মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

ত্রাণ বিতরণে সেবার ব্রত চাই

সালাহউদ্দিন নাগরী

পৃথিবীর মানুষ করোনা আতঙ্কে দিশাহারা। জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিকিৎসায় উন্নত দেশগুলো তাদের সর্বোচ্চ মেধা-মনন প্রয়োগ করেও এ ভাইরাসের মোকাবিলায় তেমন কোনো অগ্রগতি ঘটাতে পারছে না। প্রতিনিয়ত এ রোগের বিস্তার জ্যামিতিকহারে বাড়ছে, ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মৃতের রেজিস্টার দীর্ঘ হচ্ছে। মানুষের সংস্পর্শে একজনের কাছ থেকে আরেকজন সংক্রমিত হচ্ছে এ রোগে। যেহেতু এর নেই কোনো চিকিৎসা, তাই সংক্রমণ ঠেকাতে সবাইকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বিশে^র বিশেষজ্ঞরা তাগিদ দিয়ে চলেছেন। পৃথিবীর প্রায় সব দেশের সব ধরনের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সবাইকে ঘরে থাকার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে পুরো পৃথিবীতে কার্যত অচলাবস্থা বিরাজ করছে। যারা দিন আনে দিন খায়, এ ধরনের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এখন কাজ নেই, কামাই নেই। স্ত্রী-সন্তানদের মুখে অন্ন তুলে দিতে পারছেন না। ঢাকা শহরে ১১ লাখ রিকশার দুই শিফটে চালক প্রায় ২২ লাখ। এ শহরে প্রায় ৪ হাজার বস্তিতে বসবাসকারীর সংখ্যা ৮ লাখ। শিল্পকারকানায় কর্মরত শ্রমিক কয়েক কোটি। এদের জীবন ধারণ যেহেতু কঠিন হয়ে উঠেছে তাই, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী, পেশাজীবী সংগঠন ও সুহৃদ ব্যক্তিরা এদের খাবার জোগাতে এগিয়ে এসেছেন। আমাদের দেশের এসব হৃদয়বান ব্যক্তিকে আল্লাহ যেমন সামর্থ্য দিয়েছেন, তেমনি দরিদ্রদের সাহায্য-সহযোগিতা ও কষ্ট লাঘবে এগিয়ে আসার মনমানসিকতাও দিয়েছেন। সেদিন পত্রিকায় দেখলাম এক বৃদ্ধ তিন দিন ধরে শুধু পানি খেয়েই থেকেছেন। আরেক বৃদ্ধা বাসি ভাত রোদে শুকাচ্ছেন, যাতে পরে ওগুলো সিদ্ধ করে খেতে পারেন। এসব দৃশ্য প্রশাসনের নজরে আসায় তাদের বাসায় খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।  যাই হোক, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাহায্য-সহযোগিতায় অনেক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে। কোথাও কোথাও ওইসব মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। কোথাও আবার নির্ধারিত কোনো জায়গায় গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিয়ে আসতে হচ্ছে। কিন্তু এ কার্যক্রমে অসহায়ের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ অপেক্ষা ব্যক্তিগত প্রচার-প্রচারণা অনেক ক্ষেত্রে মুখ্য উঠছে। যা আমাদের এ মহৎ উদ্দেশ্যকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। একটি ছবিতে দেখলাম, ত্রাণের প্যাকেট দেওয়ার সময় ১৪ জন মিলে এক দুস্থকে ঘিরে সবাই সে প্যাকেটটিতে হাত ছোঁয়ানোর জন্য প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। মোবাইল ক্যামেরা ক্লিক করে উঠছে। ফেসবুকে পোস্ট আসছে, আজকে ‘অমুক’ এলাকায় এতজনের মাঝে ‘অমুক’-এর পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হলো! ত্রাণপ্রাপ্ত ব্যক্তির তৃপ্তি বা ‘ফ্যালফ্যাল’ করে তাকানো ছবি তার স্ত্রী/স্বামী, সন্তান-সন্ততি, আমার, আপনার সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে। আমরাও ছবিগুলো দেখছি, পুলকিত হচ্ছি। হয়তো নিজেকেও এ কাজে সম্পৃক্ত করার জন্য উৎসাহবোধ করছি। কিন্তু যে ব্যক্তিটি অন্তত পরিবারের সদস্যদের কাছে ত্রাণ নেওয়ার বিষয়টি আড়ালে-আবডালে রাখতে চেয়েছিলেন তা আর হলো না। ত্রাণ নেওয়া ব্যক্তিটিরও পরিবার আছে, সমাজ আছে। সবাই জানল ‘অমুক’ ত্রাণ নিয়েছে, এটি অপমানের কিনা জানি না, কিন্তু সুখকর কোনো বিষয় নয়। মানুষ বাধ্য হয়ে অন্যের কাছে হাত পাতলেও প্রকৃতপক্ষে অনুগ্রহের জীবন নির্বাহকে যন্ত্রণার বিষয় বলেই মনে করেন।  তার পরও আমরা সেটাই করছি, ফলাও করে গরিব-দুঃখীর ছবি পত্রপত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুধু নিজের প্রচার-প্রচারণার জন্য ছড়িয়ে দিচ্ছি। কয়েক দিন আগের ঢাকার একটি ঘটনা, একটি পরিবারের স্বামী-স্ত্রী দুজনই ছোটখাটো কাজ করে সন্তান-সন্ততি নিয়ে দিন পার করতেন। তাদের সব শ্রম, প্রচেষ্টা শুধু সন্তান তিনটিকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার জন্য। বড় মেয়েটি কলেজে পড়েন। করোনার প্রকোপে সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওই ভদ্রলোকটি কাজহীন হয়ে গেছেন, কোথায় জানি লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রাণের চাল-ডাল সংগ্রহ করেছিলেন, যাই হোক সেই ব্যক্তির ত্রাণ নেওয়ার ছবি কেউ একজন ফেসবুকে আপলোড করলে, তার কলেজপড়–য়া মেয়ের পরিচিত কেউ তাকে তার বাবার ত্রাণ নেওয়ার কথাটি জানান। পরে মেয়েটিও ছবিটি দেখেন। মেয়েটি বলেন, ‘আমার বাবা ত্রাণের চাল-ডাল নিয়ে এসেছেন আমাদের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার জন্য, হয়তো পরিবারের কাছে সম্মান রক্ষার্থে বিষয়টি তিনি আমাদের জানাননি, আমার বাবাটিকে পরিবার ও সন্তান-সন্ততির সামনে কেন লজ্জায় ফেলা হলো? বিষয়টি সুধীজনদের বিবেচনায় ছেড়ে দিচ্ছি।’

পত্রিকায় একটি খবর দেখেছিলাম কিছুদিন আগে ভারতের কোনো এক পরিবারের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে খুবই ভালো রেজাল্ট করে, চারদিকে ওদের অনেক সুনাম। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবাই ওদের সমীহ করে। ওদের বাবা কোনো দিন জানতে দেননি তিনি দিনমজুরের কাজ করেন, পাছে তারা বন্ধুবান্ধবের কাছে ছোট না হয়ে যায়। প্রতিদিন তিনি কাক-ভোরে তাদের এলাকা থেকে অনেক দূরে চলে যেতেন কাজ করতে, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতে ফিরতেন বাসায়, সন্তানরা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি তাদের বাবার পেশা। আমাদের সমাজে মানুষের মর্যাদা নির্ধারিত হয় তার পেশা ও অর্থকড়ি দিয়ে। সব পেশা, কাজ এখনো স্বীকৃতি পায়নি। সন্তানের কাছে তার বাবা-মায়ের মর্যাদা অনেক ওপরে, বাবার পেশা, কার্যক্রমের কারণে সন্তানের মাথা নিচু হোক- কোনো বাবা-মা তা চান না। আল কোরআনের সূরা বাকারার ২৭১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান কর তবে তাও উত্তম, আর যদি তোমরা তা গোপনে কর এবং তা অভাবগ্রস্তদের দান কর, তবে তা তোমাদের জন্য আরও উত্তম।’ আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন আল্লাহর ছায়া ছাড়া কোনো ছায়া থাকবে না তখন আল্লাহ সাত শ্রেণির লোককে তার (আরশের) ছায়াদান করবেন। এর এক শ্রেণি হলো- যারা এত গোপনে সাদাকাহ বা দান করে যে, ডান হাত যা দান করে বাঁ হাত তা টের পায় না।’ টিভি চ্যানেল, পত্রপত্রিকায় ত্রাণ নেওয়ার ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা যাচ্ছে না। তাই ত্রাণ দেওয়া ও নেওয়ার সময় অবশ্যই সতর্কতার সঙ্গে এ কাজটি সম্পন্ন করতে হবে।

এভাবে কত দিন চলবে তাও বোঝা যাচ্ছে না। তাই আমাদের শ্রমজীবী মানুষকে দীর্ঘমেয়াদি সাহায্য-সহযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। পদ্ধতিগতভাবে এলাকাভিত্তিক সুনির্দিষ্ট তালিকা প্রস্তুত করতে হবে। যেন একজন মানুষকেও এক বেলা না খেয়ে থাকতে না হয়। সাহায্য-সহযোগিতা, ত্রাণ দেওয়ার ছবি এত ফলাও করে প্রচারের দরকার নেই। তাদের আত্মসম্মান ও মর্যাদা সমুন্নত রেখে ত্রাণ বিতরণ করতে হবে। সরকার তাদের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য ব্যাপক অর্থ বরাদ্দ করছে। বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠীও এগিয়ে এসেছে। আমরা লড়াকু জাতি, করোনার এ দুর্যোগে অসহায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে দুই বেলা অন্নের সংস্থানে আমরা সফলকাম হব ইনশা-আল্লাহ।

লেখক : কলামিস্ট।

[email protected]

সর্বশেষ খবর