শিরোনাম
মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

শুভ নববর্ষ

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

শুভ নববর্ষ

আজ ইংরেজি বর্ষের শেষ দিন। ডিসেম্বর বাঙালি জাতির জন্য শ্রেষ্ঠ গৌরবের মাস। হাজার বছরে বাঙালি কখনো স্বাধীন ছিল না। মোগল-পাঠান-ইংরেজ তো সেদিনের কথা। চেঙ্গিস খান-হালাকু খান-গজনি-মাহমুদ বা তারও আগে কখনো কোনো দিন আমরা স্বাধীন ছিলাম না। ২-৪-১০-২০ বা শত বছর আমরা আমাদের শাসন পরিচালনা করলেও বহিঃশত্রুর হাত থেকে কখনো বাঁচতে পারিনি। পরাশক্তির পদানত আমাদের হতেই হয়েছে। তবে আমরা কখনো বশ মানিনি। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের ভূখ- শত্রুমুক্ত করেছি মাত্র, স্বাধীন হয়েছি বলা যাবে কিনা জানি না, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কোনো ক্ষেত্রেই মুক্তি আসেনি। পাকিস্তানে ছিল ২২ পরিবার, এখন আমাদের লুটে খাচ্ছে ৫২ হাজার পরিবার। লুটের হাত থেকে মুক্তি নেই। অন্যদিকে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর ভর করে রাস্তাঘাট এটাওটা করতে গিয়ে ঋণের বোঝায় দেশকে দেউলিয়া করে ফেলছি। আমার বাড়িতে ৭০০-৮০০ টাকায় যে বালিশ কেনা হয়, সেই বালিশের ৭-৮ হাজার টাকা দাম! ঘরে তুলতে ৬ হাজার, যেখানে ৩০ টাকার বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়। পর্দার দাম ৩৭ লাখ টাকা! যেটা হয়তো ৩৭০০-তে কেনা যায়। এভাবে বিদেশি ঋণের টাকা হরিলুট করলে পরবর্তীতে দেশ শোধ করবে কীভাবে- কেউ দেখার নেই, কেউ ভাবার নেই। যে দেশের স্বাধীনতা এসেছে রাজনীতির ওপর ভর করে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার রক্ষা করতে। সে দেশের গণতন্ত্র বিপদগ্রস্ত, ভোটের নামগন্ধ নেই। এ রকম এক অবস্থায় হঠাৎ আ স ম আবদুর রবের ফোন। হ্যালো বলতেই, ‘কাদির, ২৮ তারিখ জেএসডির জাতীয় সম্মেলন। তুমি আসবে।’ আ স ম আবদুর রবের কোনো আহ্বান ফেলতে পারি না। এটাও পারিনি। তাই গিয়েছিলাম ২৮ ডিসেম্বর মহানগর নাট্যমঞ্চে। চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। আ স ম আবদুর রবের আহ্বানে গত ২৫ বছরে কম করে ৪০-৫০টি অনুষ্ঠানে গেছি। কোনো অনুষ্ঠানেই এত স্বতঃস্ফূর্ত এবং অত লোকসমাগম দেখিনি। মহানগর নাট্যমঞ্চে আমরা নিজেরা চার-পাঁচটি মিটিং করেছি। অন্যদের মিটিংয়েও ৫-৭-১০ বার গেয়েছি। সব সময় যে হলভর্তি দেখেছি তেমন নয়। কিন্তু এ যাত্রায় দেখলাম বিপরীত। হলে জায়গা হয়নি। আর লোকগুলো বস্তি থেকে আনা নয়। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা। বড় অভিভূত হয়েছি। সেই ’৬২ সালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে সম্মেলন দেখতে শুরু করেছি। সত্যিই এমন স্বতঃস্ফূর্ত সম্মেলন স্বাধীনতার পর খুব একটা দেখিনি। পাকিস্তান আমলে যেসব ছাত্র-যুব কাউন্সিল দেখেছি সেসব থাকত প্রাণভরা উদ্দীপনাময়। এখন যা হয়- বস্তি থেকে ভাড়া করা বাচ্চা কোলে যারা আসে তারা আরও অভাবনীয়। দুই পা চেয়ারে তুলে বাচ্চা নিয়ে যখন পান চিবোয় সে এক দেখার মতো দৃশ্যের অবতারণা করে। ২৮ তারিখ আ স ম আবদুর রবের কাউন্সিলেও বেশকিছু মহিলা বাচ্চা কোলে এসেছিলেন। তাঁরা কেউ বস্তি থেকে আসেননি। তাঁরা আমাদের মতো পরিবার থেকে এসেছিলেন। বড় ভালো লেগেছে। আমি বস্তিকে ঘৃণা করি না। বরং বস্তির মহিলাদের আমার সন্তানের মতো মনে করি, মা-বোনের মতো সম্মান করি। তবু বস্তি থেকে টাকা দিয়ে কাউকে আনা আর কোনো রাজনৈতিক দলের নীতি-আদর্শ ভালোবেসে সেই দলের কোনো অনুষ্ঠানে আসা এক কথা নয়।

জনাব আ স ম আবদুর রবের দাওয়াত পেয়ে বারবার ভাবছিলাম, এই সবে আবদুল মালেক রতনের নেতৃত্বে জেএসডি ভাগ হলো। কেমন হবে তার কাউন্সিল। দেখলাম যা হওয়ার তাই হলো। আ স ম আবদুর রব, আ স ম আবদুর রবই। তাঁর কোনো বিকল্প নেই। সেদিন দেখলাম জাতীয় পতাকা তুলতে হাত কাঁপে। একবার বাঁ হাতে পতাকা তুললেন। জাতীয় সংগীত শেষ না হওয়ায় আবার তা নামিয়ে ডান হাতে তুললেন। আমি বহুবার বলেছি, জাসদ বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক দল। যে কোনো মানবের প্রথম সন্তানের মতো তাদের ভুল আছে ত্রুটি আছে। কিন্তু তারাই বাংলাদেশের প্রথম রাজনৈতিক সন্তান। বিএনপি, জাতীয় পার্টি বা গামছার দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এসবের অনেক আগে জাসদের জন্ম। জাসদ ১৪ টুকরো হতে পারে। মেজর জলিল মারা গেছেন, শাজাহান সিরাজ অচল, এখনো আ স ম আবদুর রব চলে ফিরে বেড়ান। আ স ম আবদুর রবের জাসদই আমার চোখে বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া প্রথম রাজনৈতিক দল। যেখানে মালেক রতন থাকলেও যা, না থাকলেও তা। বড় ভালো লেগেছে, উদ্বেলিত হয়েছি ২৮ তারিখের জাতীয় কাউন্সিলে হাজির হয়ে। লিখছি যখন গোড়া থেকেই লিখি। কারণ আমাদের অতীত মসৃণ নয়, ঢেউ খেলানো বড় উঁচুনিচু এবড়ো-থেবড়ো। আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা নিয়ে লতিফ সিদ্দিকী টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে ছিলেন। কি দুর্বার সাহস ও ক্ষমতা থাকতে পারে একজন মানুষের সেটা লতিফ সিদ্দিকী ছাড়া বোঝা যায় না। আমাকে নিয়ে কত কথা হয়, মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখার জন্য আমার সাহস নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই লতিফ সিদ্দিকীর শত ভাগের এক ভাগ সাহসও আমার ছিল না, এখনো নেই। লতিফ সিদ্দিকীর মধ্যে কিছু ব্যতিক্রম এখন দেখতে পাই। কদিন আগেও তিনি জেলে ছিলেন। আওয়ামী ঘরানার বড় বড় এমন কোনো আইনবিদ নেই যাদের কাছে যাওয়া হয়নি। লতিফ সিদ্দিকীর জন্য কোর্টে দাঁড়ালে নেত্রী অসন্তুষ্ট হতে পারেন এই ভয়ে অনেকে জামাকাপড় নষ্ট করেছেন। মনে হয় সাত-আট বছর পর তাপসের কাছে গিয়েছিলাম। সেও খুব সাহসী ভূমিকা নিতে পারেনি। তাপসের বাবা মণি ভাই জীবনে কোনো দিন আমার কথা ফেলেননি। তাঁর কাছে আমার কাদের সিদ্দিকী পরিচয় ছিল না, কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমও ছিলাম না, বাঘা সিদ্দিকী তো নয়ই। তাঁর কাছে আমার পরিচয় ছিল লতিফের ভাই। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মণি ভাইয়ের হত্যা। তারপর পরশ-তাপসের জন্য আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার আকাশ-পাতাল এক করা উৎকণ্ঠা। ওরা দুজন কোলে ওঠার বয়সে বাবা-মা হারিয়েছে। দু-চার বার যখন কাছে পেয়েছি সন্তানের মতো যত্ন করেছি। কিন্তু কেউ লতিফ সিদ্দিকীর জন্য কোর্টে দাঁড়ায়নি, দাঁড়াতে সাহস করেনি। অথচ ছয়-সাত মাস ঘোরাফেরার পর মোটামুটি সাধারণ আইনজীবীই তাঁকে জেল থেকে বের করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার বোন হয়তো এসবের কিছুই জানেন না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে আমাদের এ রকম অহেতুক বিড়ম্বনা সহ্য করতে হয়। সবকিছুতেই কেন যেন একটা ভয়। অথচ শাস্ত্রের কথা, ভয়-ভীতি নিয়ে কোনো কিছু পরিপূর্ণ বিকশিত হয় না। শঙ্কামুক্ত ভাবনাহীন চিত্তে অগ্রসর হতে না পারলে জয়ের দেখা মুশকিল। তাই প্রায় সময়ই ভাবী, বঙ্গবন্ধুর আমলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কি আনন্দেই না ছিলাম। কোনো কাজ করতে কোনো ভয় ছিল না। ভয় ছিল একটাই- তিনি আমাদের কখন অযোগ্য ভাবেন, লোভী ভাবেন। পিতার কাছে যোগ্য হতে দিনরাত এক করেছি। কখনো কোনো কাজে আটকে গেলে পিতার মতোই উপদেশ দিয়েছেন। কোনো সময় ডুবতে যাওয়া থেকে টেনে তুলেছেন। হাবুডুবু খাওয়ার সময় চেপে ধরে ডুবিয়ে দেননি। লিখছি যখন তাই সবকিছুই পরিষ্কার করতে চাই। বাঁশি যদি আর না বাজে, আর যদি লিখতে না পারি। কী কারণে কেন যেন বেশ কিছুদিন আগে এক সন্ধ্যায় খোদাবক্স মোক্তারের ছেলে আবু মোহাম্মদ আনোয়ার বক্সের বাড়ি গিয়েছিলাম। আনোয়ার বক্স একজন নীতিমান মানুষ। তিনি করতেন শাজাহান সিরাজের গ্রুপ, আমরা করতাম লতিফ সিদ্দিকীর গ্রুপ। সারা দুনিয়ায় শান্তি থাকলেও টাঙ্গাইল গ্রুপের দ্বন্দ্বে ছিল অস্থির। আমাদের আমলে খুব একটা মারামারি, কাটাকাটি ছিল না। কিন্তু তর্ক-বিতর্ক ছিল। আমরা যুক্তিতর্কে সবাই ছিলাম জগদ্বিখ্যাত। ষাটের দশকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের সঙ্গে অন্যসব দল যুক্তিতর্কে না পারার এটাও ছিল এক মস্ত বড় কারণ। কোনো রাজনৈতিক দলের ছায়াসংগঠনে এত বক্তা তখন আর কারও ছিল না। ’৬৯-এ আমি যখন টাঙ্গাইল জেলার খন্ডিত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হই, তার আগের কমিটির সভাপতি ছিলেন আবু মোহাম্মদ আনোয়ার বক্স। আমাদের সম্মেলনে শাজাহান সিরাজ অংশগ্রহণ করেননি। মনিরুল হক চৌধুরী ও অন্যরা সম্মেলন অনুমোদন করেছিলেন। আনোয়ার বক্সও আমাদের সম্মেলনের অনুমোদন দিয়েছিলেন। পরে যখন শাজাহান সিরাজ নিজে এসে পাল্টা সম্মেলন করেন সেখানে আনোয়ার বক্স অংশগ্রহণ করেননি। ভদ্রলোক বড় নীতিমান ছিলেন। সেখানে তাঁর নীতির পরিচয় দিয়েছিলেন। সেই আনোয়ার বক্সের বাড়িতে কথায় কথায় আমি যখন বলছিলাম, শাজাহান সিরাজ অনেকদিন যাবৎ মৃত্যুশয্যায় পড়ে আছেন। কথাটা শুনে আনোয়ার বক্স দুঃখ প্রকাশের চেয়ে ক্ষিপ্তই হয়েছিলেন বেশি। বলেছিলেন, ‘এই শাজাহান সিরাজের জন্য কী না করেছি! ছেলেবেলায় বুঝিনি শাজাহান সিরাজ আর লতিফ সিদ্দিকীর এই দ্বন্দ্বে টাঙ্গাইলকে এগোতে দেয়নি, আমাদের এগোতে দেয়নি। দুই দিন পর টাঙ্গাইলে উল্লেখ করার মতো কেউ থাকবে না। তখন শুধু পা ধরা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।’ কথাটা আমার কাছে তেমন ফেলনা মনে হয়নি। যথেষ্ট যৌক্তিকতা ছিল। স্বাধীনতার পর শাজাহান সিরাজ জাসদে চলে যান। টাঙ্গাইলে যারা আমাদের বাইরে ছিলেন তারা সব জাসদে গিয়েছিলেন। আমরা ধরে রেখেছিলাম ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুকে মারার আগে যারা শিকড় কেটেছে, গোড়া কেটেছে তাদের বেশিসংখ্যক বর্তমান আওয়ামী লীগ। আর যারা দিবসে নিশিথে চেতন-অচেতন সর্বসময়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে লালন করে চলেছি তারা অত্যাচারিত নিগৃহীত। স্বাধীনতার পরপরই ছাত্রলীগ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। যত দিন এক ছিল তত দিনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় ‘নিক্সন-কাদের ভাই ভাই, এক রশিতে ফাঁসি চাই’। কোথায় ছোট্ট এক ভূখ- বাংলাদেশ, তার মধ্যে বিন্দুসম কাদের সিদ্দিকীর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে এক দড়িতে ফাঁসি চাওয়া হয়েছে। সহ্য করেছি তাই টিকে আছি। ধৈর্য বড় মারাত্মক জিনিস। যে রব সাহেবরা বা তাঁর কর্মীরা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে আমার ফাঁসি চেয়েছেন তাঁরা আমাকে টলাতে পারেননি। বরং তাঁরাই টলে হৃদয়ে জায়গা দিয়েছেন, মাথায় না হোক কাঁধে তোলার চেষ্টা করেন। সেজন্য আ স ম আবদুর রবের কোনো কথা ফেলতে পারি না। সভায় যখন বক্তারা বক্তৃতা করতে গিয়ে তাঁকে বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলক বলেন আমি খুব উৎসাহ পাই না। আ স ম আবদুর রব বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলক এতে প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় নেই। স্বাধীন বাংলাদেশে স্কুলের ছাত্র থেকে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত যে কেউ পতাকা তুলতে পারেন। কিন্তু পাকিস্তানের মধ্যে বাংলাদেশের পতাকা তোলা বুকের পাটার দরকার। যতকাল বাংলাদেশ থাকবে যতকাল পতাকা থাকবে, ততকাল আ স ম আবদুর রবের ভূমিকা বা অবদান থাকবে। মতভিন্নতা যতই থাকুক পতাকা উত্তোলক হিসেবে আ স ম আবদুর রবের আলাদা জায়গা থাকা উচিত ছিল। কিন্তু তা থাকেনি, কারণ আমরা অন্যকে সম্মান করতে জানি না, সবাই নিজের সম্মান নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু নিজেকে নিয়ে এ ব্যস্ততায় শেষ পর্যন্ত পরিণাম ভালো হয় না। ভোটবিহীন একটা বছর চলে গেল। যে দেশ ভোট ও গণতন্ত্রের জন্য জন্ম নিয়েছে সে দেশে ভোট ও গণতন্ত্রের কোনো মূল্য নেই। আল্লাহ জানেন গত বছর আমরা যেভাবে কাটালাম আগামী বছরও তেমন কাটবে কিনা। তবে আমরা তো আশা করব, আগামী বছরটি শুভ হবে, ভালো হবে, আমাদের সমস্ত আশা-আকাক্সক্ষা পরিপূর্ণ হবে। শুভ ইংরেজি নববর্ষ।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর