মঙ্গলবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২০ ০০:০০ টা

আঁধার ঘুুচুক, পরশ থাকুক হৃদয়ভরা

হাসান ইবনে হামিদ

এ যেন এক অচেনা বিশ্ব। শহর থেকে বন্দর, গ্রামের পর গ্রাম সবখানেই সুনসান নীরবতা। থমকে গেছে গোটা বিশ্বের জীবনযাত্রা। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত বিশ্ব মানচিত্র। দিনের পর দিন লাশের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সময় যতই অতিবাহিত হচ্ছে পরিস্থিতি খারাপের দিকে এগোচ্ছে। চিকিৎসাসামগ্রীর সংকট তৈরি হওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে সর্বত্র, অনেকে বিক্ষোভও করেছেন। এ অবস্থায় রাষ্ট্রের কর্ণধাররাও বসে নেই, দ্রুততার সঙ্গেই তৈরি করছেন আইসিইউ, ভেনটিলেটরসহ উপযুক্ত সুযোগসংবলিত হাসপাতাল। জনগণকে ঘরে অবস্থান ও চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ থেকে শুরু করে লকডাউন কার্যকরে নেওয়া হচ্ছে নানামুখী উদ্যোগ। সংকটকালে গরিব ও ছিন্নমূলদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও সরকারের তরফ থেকে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, স্পেনসহ গোটা বিশ্ব নানামুখী উদ্যোগ নিয়েও করোনার কাছে ব্যর্থ হয়েছে। পরিস্থিতি রীতিমতো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের! সময় যতই যাচ্ছে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর অসহায়ত্ব বুঝি আরও বেশি করে ফুটে উঠছে। কিন্তু এতসব বিপর্যয়ের মাঝেও এক দেশ অন্য দেশের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। বিপর্যস্ত সময় বুঝি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরেকবার পরীক্ষায় ফেলছে! ঠিক এমনি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আমাদের পাশের দেশ ভারত।

আঁধার ঘুচুক, পরশ থাকুক হৃদয়ভরা - এ স্লোগান ধারণ করে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ভারতের দ্বিতীয় দফা সহযোগিতা রবিবার এসে পৌঁছেছে বাংলাদেশে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ভারতের প্রতিশ্রুত সহযোগিতার অংশ হিসেবে ১ লাখ হাইড্রোক্সিকোরোকুইন ট্যাবলেট ও ৫০ হাজার জীবাণুমুক্ত সার্জিক্যাল ল্যাটেক্স গ্লাভস সমন্বিত জরুরি চিকিৎসাসেবা  বাংলাদেশে এসেছে। বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলী দাশ রবিবার এ চালান হস্তান্তর করেন। ‘সার্ক কভিড-১৯ জরুরি তহবিল’-এর আওতায় ও কভিড-১৯-এর বিস্তার রোধে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টায় সাহায্য করার উদ্দেশ্যে এ সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথমে’ নীতির অংশ হিসেবে ও কভিড-১৯-এর বিস্তার রোধে একটি সহযোগিতামূলক আঞ্চলিক প্রচেষ্টার লক্ষ্যে ১৫ মার্চ, ২০২০ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সার্ক নেতাদের নিয়ে একটি ভিডিও সম্মেলন করেছিলেন। সেখানে তিনি প্রতিবেশী দেশসমূহকে এ সংকট মোকাবিলায় সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন এবং ১০ মিলিয়ন ডলার প্রাথমিক সহায়তা নিয়ে সার্ক কভিড-১৯ জরুরি তহবিল গঠন করেন। এ তহবিলের অধীনে ৩০ হাজার সার্জিক্যাল মাস্ক ও ১৫ হাজার হেডকভার সমন্বিত জরুরি চিকিৎসা সহায়তার প্রথম চালান ২৫ মার্চ, ২০২০ বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনকে হস্তান্তর করা হয়। এ ছাড়া করোনা সংক্রমণ বিস্তার রোধে ডাক্তার, নার্সদের আলাদা প্রশিক্ষণ চালু করেছে ভারত সরকার; যেখানে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিতদের আলাদা প্রশিক্ষণও তারা দিচ্ছে।

২৫ মার্চ ভারত সরকারের প্রথম দফা সহায়তা এলেও এই করোনা মোকাবিলায় পারস্পরিক সহায়তার গল্পের শুরু আরও আগেই। ফেব্রুয়ারি, করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের উহান শহর তখন ছিল এক মৃত্যুপুরী। পুরো উহান শহর লকডাউনে, ঘরের ভিতর বন্দী অবস্থায় বুঝি তখন তারা মৃত্যুর প্রহর গুনছে। এ অবস্থায় খবর আসে, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা আটকে পড়েছেন উহানে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের দেশে ফিরে আসার আকুতি অনেকের চোখ তখন ভিজিয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার দ্রুততার সঙ্গেই উহান থেকে শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনে। কিন্তু তখনো কিছু শিক্ষার্থী উহানেই রয়ে যান যার খবর প্রচারিত হয় পরে। এদিকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ফ্লাইট আবার উহানে পাঠানোও হয়ে পড়ে জটিল ও কষ্টসাধ্য। ঠিক সেই মুহূর্তে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় ভারত। চীনের উহান শহরে আটকে পড়া ২৩ জন বাংলাদেশি নাগরিককে উদ্ধার করে দিল্লিতে ফিরিয়ে আনে ভারত সরকার। ২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে করে তাদের ফিরিয়ে আনা হয়। শুধু তাই নয়, তাদের মধ্যে কেউ ভাইরাস বহন করছে কিনা তাও নির্ণয় করে দেওয়ার দায়িত্ব নেয় ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। দিল্লি থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রেখে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় তাদের। বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনায় ভারতীয় বিমান বাহিনীকে ধন্যবাদ জানায় ঢাকা।

এখানেই থেমে থাকেনি বন্ধুত্বের যাত্রা। অসহায়ত্বের মাঝেই আরেকবার সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় ভারত সরকার। করোনা চিকিৎসায় যখন দিশাহারা গোটা বিশ্ব, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) প্রতিষেধক আবিষ্কার নিয়ে যখন চলছে নানামুখী গবেষণা, ঠিক এমন এক দুঃসময়ে করোনা চিকিৎসায় বাংলাদেশকে ২০ লাখ ‘হাইড্রোক্সিকোরোকুইন’ দেওয়ার ঘোষণা দেয় ভারত সরকার। সেই প্রতিশ্রুতির অংশ হিসেবেই রবিবার ১ লাখ  ট্যাবলেট  দ্বিতীয় দফা সহায়তার সঙ্গে বাংলাদেশে পৌঁছেছে। ঘটনার বিস্তারিত একটু বলছি। এখন পর্যন্ত প্রাণঘাতী কভিড-১৯-এর প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি তা কমবেশি সবাই জানি। তবে বিজ্ঞানীরা প্রতিষেধক আবিষ্কারে দিনরাত পরিশ্রম করছেন। এমনি একসময় খবর আসে করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে ম্যালেরিয়ানিরোধী হাইড্রোক্সিকোরোকুইন ওষুধ ব্যবহারে ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে করোনা  রোগীদের ওপর ম্যালেরিয়ানিরোধী এ ওষুধের পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। যেখানে দেখা যায়, ‘হাইড্রোকুইনন’ নামে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় বিশেষ কার্যকর     হচ্ছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কভিড-১৯ এর সম্ভাব্য প্রতিষেধক হিসেবে হাইড্রোক্সিকোরোকুইন শনাক্ত করেছে। আর হাইড্রোক্সিকোরোকুইন ওষুধের  সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী দেশ বর্তমানে ভারত। বিশ্বে এই মেডিসিনের মোট উৎপাদনের ৭০ শতাংশই ভারতে হয়। ইতিমধ্যেই এই ওষুধের জন্য ৩০টির  বেশি দেশ ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এরপরেই ভারত সরকার এই মেডিসিন সরবরাহের উদ্যোগ নেয় এবং বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশের তালিকা তৈরি করে। প্রথম দফায় এসব দেশকে হাইড্রেক্সিকোরোকুইন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। ভারতের প্রতিবেশী প্রথম নীতির অংশ হিসেবে এই ট্যাবলেট এখন আসছে বাংলাদেশ। করোনার এই দুঃসময়ে বাংলাদেশকে এই বিপুল পরিমাণ ট্যাবলেট  দেওয়া নিঃসন্দেহে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাবে। এছাড়াও সার্ক অঞ্চলে কভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার প্রতি ভারতের প্রতিশ্রুতিকে সামনে রেখে, ২৬ মার্চ ও ৮ এপ্রিল  সার্ক দেশসমূহের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং বাণিজ্য প্রতিনিধিদের মধ্যে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ, বাণিজ্য সহজীকরণ এবং সেরা অনুশীলনগুলো বিনিময় বিষয়ে আলোচনার জন্য পৃথক ভিডিও সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সার্কভুক্ত দেশগুলোর স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সেরা অনুশীলনগুলো বিনিময়ের জন্য এবং পারস্পরিকভাবে উপকৃত হওয়ার জন্য অবিচ্ছিন্ন  যোগাযোগ করছেন। তাছাড়াও ভারতের স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞরা কভিড-১৯ পরিচালনা কৌশল, তা বৃদ্ধি,  সেরা অনুশীলনের বিনিময় এবং এ সম্পর্কিত দিকগুলো নিয়ে সার্ক দেশগুলোর স্বাস্থ্যসেবা দানকারীদের জন্য স্বল্পদৈর্ঘ্য ওয়েবিনার আকারে ই-আইটিইসি প্রশিক্ষণ মডিউল ডিজাইন করেছেন। ১৭-২১ এপ্রিল অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেস, রায়পুর এই অনলাইন কোর্সটি পরিচালনা করে যেখানে বাংলাদেশের ৯০ জন স্বাস্থ্যকর্মী অংশ  নেন। ভারত সরকারের আইটিইসি উদ্যোগের আওতায় ২৭ এপ্রিল-০৬ মে পর্যন্ত ভারতের চন্ডীগড়ের  পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ কর্তৃক দ্বিতীয় অনলাইন  কোর্সের আয়োজন করা হচ্ছে।

মূলত দক্ষিণ এশিয়ায় করোনা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব¡পূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ভারত। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সাহায্য করার জন্য করোনাভাইরাস টেস্ট  সেন্টার তৈরি ও স্থানীয় চিকিৎসকদের ভাইরাসের  মোকাবিলায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ভারত সরকার একটি র‌্যাপিড রেসপন্স টিমও গঠন করেছে। খুব দ্রুতই দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহে এই র‌্যাপিড রেসপন্স টিম পাঠানো হবে। আর এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার  দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশকে। এই ভয়াবহ মহামারীতে বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত আবারো প্রমাণ করল, বন্ধু ও প্রতিবেশী হিসেবে সব প্রতিকূল সময়ে ভারত সরকার বিনাশর্তে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত। আমাদের প্রত্যাশা, খুব শিগগিরই ভারত ও বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধভাবে কভিড-১৯ সংক্রমণে সৃষ্ট পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারবে। গ্রহণের কাল কেটে যাবে, এই জনপদে আসবে ভোর। আবার আমরা একসঙ্গে হাতে হাত মেলাব, বুকে জড়াব আপনজনকে, ধুলোমাখা পথের শেষে আবার যাপন করব বড় কোনো উৎসব, দেখে নিও তোমরা।  

লেখক : রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর