বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

নতুন জীবন

তসলিমা নাসরিন

নতুন জীবন

ঘরবন্দী জীবন আমার কাছে নতুন নয়। মেয়ে হয়ে জন্মেছি এই অপরাধে ইস্কুল কলেজের বাইরে পুরোটা কৈশোরজুড়ে ঘরবন্দী জীবনই তো কাটাতে হয়েছে। যৌবনেই বা কতটুকু আর স্বাধীনতা পেয়েছি। বাইরে যৌন হেনস্তা, অপহরণ, ধর্ষণ ওত পেতে আছে বলে ঘর থেকে বেরোতে পারিনি। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আমার লেখালেখিতে ধর্মের সমালোচনা ছিল বলে মৌলবাদীরা ফাঁসির দাবিতে মিছিল করতো। বইমেলায় শারীরিক আক্রমণ করতো। ওদিকে একের পর এক ফতোয়াও জারি হলো। মুন্ডু কেটে নিতে পারলে লাখ টাকা উপহার। তখনও বাধ্য হয়েছি ঘরবন্দী জীবন কাটাতে। সরকার একসময় মামলা করলো, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলো। তখনও আত্মগোপন করতে গিয়ে আবারও ঘরবন্দী জীবন। নির্বাসন জীবন শুরু হলো ইউরোপে। সেখানেও নিরাপত্তারক্ষীরা আমাকে ঘরবন্দী জীবন দিয়েছিল। বিদেশ ফেলে যখন ভাষার টানে কলকাতায় ঠাঁই নিয়েছি, সেখানেও একের পর এক ফতোয়া। একসময় সিপিএম সরকার আমাকে রাজ্য ছাড়ার জন্য চাপ দিতে থাকে। কথা শুনিনি বলে আমাকে গৃহবন্দিত্ব উপহার দিল। আহারে সেইসব কষ্টের যন্ত্রণার দিনগুলি! কয়েক মাস ঘরবন্দী করে রাখার পর রাজ্য ছাড়তে শেষ অবধি বাধ্যই করলো। দিল্লিতেও কেন্দ্রীয় সরকার একই কাজ করেছিল, হয় ভারত ছাড়ো নয়তো ঘরবন্দী থাকো, বাইরে বলা হয়েছিল ‘সেইফ হাউজে’ আছি। সেখানেও কেটেছে আরও কয়েকটি মাস।

এ কারণেই সম্ভবত একা একা একটি বাড়িতে দিন রাত পড়ে থাকা, বাইরের আলো হাওয়ার স্পর্শ না পাওয়া আমার কাছে খুব কিছু অস্বাভাবিক অসম্ভব নয়। বীন দেয়ার, ডান দ্যাটের মতো। টেনশন তখনও ছিল, এখনও আছে। পরাধীনতার ক্ষোভ ছিল, ফণা তুলে থাকা মৃত্যু ছিল চোখের সামনে। প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও অনুভূতিগুলো প্রায় একই। বাইরে বেরোলে ধর্ষকেরা, গ্রেফতারি পরোয়ানা হাতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগা পুলিশেরা, মুন্ডু কাটায় আগ্রহী অর্থলোভী ধার্মিকেরা, ফাঁসির দাবিতে চিৎকার করা ধর্মান্ধ, আদর্শচ্যুত দূরদৃষ্টিহীন রাজনীতিক সবাই আমাকে খুন করবে, ঠিক এখন যেমন ইমিউনিটি না থাকা শরীরটি বাগে পেলে করোনাভাইরাস আমাকে গলা টিপে হত্যা করবে।

ভাইরাসকে কি দরজা বন্ধ করে রাখলেই ঠেকানো যায়! ফাঁকফোকর দিয়ে কোনওদিন হয়তো ঢুকে যাবে, সাপ যেমন ঢুকে গিয়েছিল লখিন্দরের লোহার ঘরে। তবে যথাসম্ভব সতর্কই থাকতে চাই। চাই কারণ বিশ্বাস করি জীবন একবারই আসে, আর মৃত্যুতেই এই জীবনের সমাপ্তি, তাই এই জীবন বড় মূল্যবান। ধর্ম বিশ্বাসীরা পরকালে বিশ্বাস করে, তাদের কাছে পরকালের জীবনটি মূল্যবান, এই জীবনটির ইতিতে তাই তারা তত কাতর হয় না।

জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছি আমরা সবাই। এ যাত্রা যদি বেঁচেও যাই, করোনা-পরবর্তী পৃথিবী আমাদের আগের পৃথিবীর মতো যদি না-ও হয়, তবুও যেন শেষ বিদায়ের আগে অন্তত বন্ধুদের হাত স্পর্শ করার, স্বজনকে আলিঙ্গন করার স্বাধীনতা পাই।

এ নতুন জীবন আমাদের। করোনা-জীবন অথবা করোনা-পরবর্তী জীবন কিন্তু করোনা-পূর্ববর্তী জীবনের মতো হবে না। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বলেছেন সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং আমাদের মেনে চলতে হবে ২০২২ পর্যন্ত। আমার তো মনে হয় আরও অনেক বছর পর্যন্ত মেনে চলতে হবে। মাস্ক আর গ্লাভস পরে কিন্তু বাইরে বেরোতে হবে, সম্ভবত আরও অনেক বছর। অনেক বছর পর কি স্বাভাবিক হবে পৃথিবী? স্বাভাবিকের সংজ্ঞা হয়তো পাল্টে যাবে। নতুন একটি সদা সতর্ক জীবনই হয়তো ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। শুনছি ঘরের কাজকর্ম করার জন্য রোবট তৈরি হচ্ছে। মানুষের চেয়ে মানুষ হয়তো রোবটকেই বিশ্বাস করবে বেশি। আমরা কিছুই আসলে জানি না কী হতে যাচ্ছে পৃথিবীতে। কেবল অনুমান করতে পারি।

মাঝে মাঝে ভাবি অতটা হয়তো খারাপ নয় অবস্থা। সাবান দিয়ে ধুলেই হাত থেকে বা জিনিসপত্র থেকে ভাইরাস চলে যাচ্ছে। নিঃশ্বাসের সবটুকু বাতাসে ভাইরাস ভাসছে না। এখনও শুদ্ধ বাতাস পেতে পারি। এমন ভাইরাসও তো আসতে পারতো যে ভাইরাস সাবান দিয়ে ধুলেও হাত থেকে যেতো না, বাতাসে সারাক্ষণই ভেসে বেড়াতো, শ্বাস নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুসফুসে ঢুকে গিয়ে ফুসফুস ঝাঁজরা করে দিত, আসতে তো পারতো, পারতো না? এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষ জয়ী হতে পারবে না, এ আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। আমেরিকা কী করে এবোলা ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জিতেছে দেখেছি। যে মহাশক্তিমান আমেরিকার আজ পৃথিবীকে ভাইরাসের কবল থেকে রক্ষা করার কথা, সেই আমেরিকা আজ পৃথিবী তো দূরের কথা, নিজেকেই রক্ষা করতে পারছে না। এই অসহায় আমেরিকাও এক নতুন আমেরিকা।

মহামারীর সময় যা হওয়া উচিত তা হচ্ছে না কোথাও। চারদিকে দেখছি হিংসে আর ঘৃণা বাড়ছে। ভাইরাসের সংক্রমণের জন্য হিন্দুরা মুসলমানদের দোষ দিচ্ছে, মুসলমানরা ইহুদিদের দোষ দিচ্ছে, আমেরিকা চীনকে দোষ দিচ্ছে, চীন আমেরিকাকে দোষ দিচ্ছে। দোষ দেওয়ার সময় এখন নয়। বিভেদ বিচ্ছেদের সময় এখন নয়। এখন এই দুর্যোগে সব দেশকে এগিয়ে আসতে হবে, পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হবে, এই ভয়ঙ্কর ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হওয়া কোনও দেশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। আমেরিকা আগে যেমন একাই দাঁড়াতে পারতো, এখন তা আর পারছে না। চীন পেরেছে, অনেকে বলে চীন পেরেছে চীনে গণতন্ত্র নেই বলে। সরকারের আদেশ মৃত্যুভয়ে সকলে মানতে বাধ্য। তাই লকডাউন কোয়ারেন্টাইন ইত্যাদি একশভাগ কাজ করেছে। কিন্তু গণতান্ত্রিক কিছু দেশও- দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, নিউজিল্যান্ডও তো ভাইরাস থেকে নিজেকে মুক্ত করেছে। সকলে এক জোট হয়ে যদি এই ভাইরাসের কবল থেকে মানুষকে মুক্ত না করে, তবে আরও লক্ষ, আরও কোটি মানুষকে জীবন দিতে হবে। রাজনীতিকরা অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে চিন্তিত, অর্থনীতি ভেঙে গেলে তাদের ক্ষমতায় থাকা মুশকিল হবে। মানুষ মরছে মরুক, এতে বেশ কিছু রাজনীতিকের কিছু যায় আসে না। বিজ্ঞানীরা জীবন বাঁচাতে চাইছেন। দিন-রাত ভ্যাকসিন আবিষ্কার করার জন্য পরিশ্রম করছেন। দিন-রাত পরিশ্রম করছেন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ী হওয়া মানুষের শরীরের এন্টিবডি পরীক্ষা করতে, এই এন্টিবডি দিয়ে অন্যদের সুস্থ করার প্রক্রিয়া আবিষ্কার করতে। ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আগে এই এন্টিবডিই হয়তো ভাইরাস ঠেকানোর জন্য বড় কোনও ভরসা হতে পারে। না কোনও ধর্মযাজক নয়, কোনও মৌলবী নয়, কোনও পুরোহিত নয়, বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন মৃত্যু রোধ করতে, তাদের হাতেই আছে মানুষকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা।

আলটিমেটলি কী হবে? এটুকু তো ধারণা করাই যায় ভ্যাকসিন যদি ঠিক সময়মতো হাতে না আসে, তাহলে যাদের ইমিউনিটি কম, তারা মরে যাবে, যাদের বেশি তারা বেঁচে যাবে। আমরা কিন্তু জানি অনেক মাথামোটা লোকদের ইমিউনিটি চমৎকার। তাহলে কি মাথামোটা লোকদের হাতেই চলে যাবে পৃথিবী? হতে পারে। তবে আমি মনে করি মাথামোটাদের ভিড়েও কিছু বুদ্ধিমান এবং বিচক্ষণ লোক থাকে, তারাই ভালো কাজগুলো করে। এ চিরকালেরই চিত্র। অধিকাংশ লোক কখনও প্রগতির বা আধুনিকতার পক্ষে নয়, তারা চিরকালই জরাজীর্ণ আঁকড়ে ধরে থাকার পক্ষে।

নতুন যে পৃথিবী আসছে তাতে আমি বিশ্বাস করি মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানমনস্ক হবে, ধর্মকে ব্যবহার করে জনগণকে ধোঁকা দেওয়া রাজনীতিকদের পক্ষে আর সম্ভব হবে না, সাধারণ মানুষ সাই বাবা, পীর বাবা ইত্যাদির পেছনে দৌড়োনো বন্ধ করবে। মাথামোটা মানুষের ভিতরেও পরিবর্তন আসবে। সোজা কথা এখনকার মানুষের চেয়ে স্মার্ট হবে নতুন পৃথিবীর মানুষ। আমরা অনেকেই সেই পৃথিবীকে হয়তো দেখে যেতে পারব না, কিন্তু শুভ কামনা রয়ে যাবে।

                লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর