মঙ্গলবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

গণতন্ত্র আমলাতন্ত্র দর্জিতন্ত্র

সৈয়দ বোরহান কবীর

গণতন্ত্র আমলাতন্ত্র দর্জিতন্ত্র

বাংলাদেশে এখন কোন পদ্ধতির শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান, তা নিয়ে আজকাল প্রায়ই দ্বন্দ্বে পড়ি। বিশেষ করে, এই করোনাকালে ঘরবন্দী থেকে এই প্রশ্ন পোকার মতো মস্তিষ্কে কিলবিল করে। একদিকে আমলা এবং সচিবরা দেশের সর্বেসর্বা হয়ে করোনা মোকাবিলার দায়িত্ব পেয়েছেন। অন্যদিকে গার্মেন্ট মালিকরা যে কোনো প্রকারে কারখানা খোলার প্রচেষ্টায় সফল হয়ে প্রমাণ করেছেন, তারাই আসলে ক্ষমতাবান। আর রাস্তাঘাটে এখন অভুক্ত মানুষের বসে থাকা। গাড়ি দেখলে তাদের ছুটে আসা, একটু খাবারের জন্য হাহাকার দেশে। প্রশ্ন জাগে, এরাই তো জনগণ, প্রজাতন্ত্রের মালিক অথচ এই রাষ্ট্রে তাদের অধিকার কোথায়?

করোনাকালে নানামুখী সংকট এবং সমস্যা নিয়ে আলোচনা চলছে। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কি ভেঙে পড়েছে? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কীভাবে দুই মাস ঘুমিয়ে ছিল? কীভাবে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে? বেকারদের কী হবে? ফুল চাষিরা কি শেষ পর্যন্ত বাঁচবে? হোটেল-রেস্টুরেন্ট ব্যবসার কী হবে? ইত্যাদি হাজারো প্রশ্ন। যার অধিকাংশের উত্তর নেই। কিন্তু এসব মৌলিক বিষয় নিয়ে না ভেবে আমার মাথায় হঠাৎ দেশে কোন ধরনের শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান তা নিয়ে ভাবনা এলো কেন? এটি তাহলে অলস মস্তিষ্ক শয়তানের বসবাস? কারণ, বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত একটি শাসনব্যবস্থা ঘোষিত থাকার পরও আমার মধ্যে এ ধরনের ‘দুষ্ট’ চিন্তা অত্যন্ত গর্হিত ও ধৃষ্টতামূলক। তার পরও এ প্রশ্ন সামনে চলে আসার কিছু মৌলিক যুক্তিগ্রাহ্য কারণ রয়েছে। কারণ হলো, আমাদের রাষ্ট্রের অভ্যুদয় এবং এ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা পিতার শিক্ষা। ‘বাংলাদেশ’ নামের রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়েছিল জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে। বিদেশি, বেনিয়া, ২২ কোটিপতি পরিবারের কর্তৃত্বে থাকা এ ভূখন্ডকে মুক্ত করে ‘জনগণের রাষ্ট্র’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম ছিল তাই শেষ বিচারে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। কোনো গোষ্ঠীস্বার্থ নয়, জনগণের সামগ্রিক কল্যাণব্রতই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূলভিত্তি। এজন্যই আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে- প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন-মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে।’

কিন্তু করোনা সংকটকালে যা হচ্ছে, তাতে কি মনে হয় প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ? আমরা কি আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনা প্রতিপালন করছি? সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতির গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে ‘সংসদ’ সার্বভৌম। সংসদ নির্বাহী বিভাগ বা শাসন বিভাগকে জবাবদিহির মধ্যে আনবে। কিন্তু করোনা সংকট তো সাম্প্রতিক ঘটনা, দীর্ঘদিন ধরেই ‘সংসদ’ কতটা ক্ষমতাবান তা সবাই জানে। তার পরও আশার কথা ছিল, নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই নির্বাহী বিভাগ প্রধান। মন্ত্রীদের ৯০ শতাংশই নির্বাচিত এবং তারা মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী। আমাদের দেশে ফুল, হাফ, সিকি মিলিয়ে ৪৭ জন মন্ত্রী আছেন। তারাই নির্বাহী বিভাগে নেতৃত্ব দেবেন, এটাই গণতান্ত্রিক রীতি। অনেক দিন ধরেই কানাঘুষা শুনতাম, মন্ত্রীদের কোনো ক্ষমতা নেই। মন্ত্রণালয় চলে সচিবদের কথায়। তবে এসব স্রেফ ‘গুজব’ বলেই উড়িয়ে দিতাম। মন্ত্রীরা চকচকে নতুন গাড়িতে উঠছেন। বিশাল বাংলোবাড়িতে থাকছেন। অনেক মন্ত্রীর গাড়ির সঙ্গে আবার সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি ছুটছে। মন্ত্রীরা ফিতা কাটছেন, গলায় ফুলের মালা নিচ্ছেন, বক্তৃতা দিচ্ছেন। চামচা-চাটুকাররা তালি বাজাচ্ছে। কে বলে মন্ত্রীদের ক্ষমতা নেই?

গল্পটা জিয়াউর রহমানের আমলের। জিয়া বেসামরিক মন্ত্রিসভা করলেন। প্রধানমন্ত্রী বানালেন ‘রাজাকার’ শাহ আজিজুর রহমানকে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একজন সেনা কর্মকর্তা সর্বক্ষণ থাকেন। কোনো ফাইল প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেলে কী লিখতে হবে, তাও বলে দেন ওই সেনা কর্মকর্তা। শাহ আজিজকে ফাইল পড়ারও সুযোগ দেন না। শুধু বলেন, ‘স্যার এখানে সিগনেচার করুন।’ সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। একদিন রাজাকার প্রধানমন্ত্রীর আত্মসম্মানে লাগল। সেনা কর্মকর্তাকে বললেন, ‘আমি কীসের প্রধানমন্ত্রী? আমার কোনো ক্ষমতা নেই। আমার কাজ কী?’ জবাবে বিনয়ী সেনা কর্মকর্তা বললেন, ‘স্যার! আপনি দামি গাড়ি পাচ্ছেন?’ শাহ আজিজ বললেন, ‘জি’। বাড়ি? ‘হ্যাঁ’। লোক তো আপনাকে প্রধানমন্ত্রী জানে? ‘তাও ঠিক’ শাহ আজিজের উত্তর। তাহলে আর কী চান? দেশ যারা চালাচ্ছে, তারা চালাক। আপনি একটু আরাম-আয়েশে সময় কাটান। সত্য-মিথ্যা জানি না, এখনো অনেক মন্ত্রী, এক রকম আরাম-আয়েশের জীবন-যাপনই করেন বলে শোনা যায়। মন্ত্রণালয়ে শুধু ফাইলে স্বাক্ষর করাই তাদের একমাত্র কাজ। ফাইলে কী আছে তাও তারা জানেন না। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা উপমন্ত্রীদের একমাত্র কাজ হলো সভা, সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে থাকা। আগে এসবই ছিল পর্দার আড়ালে। মন্ত্রীরা ক্ষমতাবান কিনা, তা প্রমাণ করা সহজসাধ্য ছিল না। কিন্তু মন্ত্রীরা যে আসলে স্রেফ ‘অলঙ্কার’ তা এবার করোনায় প্রমাণিত হলো। করোনা মোকাবিলায়, সার্বিক সমন্বয়ের জন্য প্রতি জেলায় একজন সচিবকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। আর জেলায় সমন্বয়কের দায়িত্ব পেলেন জেলা প্রশাসক। এটা ভালো কি মন্দ, সে বিতর্কে আমি যেতে চাই না। তবে এটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। গণতন্ত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে বাদ দিয়ে অনির্বাচিত ব্যক্তি একটি জেলার বা নির্বাচনী এলাকার দন্ডমুন্ডের কর্তা হতে পারেন না। তাহলে দেশে যে ‘গণতন্ত্র’ আছে তা আসলে আলঙ্কারিক গণতন্ত্র বা পোশাকি গণতন্ত্র। তা ছাড়া আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সরকারের ‘ব্যবহারিক ধরন’ বলে একটি নতুন তত্ত্ব চালু হয়েছে। এ তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি রাষ্ট্রে আইন বা সংবিধানে যা-ই লেখা থাকুক না কেন, বাস্তবে কারা ক্ষমতাবান তার ওপর নির্ভর করে ওই দেশে কোন পদ্ধতির সরকার ক্ষমতায় আছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এ তত্ত্ব অনুযায়ী, পাকিস্তানে পার্লামেন্ট, প্রধানমন্ত্রী সবাই আছে। কিন্তু সেখানে মূল ক্ষমতা হলো সেনাবাহিনীর কাছে। তাই পাকিস্তানের গণতন্ত্রকে বলা হয় ‘ছদ্মবেশী সামরিক তন্ত্র’। বাংলাদেশে গত কয়েক বছর ধরেই লক্ষ্য করছি, রাজনীতিবিদদের চেয়ে আমলারা ‘ক্ষমতাবান’। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এর পর থেকেই আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রে সর্বত্র এক অদ্ভুত প্রবণতা শুরু হয়। রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের হেয় করার প্রবণতা। রাজনীতিবিদরা মূর্খ, আনস্মার্ট, বিশ্রী চেহারা, পোশাকের কি ছিরি! এ রকম একটি অবজ্ঞার উচ্চারণ সুশীলদের ড্রইংরুমের আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়। এজন্য ’৭৫-পরবর্তী সব সরকার রাজনীতিবিদদের চেয়ে সামরিক-বেসামরিক আমলা, সুশীল বুদ্ধিজীবীদের প্রতি ‘তীব্র আকর্ষণ’ অনুভব করতে শুরু করেন। এ সময় আমলারাই হয়ে ওঠেন সরকারের মূল চালিকাশক্তি। এর মধ্যে এরশাদের পতনের পর রাজনৈতিক সরকারগুলো আমলাতন্ত্রের ডানা ছাঁটার কৌশল নেয় বটে, তা কার্যকর হয় না। বিএনপি আমলে কতিপয় আমলা বিএনপির চেয়েও বড় ‘জিয়া সৈনিক পরিণত’ হন। ’৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এ সময় আমলাদের জন্য একটু দুর্দিন শুরু হয়। এরশাদ আর খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক আদর্শ ছিল কাছাকাছি। তাই এরশাদঘনিষ্ঠরা বিএনপিতে রূপান্তরিত হওয়া ছিল অত্যন্ত সহজ। সে হিসেবে আওয়ামী লীগপন্থি আমলা ছিল হাতে গোনা কয়েকজন। কিন্তু আমলারা করিৎকর্মা। জিয়ার খাল কাটাকে অর্থনীতির এক নতুন বিপ্লব বলে পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়া আমলা মুহূর্তেই আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক হয়ে যান! এ যেন জুয়েল আইচের ম্যাজিকের চেয়েও জাদুময়। কাজেই আমলারা কখনো তাদের হিস্সা ছাড়েনি। কৌশলগত কারণে কখনো তারা পিছু হটেছে, কখনো নির্লজ্জ দলকানা নেতার মতো আচরণ করেছে, কখনো অতীতে ত্যাগী ও নির্যাতিতের প্রমাণপত্র এনেছে। মোদ্দাকথা হলো, ’৭৫-এর পর আমলারা ক্ষমতা কেন্দ্রে সব সময় ছিল। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ব্যবহারিক তত্ত্ব প্রয়োগ করে বলা যায়, বাংলাদেশে সব সময় আমলাতান্ত্রিক বা আমলানির্ভর গণতন্ত্র ছিল। রাষ্ট্র পরিচালনা কাঠামো এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে, তাদের বাদ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা অসম্ভব। এখন তারা চূড়ান্তভাবে ‘ক্ষমতাবান’ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেন। ৬৪ জেলায় সচিবদের দায়িত্ব দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে কি তাহলে আনুষ্ঠানিক আমলাতন্ত্রের যাত্রা হলো?

এ প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ হতে পারত। কিন্তু এর উত্তর ‘হ্যাঁ’ নয়। নতুন প্রজন্মের সমাজবিজ্ঞানীরা সরকার কী ধরনের তার উত্তর খুঁজতে দেখে, কার স্বার্থে সরকার কাজ করে? একটি রাষ্ট্রে বা সরকারে জনগণের স্বার্থই একমাত্র দেখা হয়- তাহলে ওই রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক। এই রাষ্ট্রে যদি অন্য কোনো শ্রেণি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখা হয়, তাহলে ওই শ্রেণির শাসন প্রতিষ্ঠিত বলে ধরে নেওয়া হয়। কার্ল মার্কস অবশ্য পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের ব্যবধান, বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেছেন অনেক আগে। বাংলাদেশ যে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় আত্মসমর্পণ করেছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ সম্ভবত কারও নেই। তার মানে এই রাষ্ট্র পুঁজি মালিক, ধনিক গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখে। এজন্যই রাজনীতির ড্রাইভিং সিটে এখন ব্যবসায়ীরা। সংসদ যেন এখন ব্যবসায়ীদের ক্লাবে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে রাষ্ট্রপতি, আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রবীণ নেতার আর্তনাদ উপেক্ষাহীন স্রোতে ভেসে গেছে। রাজনীতিতে করোনার মতো ব্যবসায়ীদের সামাজিক সংক্রমণ বেড়েছে। এটিও ’৭৫-এর পর শুরু হওয়া এক দুর্ভাগ্যজনক প্রবণতা। কিছু কিছু ব্যবসায়ী আবিষ্কার করলেন ‘রাজনীতি’ ব্যবসার থেকেও লাভজনক। টাকা বানানোর সহজ তরিকা। একজন ব্যবসায়ী ঠিক করলেন, তিনি রাজনীতিতে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবেন। করলেন। দুই বছরের মধ্যে তিনি এমপি হলেন। এমপি হয়ে তিনি বিনিয়োগ উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। রাতারাতি টাকা বানিয়ে তিনি হাজার কোটির মালিক হয়ে গেলেন। আর এই যে টাকা, বানালেন কীভাবে? আমলাদের সহযোগিতায়, তাদের সঙ্গে মিলেমিশে। আমলাদের ম্যাজিকে চীনা মেশিন হয়ে যায় জার্মানির। আমলাদের অঙ্কে বালিশের দাম হয় ৮ হাজার টাকা। আমলাদের ঔরসে জন্ম হয় জি কে শামীম, জি এম আইয়ের আবদুর রাজ্জাক, কিংবা মিঠু। এরপর এরা টাকা দিয়ে এমপি হন, তারপর মন্ত্রী। আমলারা জানেন, রাজনীতিবিদরা বেআদব, তাদের কথায় উঠবোস করবেন না। কথায় কথায় তাদের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করবেন। তাই আমলারা ’৭৫-এর পর থেকে ‘নিজস্ব খামারে’ রাজনীতিবিদ উৎপাদনের প্রকল্প হাতে নেন। আজ রাজনীতিতে যত ব্যবসায়ী দেখবেন যারা মন্ত্রী-এমপি হয়েছেন তারা সবাই আমলাতন্ত্রের খামারে নিবিড় পরিচর্যায় উৎপাদিত।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আবার ব্যবসায়ীদের প্রকরণ আছে। একদল ব্যবসায়ী আছে দেশপ্রেমিক। দেশের কল্যাণ করতে চায়। দেশকে এগিয়ে নিতে চায়, আত্মনির্ভর করতে চায়। এরা প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নিরুৎসাহী। বরং দেশকে এগিয়ে নেওয়াই তাদের একমাত্র সংকল্প। এজন্য এরা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকতে চায়। সরকার রাষ্ট্র যেন তাদের সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনী কাজে বিঘœ না ঘটায় এজন্য এর সরকারের সঙ্গে সম্পর্কটা মধুর রাখতে চায়। আর একদল আছে লুটেরা। যারা দেশ, জাতি সমাজ নিয়ে ভাবে না। এদের একমাত্র লক্ষ্য হলো মুনাফা। এরা ব্যাংকের টাকা নিয়ে ব্যবসা করে, ব্যাংককেই ফোকলা বানায়। টাকা পাঠিয়ে দেয় বিদেশে। কানাডায় বেগমপাড়ায় এরা বাড়ি বানায়, শ্রমিকের বেতনের টাকা চুরি করে। বাংলাদেশে ভ্রষ্ট পুঁজিবাদে যে লুটেরা শ্রেণি তৈরি হয়েছে তার নেতৃত্বে আছে গার্মেন্টশিল্প। আমি ব্যক্তিগতভাবে একে গার্মেন্টশিল্প বলতে কুণ্ঠাবোধ করি। আমি বরং একে দর্জিশিল্প বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি। কারণ, এ শিল্পে প্রায় সব কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। বাংলাদেশে যে গার্মেন্ট কারখানা তা আসলে দর্জিবাড়ি। বাইরে থেকে আসা ফেব্রিক্স, বোতাম, সুতা ইত্যাদি এখানে শুধু টেইলারিং করা হয়। এটার আসল যে মুনাফা তা হলো শ্রমিককে ঠকানোর টাকা। শ্রমিকের লুণ্ঠিত টাকায় এরা বিলাসবহুল গাড়ি হাঁকান। এরা বিশাল বাড়ির মালিক হন, দেশে-বিদেশে। এরা ’৭৫-এর পরবর্তী ব্যবসায়িক গ্রুপ, যা আমলাতন্ত্রের আবিষ্কার। আমলারা এই দর্জিমালিকদের এমনভাবে উপস্থাপন করেন যে, তারা ছাড়া অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। অথচ তারা কাঁচামাল বাবদ কত টাকা বিদেশ পাঠান (ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পাচার কত করেন) আর কত টাকা রপ্তানি আয় হিসেবে আসে এর একটি নির্মোহ বৈজ্ঞানিক হিসাব এখনো আমরা করি না। এর সঙ্গে এদের কর মওকুফসহ নানা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, অনুদান, প্রণোদনা হিসাব করলে এরা আদৌ রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে কিনা, তাও এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। দর্জিবাড়ি চালিয়ে তারা দাপিয়ে বেড়ান, সমাজের মর্যাদা সবটুকু শুষে নেন। অথচ বিদেশে রক্ত পানি করে শ্রম দিয়ে, জীবন উজাড় করে যারা রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন তারা উপেক্ষিত থাকেন। এই দর্জিমালিকরা নানা উপায়ে ফন্দিফিকির করে রাষ্ট্রের অর্থ, জনগণের সম্পদ হাতিয়ে নেন। এই যেমন হলমার্কের নামে এরা পুরো সোনালী ব্যাংক খালি করে ফেলেছেন। বিসমিল্লাহর নামে অগ্রণী ব্যাংক। আর এদের সহায়তা দেন চিরক্ষমতায় সজীব আমলারা। এখন যখন করোনায় সামাজিক দূরত্বের দাবি সবচেয়ে বেশি, যখন জনস্বাস্থ্য সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ; তখন গেল গেল বলে দর্জিমালিকরা ‘টেইলারিং বস্তি’গুলো খুলে দিচ্ছেন। কারও কোনো নির্দেশনার থোড়াই কেয়ার করেন এরা। তাহলে কি এই রাষ্ট্রে গার্মেন্ট মালিকদের স্বার্থই সবচেয়ে বেশি দেখা হয়? এজন্য তারা ব্যাংক লুট করলেও সরকার নীরব থাকে। এজন্য তারা টুপটাপ এমপি-মন্ত্রী, মেয়র হন। এজন্য তারা গার্মেন্ট খুলে গণহত্যার মঞ্চ প্রস্তুত করেন অবলীলায়। তাহলে কি দেশে এখন দর্জিতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলো? আসলে, রাষ্ট্রে আমার অবস্থান, রাষ্ট্রে আমার ভবিষ্যৎ কিংবা আমার সন্তানের আগামী কী তা জানার জন্য সবার আগে জানতে হবে, এই রাষ্ট্র কার? এই রাষ্ট্র চালায় কে? জনগণ? আমলারা নাকি দর্জিরা?

পাদটীকা : এখন রাস্তায় বেরোলেই দেখবেন বুভুক্ষু মানুষের অপেক্ষা। খাবারের জন্য অপেক্ষা, ত্রাণের জন্য অপেক্ষা। কোথাও কোথাও ক্ষুব্ধ জনতা ত্রাণের ট্রাক লুট করছে। এটা প্রতীকী মাত্র। ক্ষুব্ধ ঐক্যবদ্ধ জনগণ কী করতে পারে, তার বড় প্রমাণ এই বাংলাদেশ। তাই এখনই, জনগণের কথাই সবার আগে ভাবতে হবে, দেখতে হবে তাদের স্বার্থ। আমলাতন্ত্র কিংবা দর্জিতন্ত্রকে আবর্জনার ডাস্টবিনে ফেলতে জনগণ কেবল একটি দ্রোহের দূরত্বে।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

[email protected]

সর্বশেষ খবর