বুধবার, ৮ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

উপকূল অঞ্চলের পতিত জমিতে ফসল উৎপাদন

ড. এম জি নিয়োগী

১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটারসমৃদ্ধ বাংলাদেশের ৪৭ হাজার ২১১ বর্গকিলোমিটারই সমুদ্র উপকূল অঞ্চল। অর্থাৎ বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৩ ভাগের ১ ভাগই উপকূল অঞ্চল। আর এ উপকূল অঞ্চলের ৫৩ ভাগ জমিই লবণাক্ত এবং এসব জমির লবণাক্ততার মাত্রা শুষ্ক মৌসুমে ক্রমেই বাড়তে থাকে।

ক্রমান্বয়ে লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে শুষ্ক মৌসুমে ৮ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর জমি পতিত থাকছে। সে কারণে এ অঞ্চলের কৃষক শুধু বৃষ্টির মৌসুমে আমন ধান চাষ করছে। বছরের বাকি সময় বেশির ভাগ জমিতেই কৃষক কোনো ফসল চাষাবাদ করতে পারছে না।

শুষ্ক মৌসুমে পতিত জমিতে কাক্সিক্ষত মানের ফসল ফলানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশের কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বেশকিছু গবেষণা কার্যক্রম বাস্তবায়ন  করছে। পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়া সরকারের আন্তর্জাতিক কৃষি গবেষণা সংস্থা অস্ট্রেলিয়ান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ এবং বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের যৌথ অর্থায়নে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশের গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, এগ্রেরিয়ান রিসার্চ ফাউন্ডেশন, অস্ট্রেলিয়াস্থ ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিএসআইআরওর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বেশকিছুু গবেষণা কার্যক্রম খুলনা ও বরিশাল বিভাগের বিস্তীর্ণ উপকূল অঞ্চলে বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা  লবণাক্ত ও প্রতিকূলতা সহিষ্ণু গম ও ডাল ফসল উদ্ভাবনে গবেষণা করছেন, যা উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষক পরিবার শুষ্ক মৌসুমে তাদের পতিত জমিতে চাষাবাদ করে পরিবারের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় অবদান রাখতে পারবে।

উপকূল অঞ্চল বিশেষ করে পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলাসহ বরিশাল অঞ্চলে প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার হেক্টর জমিতে মুগ চাষ হচ্ছে। কৃষক আমন ধান কাটার পরে জমি চাষ করে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে মুগের বীজ বপন করছে। কিন্তু কাক্সিক্ষত ফলন পাচ্ছে না।

গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু সিডার মেশিনের সাহায্যে বীজ বপন করলে মুগ ডালের উৎপাদন খরচ প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে আসে, অন্যদিকে ফলন ৩০-৪০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। সিডার মেশিনে একই সঙ্গে জমি চাষ, লাইনে বীজ বপন ও বীজ মাটিতে সমান গভীরতায় বপন হয়ে যায়। ফলে গাছ সমান ও সতেজভাবে বেড়ে ওঠে। লাইনে বোনার কারণে আগাছা পরিষ্কার করতে সুবিধা হয়। এতে গাছে পোকামাকড় কম লাগে। লাইনে বোনার কারণে সারের সর্বোচ্চ ব্যবহারও নিশ্চিত হয় এবং জমিতে পরিমিত পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার করা যায়। দক্ষিণাঞ্চলে জানুয়ারির মধ্যে মুগের বীজ বপন করতে পারলে এপ্রিল-মে মাসে জমিতে সর্বোচ্চ লবণাক্ততা আসার আগেই কৃষক মুগ তুলতে সক্ষম হবে। তা ছাড়া জানুয়ারিতে লাগানোর কারণে এপ্রিল-মে মাসে ঝড়বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগেই কৃষক ফসল ঘরে তুলতে পারবে।

উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষক পরিবারের কাছে ফেলন ডাল (কাউপি) অত্যন্ত জনপ্রিয় ও পুষ্টিসমৃদ্ধ। গবেষণায় দেখা গেছে, ফেলন গাছ ঝোপালো হয় বিধায় ফেলনের জমিতে আর্দ্রতা থাকে এবং এর শিকড় অপেক্ষাকৃত বেশি গভীরতায় যেতে পারে বিধায় ফসলটি খরাসহিষ্ণু।

অস্ট্রেলিয়া ও কেজিএফএর এ প্রকল্পের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা থেকে ৩৪৫টি কাউপি ডালের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করে বরিশাল আরএআরএস ক্যাম্পাসে গত তিন বছর ধরে গবেষণা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই কয়েকটি জাত লবণাক্তসহিষ্ণু ও উচ্চফলনশীল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আশা করছি, এ প্রকল্প অচিরেই লবণাক্তসহিষ্ণু, উচ্চফলনশীল, পুষ্টিসমৃদ্ধ ফেলন ডালের জাত উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষককে দিতে সক্ষম হবে।

শুষ্ক মৌসুমে দক্ষিণাঞ্চলের পতিত জমিতে কাক্সিক্ষত মানের গম উৎপাদনের লক্ষ্যে ২০১৭ সাল থেকে এ প্রকল্পের আওতায় অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় গবেষণা সংস্থা সিএসআইআরও এবং বাংলাদেশের গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট ব্যাপক র্কাযক্রম বাস্তবায়ন করছে।

গমের দেশি-বিদেশি ২৪টি জেনোটাইপ নিয়ে বিস্তীর্ণ উপকূলের বিভিন্ন লবণাক্ত অঞ্চলে কৃষকের মাঠে কৃষকের অংশগ্রহণে গবেষণা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মূল উদ্দেশ্য, লবণাক্ত ও প্রতিকূলতা সহিষ্ণু গমের জাত চিহ্নিত করা। ২০১৭-১৮ সালে দুই দেশের গবেষণাতেই লবণাক্তসহিষ্ণুতা ও উচ্চফলনশীলতার দিক থেকে BAW1147, BAW1290  এবং KRL19 এ তিনটি জেনোটাইপকে লবণাক্ত ও প্রতিকূলতা সহিষ্ণু হিসেবে প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয়। এর মধ্যে প্রথম দুটি জেনোটাইপ বাংলাদেশের ও পরেরটি ভারতের।

প্রথম বছরে অত্যন্ত ইতিবাচক গবেষণার ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় বছরে আরও বেশি লবণাক্তপ্রবণ অঞ্চলে এ গবেষণার কার্যক্রম বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। সেজন্য ২০১৮-১৯ সালে ডুমুরিয়া ও বটিয়াঘাটার পরিবর্তে দাকোপ ও কয়রায় এ গবেষণা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়।

দাকোপ ও কয়রা অঞ্চল দুটি অন্যান্য উপকূল অঞ্চলের তুলনায় বেশি লবণাক্তপ্রবণ হওয়ায় বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা এ এলাকা দুটির গবেষণার ফলাফলের বিষয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন। ২০১৯ সালের ৬ ও ৭ মার্চ এ দুই এলাকাতেই অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা গবেষণা কার্যক্রম সরেজমিনে দেখেছেন এবং অত্যন্ত ইতিবাচক ফল প্রত্যক্ষ করেন। এ বছর ২০২০ সালে ১১ ও ১২ মার্চ দুই এলাকাতেই অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা গবেষণা কার্যক্রম সরেজমিনে দেখেছেন এবং আবারও অত্যন্ত ইতিবাচক ফল প্রত্যক্ষ করেন। বিজ্ঞানীরা স্থানীয় কৃষকের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনাকালে তারা মনে করেন এ অঞ্চলের কৃষক আমন ধান কাটার পর অনায়াসে এ প্রযুক্তিতে গম চাষ করে ভালো ফসল ঘরে তুলতে পারবেন।

গত তিন বছরের গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট  BAW1147 জাতটিকে  চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছে। গমের এ জাতটি বীজ বপনের সময় ৮ ডিএস/মিটার এবং ফুল ফোটার সময় ১২ ডিএস/মিটার পর্যন্ত লবণাক্তসহিষ্ণু বলে প্রতীয়মান হচ্ছে, যার লবণাক্তসহিষ্ণুতা বারি গম ২৫-এর চেয়ে বেশি।

সে কারণে দাকোপ, কয়রা, সাতক্ষীরার মতো লবণাক্ত অঞ্চলেও জাতটি চাষাবাদ করে কাক্সিক্ষত ফলন ঘরে তোলা যেতে পারে। ভালো ফলনের জন্য নভেম্বরে বীজ বপন উত্তম। তবে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বপনেও ভালো ফলন আশা করা যায়। এ জাতের গমের দানা আকারে বড়। ১০০০ গমের ওজন ৫৫-৬০ গ্রাম। অন্যান্য গমের তুলনায় শীষ বড় হয়। জীবনকাল ১০০-১০৫ দিন। দুবার হালকা সেচ দিতে পারলে দক্ষিণাঞ্চলের মতো জায়গায়ও হেক্টরপ্রতি ৪ টন ফলন পাওয়া যাবে।

দক্ষিণাঞ্চলে যেখানে সেচযোগ্য পানি নেই সেখানে গমে সেচ দেওয়ার জন্য মোট জমির মাত্র ৫ ভাগ জমি, ৫ ফুট গভীরতায় গর্ত করে মোটা পলিথিন বিছিয়ে দিয়ে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে জমিতে সেচ দেওয়া যেতে পারে। গমের জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য এ পরিমাণ পানিই যথেষ্ট।

১২ মার্চ, ২০২০ সালে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক খুলনার লবণাক্ত অঞ্চল দাকোপ গিয়েছিলেন। সেখানে হাজার হাজার হেক্টর পতিত জমি দেখলেন। লবণাক্ততার কারণে শুষ্ক মৌসুমে এখানে কোনো ধরনের ফসল হয় না।

দাকোপের এ রকম একটি লবণাক্ত অঞ্চল তিলডাঙ্গা গ্রাম। উপকূলের বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক গ্রামের মতো এ গ্রামেও তিন বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ার এসিআইএআর ও বাংলাদেশের কেজিএফের অর্থায়নে অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা স্থানীয় কৃষককে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ফসলের লবণাক্ত ও প্রতিকূলতা সহিষ্ণু জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা করছেন। গবেষণায় ইতিমধ্যে বেশকিছু ফসলের আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া যাচ্ছে। কম উৎপাদন খরচে এসব উদ্ভাবিত প্রযুক্তি স্থানীয় কৃষকের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। মাননীয় মন্ত্রী লবণাক্ত জমিতে কম খরচে বিনা চাষে আলু উৎপাদন দেখলেন। লবণাক্তসহিষ্ণুু নতুন জাতের গম উৎপাদন দেখলেন, যার ফলন উত্তরাঞ্চলের গমের তুলনায় কোনো অংশেই কম নয় বলে মন্তব্য করলেন।

লবণাক্ত জমিতে তিনি সূর্যমুখীর সফল চাষাবাদ প্রত্যক্ষ করলেন। অত্যন্ত আকর্ষণীয় ভুট্টা চাষ দেখলেন। লবণাক্ত জমিতে বিশাল এলাকায় মুগ ডালের চাষ দেখলেন। সবুজ পালংশাক দেখে মুগ্ধ হলেন। এ ছাড়া লবণাক্ত জমিতে কম উৎপাদন খরচে আরও অনেক ফসলের অত্যন্ত আকর্ষণীয় উৎপাদনের সাক্ষী হয়ে রইলেন। স্থানীয় কৃষক নেতৃবৃন্দ মনে করেন, লবণাক্তপ্রবণ অঞ্চলে এ ধরনের প্রযুক্তি ছড়িয়ে দিতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। বড় বড় ব্লক তৈরি করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সহায়তায় এ প্রযুক্তিতে ফসল চাষাবাদ করলে এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার স্থায়ী উন্নয়ন হবে। স্থানীয় কৃষক মনে করেন, গত কয়েক বছরের আগাম বৃষ্টি তারা দেখছেন, যা গমসহ বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদে সহায়ক। এই আগাম বৃষ্টি কাজে লাগিয়ে সহজেই ও কম খরচে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে শুষ্ক মৌসুমে পতিত জমিতে বিভিন্ন ফসল চাষ করে একটি বাড়তি ফসল ঘরে তুলতে পারবেন। প্র্রয়োজনে ACIAR এবং KGF প্রযুক্তি সহায়তার হাত বাড়াতে পারে।

 

                লেখক : লেডপুটি প্রজেক্ট লিডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া।

সর্বশেষ খবর