জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ব ব্যবস্থার সর্বোচ্চ আদালত নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) গত ২৩ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সময় বিকাল ৩টায় রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া কর্তৃক দায়েরকৃত মামলায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক রুল এবং অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ জারি করেছেন। বহু কারণে এই অন্তর্বর্তীকালীন আদেশটি ঐতিহাসিক এবং আগামী দিনের বিশ্ব ব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল আবুবকর মারি টামবাদু ৪৬ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তিনটি অভিযোগ উত্থাপন করেন। এক. মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত গণহত্যা চালিয়েছে। দুই. মেয়েশিশুসহ রোহিঙ্গা নারীদের ওপর পরিকল্পিত গণধর্ষণ চালিয়েছে। তিন. রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার জন্য সুনির্দিষ্ট পন্থায় হাজার হাজার বাড়িঘর, মসজিদ, মাদ্রাসা ও দোকানপাট আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমনকি বাসিন্দাদের ঘরের ভিতরে তালাবদ্ধ করে আগুন দেওয়া হয়েছে এবং আগুনে পুড়ে সব শেষ না হওয়া পর্যন্ত মিয়ানমারের সেনা সদস্যরা অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে থেকেছে। এই তিনটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মিয়ানমারের অপরাধীদের চিহ্নিত এবং দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল আবুবকর মারি টামবাদু। একই সঙ্গে তিনি আদালতের কাছে আবেদন করেন বেঁচে থাকা রোহিঙ্গাদের রক্ষা করার জন্য আদালত যেন মিয়ানমারের ওপর অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ জারি করেন। মিয়ানমারের দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণ এবং মিয়ানমার যাতে আর কোনো দিন এ ধরনের আগ্রাসন চালাতে না পারে তার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করে সেটিও দাবি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল টামবাদু। গণহত্যা প্রতিরোধকল্পে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রদত্ত কনভেনশন তৈরির প্রেক্ষাপট সম্পর্কে যিনি গবেষণা করেছেন সেই আইনজ্ঞ অধ্যাপক ফিলিপ স্যান্ডাস কিউসি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র তৈরিতে আবুবকর টামবাদুকে সহযোগিতা করেছেন। অপরাধের সচিত্র প্রতিবেদনসহ জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির প্রতিবেদন, ব্রাসেল ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ, হিউম্যান রাইট ওয়াচ, অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি কর্তৃক তৈরি প্রমাণাদি অভিযোগপত্রের সঙ্গে দাখিল করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল টামবাদু। আদালত কর্তৃক শুনানি শুরুর প্রথম দিনে প্রাথমিক বক্তব্যে টামবাদু বলেনÑ আমি মিয়ানমার ও বিশ্ব সম্প্রদায়কে বলতে চাই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কর্তৃক স্মরণকালের ভয়াবহ গণহত্যার দৃশ্য দেখে আমরা নীরবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। আমাদের জন্য লজ্জাজনক যে, চোখের সামনে এসব জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটছে, আর আমরা কিছুই করতে পারছি না। অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ যেটি ২৩ জানুয়ারি জারি হয়েছে সেটি এবং আগামী চূড়ান্ত বিচার কোনদিকে যেতে পারে তার কিছু ধারণা পাওয়ার জন্য গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী, সাহসী এই যোদ্ধা অ্যাটর্নি জেনারেল আবুবকর টামবাদুর ট্র্যাক রেকর্ড সম্পর্কে সামান্য আলোকপাত প্রয়োজন। কারণ, বিচারের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় তিনিই প্রধান ভূমিকা রাখবেন। হিউম্যান রাইট অর্গানাইজেশন গ্লোবাল সেন্টারের প্রধান সাইমন আদমস টামবাদু সম্পর্কে বলেন, যেখানে চীনের হুমকিতে অনেকেই চুপসে যেতে পারেন, সেখানে মিয়ানমারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর জন্য রাজনৈতিক সাহস, দক্ষতা এবং মানবিক সততা কেবল আবুবকর টামবাদুরই রয়েছে। তার নৈতিক সাহস ও কৌশলী উপস্থাপনায় আদালতে উপস্থিত অনেকেই মন্তব্য করেছেন এই মর্মে যে, বর্তমানে বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির সমীকরণ ও তার বাস্তবতায় যেরকম খারাপ সময় চলছে তাতে গাম্বিয়ার মতো ক্ষুদ্র একটি রাষ্ট্রের বিচারমন্ত্রী টামবাদু অসাধারণ সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। গাম্বিয়ার রাজধানী বানজুলে ১৯৭২ সালে এই সাহসী আইনজ্ঞ জন্মগ্রহণ করেন। পিতার তিন স্ত্রীর সূত্রে ১৮ ভাইবোনদের মধ্যে ক্রমিক নম্বরে ছিলেন মধ্যবর্তী স্থানে। পিতার ইচ্ছা ছিল ছেলে ভবিষ্যতে স্পোর্টস ফিল্ডে বৈশ্বিক অঙ্গনে নামজাদা কিছু হবে। কিন্তু দেশের নির্যাতিত, নিপীড়িত এবং অত্যাচারিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানবতার সেবা করার জন্য তিনি আইন পেশাকে বেছে নেন। নিজ দেশের স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে দাঁড়ানোর জন্য তিনি নির্বাসিত হয়েছেন। কিন্তু দমে যাননি। কঠিন সংগ্রাম করে স্বৈরশাসককে হটিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। দায়িত্ব নিয়েছেন বিচারমন্ত্রীর। তারপর থেকে মানবতার বিপর্যয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকেননি। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার গণহত্যার বিচারে দানবদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে এই টামবাদুই ছিলেন প্রধান কৌঁসুলি। এক কথায় আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়ায় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন টামবাদুই আগামীতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আলোচ্য রোহিঙ্গা গণহত্যার মামলা পরিচালনা করবেন।
অভিযোগপত্রের ওপর প্রাথমিক শুনানির পর টামবাদুর দাবি অনুযায়ী আদালত পরিপূর্ণভাবে সন্তুষ্ট হয়ে চূড়ান্ত বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত চারটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ জারি করেছেন। এক. ১৯৪৮ সালের জাতিসংঘের কনভেনশন অনুযায়ী গণহত্যা প্রতিরোধকল্পে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করবে মিয়ানমার সরকার। দুই. গণহত্যার প্রমাণাদি ধ্বংস করা যাবে না। মিয়ানমার সরকারকেই তা সংরক্ষণ করতে হবে। তিন. মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থার মধ্যে আনতে হবে যাতে তারা আর গণহত্যা চালাতে না পারে। চার. এই অন্তর্বর্তী আদেশের কার্যকরণ সম্পর্কে প্রথমে চার মাস পর এবং তারপর প্রতি ছয় মাস অন্তর মিয়ানমার সরকারকে আন্তর্জাতিক আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এটা চলতে থাকবে চূড়ান্ত বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত। গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের পক্ষ থেকে নিয়োজিত একজন করে মোট দুজন অ্যাডহক বিচারপতিসহ সর্বমোট ১৭ বিচারপতি সর্বসম্মতিক্রমে উপরোক্ত আদেশ জারি করেন এবং জনাকীর্ণ আদালতে সেটি পড়ে শোনান প্রধান বিচারপতি আবদুলকোয়াই আহমদ ইউসুফ। ১৭ বিচারকের মধ্যে আদেশ সম্পর্কে কেউ দ্বিমত পোষণ করেননি, যেটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ এবং খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আদালতে উত্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ ও যুক্তি এতটাই ছিল যে, মিয়ানমার সরকার কর্তৃক নিয়োজিত অ্যাডহক বিচারপতিও দ্বিমত পোষণ করার কোনো সুযোগ পাননি। আদালত কর্তৃক আদেশ ঘোষণার পর অ্যাটর্নি জেনারেল টামবাদু মন্তব্য করেছেনÑ ‘এই আদেশের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায্যতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আদালত এই মর্মে কঠোর বার্তা দিলেন যে, বিশ্বের যেখানে এবং যারাই গণহত্যা চালাবেন তারা কেউই রক্ষা পাবেন না। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিশ্বের সব মানবাধিকার সংস্থা ও সংগঠন থেকে আদেশ বের হওয়ার পর বলা হয়েছে, মিয়ানমার গণহত্যার দায় থেকে রক্ষা পাবে না। আন্তর্জাতিক আদালতের বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়ে চূড়ান্ত রায় বের হতে হয়তো আরও পাঁচ-ছয় বছর তারও বেশি সময় লেগে যেতে পারে। কিন্তু অন্তর্বর্তী আদেশগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় মামলায় অধিকন্তু আদালত প্রাথমিকভাবে সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং ধরে নিয়েছেন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। এখন শুধু সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে সেটিকে প্রতিষ্ঠা করা। এই অন্তর্বর্তী আদেশের মাধ্যমে আরেকটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেল, আর তা হলো শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চির সুনাম বলতে যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তা একদম শেষ হয়ে গেল। সামরিক বাহিনীর পক্ষে আন্তর্জাতিক আদালতে তিনি নিজে উপস্থিত হয়ে সামরিক বাহিনীর সাফাই গেয়ে বলেছেন, রাখাইনে কোনোরকম হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেনি। সু চির কঠোর সমর্থকও জানেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর তার কোনো কর্তৃত্ব নেই। কিন্তু আদালতে উপস্থিত হয়ে তিনি স্বইচ্ছায় সামরিক বাহিনীর অপরাধের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সু চি আরও বেশি করে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। আদালত কর্তৃক আদেশ ঘোষণার পর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে মিয়ানমার এই আদেশ মান্য করে কার্যকরী ব্যবস্থা নেবে কি নেবে না। এই আদেশ বাস্তবায়ন করার নিজস্ব কোনো ব্যবস্থা আদালতের হাতে নেই। জাতিসংঘের কনভেনশন অনুযায়ী এই আদেশ সরাসরি নিরাপত্তা পরিষদে চলে যাবে। জাতিসংঘের কনভেনশন অনুযায়ী এই আদেশ মান্য করার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে চীন হয়তো ভেটো দিয়ে এই আদেশের কার্যকারিতা ঠেকিয়ে দিতে পারে। তাহলে সেটা হবে আন্তর্জাতিক আইনের চরম লঙ্ঘন। কারণ এটি অন্যান্য বিষয়ের মতো সাধারণ কোনো প্রস্তাব নয়। এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ আদালতের আন্তর্জাতিক আইন সংবলিত আদেশ। জাতিসংঘের সনদে স্বাক্ষরকারী মিয়ানমার ও চীন উভয়েই এই আইন মানতে বাধ্য। তারপরও যদি ভেটো প্রয়োগ করেন তাহলে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গকারী হিসেবে চীন চিহ্নিত হবে। আগামী দিনের নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় নেতৃত্বের আসন প্রাপ্তির যে আকাক্সক্ষা চীনের রয়েছে সেই লক্ষ্য অর্জনের পথে এটা হবে চীনের জন্য স্ট্যাটেজিক্যাল মিসটেক বা চরম ভুল। চীনকে বুঝতে হবে বিশ্ব জনমত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। আগামী দিনের ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের সমীকরণে ভারত মহাসাগরে প্রবেশে এবং সংযোগ রক্ষা করার জন্য মালাক্কা প্রণালির বিকল্প হিসেবে মিয়ানমারের ওপর একচ্ছত্র প্রভাব প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্য রয়েছে তার জন্য চীনকে নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে। চীন আলোচ্য ইস্যুতে ভেটো প্রয়োগ করলে দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের মনে নতুন করে ভীতির সঞ্চার হবে। চীনকে মনে রাখতে হবে মিয়ানমার সরকার ও রোহিঙ্গা এই দুই সম্প্রদায়ের কারও পক্ষে বা বিপক্ষে না হয়েও বাংলাদেশ আজ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ সফরে এসে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঘোষণা দিয়েছিলেন চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক স্ট্র্যাটেজিক পর্যায়ে উন্নত হলো। সুতরাং আন্তর্জাতিক আদালতের আদেশ অনুসারে চীন আগামী দিনের বিশ্ব শক্তি হিসেবে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে সেটাই বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা। চীন বেঁকে বসলে আন্তর্জাতিক আদালতের আদেশ হয়তো কার্যকর হবে না। কিন্তু শেষ বিচারে পাঁচ-সাত বছর লাগলেও মিয়ানমার এবং তার সেনাবাহিনীর অভিযুক্ত জেনারেল ও কমান্ডাররা গণহত্যার দায় এড়াতে পারবে না। মিয়ানমারে এখনো প্রায় আরও ছয় লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। তারা যদি পুনরায় গণহত্যার শিকার হয় তাহলে সেটা হবে আন্তর্জাতিক আদালতের আদেশ ভঙ্গ করে পুনরায় গণহত্যা চালানোর আরেকটি উদাহরণ, যেমনটি ঘটেছিল ১৯৯৫ সালে বসনিয়ার মুসলমানদের বিরুদ্ধে, ঘটিয়েছিল সার্বিয়ার সেনাবাহিনী। ১৯৯৩ সালে আন্তর্জাতিক আদালত একই রকম আদেশ দিয়েছিল সার্বিয়ার বিরুদ্ধে। কিন্তু সার্বিয়া তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে স্রেব্রিনিসায় আট হাজার মুসলমানকে হত্যা করে। ভেটো ক্ষমতার অধিকারী রাশিয়া তখন সার্বিয়ার পক্ষ অবলম্বন করায় মিয়ানমারের মতো সার্বিয়া মনে করেছিল তাদের কিছুই হবে না। কিন্তু পাপে ছাড়ে না বাপেরে বলে বাংলা ভাষায় একটা কথা আছে। শেষ বিচারে স্রেব্রিনিসার গণহত্যার অপরাধে সার্বিয়ার সামরিক কমান্ডার রাদোভান কারাদজিস ও রাতকো ম্লাডিসসহ প্রায় তিন ডজনেরও অধিক সেনা ও বেসামরিক কর্মকর্তার শাস্তি নিশ্চিত করেছেন আন্তর্জাতিক আদালত, যদিও এর জন্য একটা দীর্ঘ সময় লেগেছে। অভিযুক্ত তখনকার সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট স্লাবোডান মিলোসেভিস গ্রেফতার হয়ে বিচার শেষ হওয়ার পূর্বে জেলের মধ্যে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন। সুতরাং মিয়ানমারের জেনারেলদের কপালেও সে রকমই ঘটবে, শুধু সময়ের অপেক্ষা। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি ফাতো বেনসুদা প্রি-ট্রায়াল আদালতের অনুমতি নিয়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার তদন্ত কাজ শুরু করেছেন। যুক্তরাজ্যের ১৮০ জন এমপি তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছেন যাতে ফাতো বেনসুদার তদন্ত কাজে সর্বপ্রকার সহযোগিতা প্রদান করা হয়। আইসিসি কর্তৃক গঠিত প্রি-ট্রায়াল চেম্বার বিচারকগণ মনে করেন- রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যাপকহারে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকতে পারে। জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি গত বছরই রোহিঙ্গা সংকট সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, জাতিগত নিধন সম্ভাব্য গণহত্যা এবং গণধর্ষণের আলামত তারা পেয়েছে। ফ্যাক্টর ফাইন্ডিং কমিটির প্রধান মারজুকি দারুসমান বলেছেন, মিয়ানমারে গণহত্যা চলমান। সুতরাং আন্তর্জাতিক আইন, আদালত, বিশ্বের সব মানবাধিকার সংগঠন ও সংস্থাসহ জাতিসংঘকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মিয়ানমার পার পেয়ে যাবে তা ভাবার কোনো কারণ নেই। মিয়ানমারকে অবশ্যই গণহত্যার দায় বহন করতে হবে।
লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।