফরমের কোটি কোটি টাকা শিক্ষকদের পকেটে। অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি ফরমের ফি ৫০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সম্মানী ভাতা আগের বছরের চেয়ে এক কোটি টাকা বেশি ধার্য করার খবর পাওয়া গেছে।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের সঙ্গে এক বৈঠকে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি কঠোর বার্তা দিয়েছেন। বলেছেন, ‘কোনো কোনো ভিসি তার অবস্থানের অপব্যবহার করছেন। অসদাচরণ করছেন। ভিসিদের নিয়ে আমরা যা শুনি, তার সবই কি পত্রিকার তৈরি? কেউ কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা ধ্বংসের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। ভিসিরা অনেক সম্মানিত ব্যক্তি। কিন্তু আইন মেনে না চললে এমন ভিসির দরকার নেই।

উপাচার্যদের মূল সমস্যা জবাবদিহির। তিনি নিয়োগ পান প্রধানত সরকারের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের ভিত্তিতে। এই আনুগত্যের প্রতি তার জবাবদিহি থাকলেই চলে। শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে ভিন্নমতাবলম্বী কোনো প্রবণতা রুখে দেওয়া ও সরকারের অন্ধ গুণগান করে এসব আনুগত্যের প্রমাণ দেওয়া হয়। প্রথম কাজটা কঠিন। এই কঠিন কাজটা করার জন্য তিনি সমমনাদের নিয়ে প্রশাসন সাজান, মারমুখী অনুগতদের নিয়ে অবাধ প্রশ্রয় প্রদান করেন। বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সহাবস্থান, শিক্ষার মান, গবেষণা কার্যক্রম প্রসারে এমনকি দুর্নীতি-নিপীড়ন প্রতিরোধে তিনি নিন্দনীয় ভূমিকা গ্রহণ করলেও তাকে কারও কাছে জবাব দিতে হয় না। ফলে কিছু কিছু উপাচার্য হয়ে ওঠেন স্বেচ্ছাচারী।

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের এখন অন্যতম কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন। কারণে অকারণে মোসাহেবি তথা সরকারের গুণগান করা এবং সরকারের যে কোনো বিষয়ের কোনো প্রতিবাদ হলে তা কঠোরভাবে দমন করা। অথচ যে কোনো সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদ করার একটি অনন্য ঐতিহ্য ছিল বাংলাদেশের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। এখনো বাম সংগঠনগুলো, সাধারণ ছাত্ররা বা কিছু শিক্ষক তা করে থাকেন। কিন্তু বেশিরভাগ ব্যস্ত থাকেন তাদের গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজে। অনেকে আবার নীরব থাকেন ভোগান্তির ভয়ে। মোদ্দাকথা- শিক্ষাঙ্গনের দুর্নীতি মূলোৎপাটনসহ সব ধরনের সমস্যা সংকট নিরসনের জন্য যা সর্বাগ্রে প্রয়োজন, সেটি হচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও দেশপ্রেম। সম্মিলিত সমন্বিত বাস্তবানুগ প্রয়াস। একা সরকারের পক্ষে কখনোই সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। প্রতিটি নাগরিকেরই দায়িত্ব রয়েছে এ ব্যাপারে। যার যার অবস্থান থেকে সঠিক ও আন্তরিকভাবে সেটি পালন করলে অন্ধকার সম্পূর্ণ না হোক, অনেকখানিই দূর হতে পারে।

                লেখক : কলামিস্ট।

সর্বশেষ খবর