আজ মার্চের শেষ দিন। ১৯৭১ সালে হানাদারদের আক্রমণে যেভাবে রক্তাক্ত হয়েছিলাম, করোনায় তার চেয়ে খুব একটা কম নয়। সারা বিশ্ব আজ করোনায় ক্ষতবিক্ষত। এর আগে কখনো কোনো রোগবালাইয়ে বিশ্ব এমন ক্ষতবিক্ষত হয়নি। ৭ লাখের ওপর আক্রান্ত। ৩৫ হাজার ইতিমধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছে। করোনায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ শঙ্কায় সারা দুনিয়ার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আকাশ-সড়ক-নৌ কোথাও কোনো গণপরিবহন নেই। দুনিয়া এমন বিচ্ছিন্ন আর কখনো হয়নি। কত রোগ এসেছে গেছে, কিন্তু করোনার মতো আর কখনো বিশ্ব এমন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়নি। এতসবের মধ্যে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক শ্রেষ্ঠ ঘটনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর চেয়ে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত আর কখনো কোনো দিন হবে না। বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য অনেক আন্দোলন হয়েছে, আইনি লড়াই হয়েছে কিন্তু কোনো কাজের কাজ হয়নি। এটা খুবই সত্য, যে অভিযোগে বেগম খালেদা জিয়াকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে সেটা সাধারণ মানুষ খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি। তবু বেগম খালেদা জিয়া জেলে ছিলেন। তাঁর দল তাঁকে মুক্ত করতে পারেনি। রাজনৈতিকভাবে এখন সে ক্ষমতাও বিএনপির নেই। যে যাই বলুন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে কোনোমতেই জেলে মরতে দেবেন না। তিনি জেলে মারা গেলে এক শ্রেষ্ঠ নেতার গৌরবে গৌরবান্বিত হবেন। বেগম খালেদা জিয়াকে সেই গৌরব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেবেন এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। সারা পৃথিবীতে করোনাভাইরাস এক অভিশাপ হলেও বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। আমার বিশ্বাস, আল্লাহর অশেষ রহমতে বাংলাদেশ করোনার হাত থেকে বেঁচে যাবে। ভাবতে হবে আগামী দিনের অর্থনীতি, গরিবের পেটের আহার আর শ্রমিকের খাবার নিয়ে। যা কিছুই হোক খালেদা জিয়ার মুক্তি বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক মাইলফলক। সরকার যতই বলুক, সবকিছু আইনের হাতে, আদালতের হাতে- তা কিন্তু নয়। আইন-আদালতের বাইরেও সরকারের হাতেও অনেক কিছু আছে বা থাকে। এ কাজটি মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে দিয়েও করানো যেত। তা করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী করেছেন। মানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়েছেন। এমন সিদ্ধান্তের জন্য সাহসের দরকার, বুকের পাটার দরকার। যেটা বঙ্গবন্ধুর ছিল। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনারও আছে। শেষ পর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক অভিনন্দন। এ সিদ্ধান্তের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা ইতিহাসের পাতায় হাজার বছর আলোচনায় থাকবে। মুক্তিযুদ্ধের পর বিভক্ত জাতিকে একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই একত্র করা সম্ভব ছিল। যা তিনি করেছিলেন। যাদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল না, তাদের তিনি সাধারণ ক্ষমা করেছিলেন। ওই সময় অমনটা করার আর কারও বুকের পাটা ছিল না।
এখন যেমন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া আর কারও নেই। খালেদা জিয়ার শাস্তি ছয় মাস স্থগিত করেছেন, ওটা ছয় বছর করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ছয় সেকেন্ডও লাগবে না। আমার বিশ্বাস, কোর্ট-কাচারিতে যতই ছোটাছুটি করতে হোক বেগম খালেদা জিয়াকে আর জেলে যেতে হবে না। এ সিদ্ধান্ত শেখ হাসিনাকে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তাঁর নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব সবকিছুকে ছাপিয়ে উঠেছে।
কাবার দরজা বন্ধ নিয়ে লিখেছিলাম। ওটা আমার লেখা ছিল না। ওটা ছিল আমার অন্তরের কান্না। একসময় কাবানির্ভর আরবে ব্যবসা-বাণিজ্য হতো। আবরাহা তার সাম্রাজ্যে কাবার চেয়ে সুন্দর মন্দির বানিয়েছিলেন। কিন্তু তা দর্শনে কেউ যাচ্ছিল না, সবাই কাবায় যাচ্ছিল। তখন তার মনে হয় যে উদ্দেশে তিনি মন্দির বানিয়েছেন কাবা থাকলে সে উদ্দেশ্য সফল হবে না। তাই কাবা ধ্বংস করতে হবে। সেজন্য তিনি কাবা আক্রমণ করেছিলেন। আবরাহা যখন মক্কা ঘিরে ফেলে লুটতরাজ করছিলেন তখন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাদা আবদুল মোত্তালিবের কিছু উট ও দুম্বা আবরাহার লোকেরা নিয়ে গিয়েছিল। আবদুল মোত্তালিব তখন কাবার খাদেম। তিনি যখন আবরাহার কাছে যান তখন আবরাহা ভেবেছিলেন কাবা রক্ষার জন্য কিছু বলবেন। কিন্তু আবদুল মোত্তালিব যখন শুধু তার উট ও দুম্বার কথা বলেন এবং উট ও দুম্বা নিয়ে ফিরে আসছিলেন তখন আবরাহা আবদুল মোত্তালিবকে বলেছিলেন, তোমার মতো গর্দভ-নির্বোধ আমি কখনো দেখিনি। আমি এসেছি কাবা ধ্বংস করতে তুমি কাবার তত্ত্বাবধায়ক হয়ে কাবা রক্ষায় একটি কথাও বললে না; তুমি এসেছো দুম্বা আর উট নিতে! তোমার মতো বেকুব আমি জীবনে দেখিনি। আবরাহার কথা শুনে আবদুল মোত্তালিব বলেছিলেন, উট ও দুম্বা আমার। ও দিয়ে সংসার চলে, পরিবার-পরিজনের খাওয়া-পরার সংস্থান হয়। তাই আমার জিনিস আমি নিতে এসেছি। কাবা আল্লাহর ঘর। সেটা রক্ষার দায়িত্ব আল্লাহর। তিনিই রক্ষা করবেন। আবরাহার হাতিগুলো কাবার দিকে এগোতে চাচ্ছিল না। ঝড়-তুফান এসে হাতিগুলোকে অন্ধ করে দিচ্ছিল। আল্লাহর কুদরতে বাবুই পাখির চেয়ে ছোট আবাবিল পাথর ছুড়ে আবরাহার হস্তিবাহিনীকে পরাজিত করেছিল। সেই কাবার দরজা বন্ধ। আল্লাহ কী করবেন তিনিই জানেন। যারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের কী হবে সে পরম দয়ালু আল্লাহই জানেন। আমার ভালো লাগেনি।
কদিন থেকে শুনছি, গুজবের ডালপালা গজাচ্ছে। যে পরিমাণ আক্রান্ত হয়েছে সরকার তা বলছে না। যে পরিমাণ মারা গেছে তাও লুকানো হচ্ছে। মনে হয় এসবই বাজে কথা। এখন এসব লুকানোর ক্ষমতা কারও নেই। সবকিছু ওপেন সিক্রেট। ইন্টারনেটের জমানায় মুহূর্তে এক জায়গার খবর আরেক জায়গায় চলে যায়। মোবাইল ফোনে ছবি তোলার সুযোগ থাকায় পথের কুটোও পথের ধুলোয় হারাতে পারে না। কারও না কারও চোখে পড়ে। সরকার এটা করছে ওটা করছে বলে কারও লাভ নেই। বরং এসব করে নিজের ক্ষতি। তাই গুজব ছড়িয়ে লাভ নেই। এখন আর কোনো গুজব গুজব নেই। কারণ কোনো কিছু লুকিয়ে রাখা যায় না। তাই সরকারের ক্ষতির চিন্তায় আমরা যেন নিজের ক্ষতি নিজে না করি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি- আল্লাহ যেন এই বালা-মুসিবত থেকে আমাদের মুক্তি দেন, অর্থনীতি সচল করেন। যার পেটে খাবার আছে তিনি ক্ষুধার জ্বালা বুঝতে পারবেন না। যাদের খাবার নেই তারাই বোঝে ক্ষুধার জ্বালা। তাই সরকারের উচিত বিত্তবানদের উচিত সাধারণ মানুষের, গরিব-দুঃখীদের ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়া। ছবি তোলার জন্য খাবার বিতরণ নয়, পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য এবার খাবার বিতরণ করা প্রয়োজন।
সরকারের কাছে বিনীত প্রার্থনা, সাধারণ মানুষের ওপর ঘরে থাকা নিয়ে আর বেশি জোরাজুরি করবেন না। জেলখানা নিয়ে ভাবুন। ৬০-৭০ বছরের বেশি বয়সী বন্দীদের সবাইকে মুক্তি দিন। সাধারণ অভিযোগে অভিযুক্তদের অনতিবিলম্বে জামিন দিয়ে বাড়িতে কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়ে দিন। যাতে করোনা ছড়ানোর কোনো সুযোগ না থাকে। যেখানে খালেদা জিয়ার মতো একজন বিরোধী নেতাকে মুক্তি দিয়ে এক শ্রেষ্ঠ উদাহরণ সৃষ্টি করা যেতে পারে সেখানে অতিসাধারণ কয়েদিদের বা বন্দীদের মুক্তি দেওয়ায় কোনো অসুবিধা আছে বলে মনে হয় না। ব্যাপারটা গভীরভাবে ভেবে দেখতে বলছি।
২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে আশা করেছিলাম, তিনি দলমতনির্বিশেষে সবার সাহায্য চাইবেন। কেন যেন তেমনটা হয়নি। সাধারণ মানুষ কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। দলমতের পার্থক্য থাকলেও কেউ তাঁকে বিব্রত করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করছে না। সরকারি দলের অনেকেই সবাইকে একমত একপথ হয়ে সহযোগিতার আহ্বান জানাচ্ছেন। অন্য নেতাদের আহ্বান আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান এক কথা নয়। দেশের আপামর জনসাধারণ তাঁর আহ্বান আশা করলেও হয়তো সময় হয়নি বলে তিনি সবার সাহায্য কামনা করেননি, উপযুক্ত সময়ে করবেন, হতেও পারে। তবে আন্তরিকভাবে সব দলমত ও দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন কামনা করা উচিত। সময়ই বলে দেবে কখন তিনি তা করবেন।
লেখক : রাজনীতিক।
www.ksjleague.com