চলে গেলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। গত ১৪ মে বৃহস্পতিবার বিকালে পার্থিব জীবন শেষ করে তিনি অনন্তলোকে পাড়ি জমালেন। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে গেল একজন শিক্ষাগুরু, গবেষক ও লেখকের জীবন। কয়েক দিন আগে চলে গেছেন আরেক জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। আফসোস! মহিরুহের মতো দুই শিক্ষাগুরু ও পন্ডিত অধ্যাপক চলে গেলেন কভিড-১৯-সৃষ্ট মহামারীর সময়ে। তাদের ছাত্র-ছাত্রী, ভক্ত, অসংখ্য গুণগ্রাহী এবং সমগ্র জাতি তাদের জানাজায় শরিক হতে পারল না; সামনে দাঁড়িয়ে জানাতে পারল না তাদের অন্তিম সম্মাননা।
জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর প্রয়াণে কষ্ট পেয়েছি। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর পর আমাকে গ্রাস করেছে এক ধূসর শূন্যতা! ভাবছি, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, ফজলে হাসান আবেদ, সৈয়দ শামসুল হক, সৈয়দ আশরাফুল ইসলামরা চলে যাওয়ায় জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। রাজনীতি যখন দুর্বৃত্তায়নের দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে, তখন সৈয়দ আশরাফের মতো সৎ, নিষ্ঠাবান ও কমিটেড রাজনৈতিক নেতা চলে গেলেন; সাহিত্য ও সৃজনশীলতার প্রান্তরে যখন খরা, তখন সৈয়দ হকের মতো সব্যসাচী লেখক চলে গেলেন; ব্যক্তি উদ্যোগে দেশজ বহুমুখী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যাপারে যখন দৃঢ়চেতা, খাঁটি ও গতিশীল উদ্যোক্তার ঘাটতি, তখন চলে গেলেন ফজলে হাসান আবেদ।
ভিতর থেকে বিশ^বিদ্যালয়গুলো যখন দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে এবং নীতিনির্ধারকদের বোঝার ঘাটতি ও অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে এসছে; তখন চলে গেলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও জামিলুর রেজা চৌধুরী। এই শিক্ষাগুরু পন্ডিতদের চলে যাওয়ায় আমি শুধু শঙ্কিত নই, একই সঙ্গে উৎকণ্ঠিত ও সন্ত্রস্ত! কেননা, দশকের পর দশক ধরে যে বি্বিবিদ্যালয়গুলো বাংলাদেশি বাঙালির বাতিঘর হিসেবে কাজ করেছে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজ গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকরা আজ সংখ্যা! তাঁরা আজ লাল, সবুজ, হলুদ, খয়েরি, নীল, সাদা, ও গোলাপি রঙের সংখ্যা। তাঁরা আর পন্ডিত নন, গবেষক নন, শিক্ষাগুরু নন।অনেক শিক্ষক আবার লাল, সবুজ, হলুদ বা খয়েরি রঙে সন্তুষ্ট নন; তাঁরা হন বর্ণচোরা, নইলে বর্ণিল; কেননা, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নতুন রঙের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এলে তাঁরা প্রশাসনিক বা সরকারি রং ধারণ করেন। বর্ণচোরা (অথবা বর্ণিল) হওয়ার কারণে তাঁরা অনবরত রং পরিবর্তন করতে থাকেন। তাঁদের ধারে ও ভারে শক্তিমন্ত ও ধারালো হয়ে ওঠে সরকার সমর্থক রং। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রংবেরঙের এ খেলা চলতেই থাকে। আর উপাচার্য হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় সরকার সমর্থক রংও প্রয়োজন হয় না।
আমি অবশ্য দলীয় বিবেচনায় উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ, প্রভোস্ট, প্রক্টর ও শিক্ষক নিয়োগের প্রবল বিরোধী। শিক্ষক থেকে উপাচার্য পর্যন্ত নিয়োগ হওয়া উচিত যোগ্যতা, মেধা, পান্ডিত্য, প্রশাসনিক দক্ষতা ও চারিত্রিক শুদ্ধাচারের ওপর ভিত্তি করে। কিন্তু কয়েক দশক ধরে আমরা দেখছি, সরকারগুলো তাদের আদর্শে বিশ্বাসী শিক্ষকদের মধ্য থেকে উপাচার্যসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দিয়ে থাকে।
এ বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়েও বলতে চাই, রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী শিক্ষকদের মধ্য থেকেও মেধা, পান্ডিত্য, প্রশাসনিক দক্ষতা ও চারিত্রিক শুদ্ধাচারের ভিত্তিতে বিশ^বিদ্যালয়গুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও যখন দেখি, অনেক বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে পাকিস্তান-সমর্থক ও মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীরা বসে অছেন; তখন বুঝি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় থাকলেও সরকারি নানা সংস্থা ও প্রশাসনের অনেক জায়গায় রাজত্ব করেন মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীরা! শিক্ষাগত যোগ্যতা, টিচিং-কমপিটেন্স, মেধা, গবেষণা-সক্ষমতা ও চারিত্রিক শুদ্ধাচারের ওপর ভিত্তি করে যদি শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হতো; আর একাডেমিক ক্যারিয়ার, প্রশাসনিক দক্ষতা, গবেষণা-সক্ষমতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি মানদন্ডের ভিত্তিতে যদি উপাচার্যসহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দেওয়া হতো, তাহলে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এখন যে নাজুক অবস্থা, তা হতো না।
অস্বীকার করব না, পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় উপাচার্যদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা ভালো শিক্ষাবিদ, গবেষক, এবং প্রশাসনিক দক্ষতাও তাঁদের আছে। নইলে এতগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম মোটামুটি রকমভাবেও চলতে পারত না। অন্যদিকে কোনো একজন বা দুজন উপাচার্যের বিরুদ্ধে যদি অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠত, তাহলে বলা যেত, এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু তা বলার উপায় নেই।
এ বছরের ২০ জানুয়ারি ‘দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষকসমাজ’-এর ব্যানারে প্রগতিশীল শিক্ষকসমাজের একটি অংশ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত-সংবলিত ৩০০ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, ও দুর্নীতি দমন কমিশনে জমা দেয়। গত বছরের নভেম্বরে দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ মর্মে খবর প্রকাশিত হয় যে, দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে উপাচার্যবিরোধী বিক্ষোভ ও ছাত্র আন্দোলনের জেরে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে, যার ফলে ব্যাহত হচ্ছিল ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ছিল- খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
উল্লেখ্য, উপাচার্যদের ‘কিস্সা-কাহিনি’ সবিস্তারে পত্রপত্রিকায় আসতে শুরু করে ২০০৫-২০০৬ সালে জোট সরকারের মেয়াদকালের শেষ দিকে। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, ধীরে ধীরে যোগ্য ব্যক্তিদের উপাচার্য পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। কিন্তু দিন দিন উপাচার্য নিয়োগের বিষয়টি এমন জায়গায় এসে ঠেকছে যে, আমার আহমদ ছফা লিখিত ‘গাভী বিত্তান্ত’, ও মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা ‘মহব্বত আলীর একদিন’ উপন্যাসের কথা মনে পড়ছে। একজন উপাচার্য তো পদে যোগদানের পর ৯৭৯ কার্যদিবসের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মাত্র ২২৭ দিন! এ ছাড়া তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি অনুষদের মধ্যে তিনটির ডিন, একটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও অর্ধশতাধিক কোর্স পড়ানোর দায়িত্বে রয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারকে অনুমোদন করে? প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা ও নির্দেশনায় দল ও প্রশাসনে যে শুদ্ধি অভিযান চলছে, এই উপাচার্যের কর্মকান্ড কি তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ?
পরিশেষে আমি দুঃখের সঙ্গে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক পদত্যাগী উপাচার্যের কথা উল্লেখ করতে চাই। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের সূত্রে আমরা জানি, অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও নৈতিক স্খলনের অভিযোগে গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের ‘এক দফা’ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। অভিযোগগুলোর সত্যতা পাওয়ায় তদন্ত কমিটি তাঁকে প্রত্যাহারের সুপারিশ করার পর ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে তিনি পদত্যাগ করেন। যে বিষয়টি আমাকে অনবরত পীড়ন করে, তা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থানে তাঁরই নামে যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ব্যাপারে সরকারি তরফে যে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, সেই গুরুত্বটি কেন দেওয়া হয় না? প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য হিসেবে যাঁদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের কেউ কি বাংলাদেশে স্বীকৃত কোনো শিক্ষাবিদ ও গবেষক? যে পদত্যাগী উপাচার্যের কথা বলছি, তিনি তাঁর মাতৃ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারবিরাধী দলের নেতা ছিলেন। কিন্তু তাঁরই একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের সুপারিশে তিনি গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে অভিষিক্ত হন। সরকারে তাঁর ওই আত্মীয়ের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে বলে শুনেছি।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু যে স্থানে জন্মগ্রহণ করেছেন, সে স্থানে তাঁরই নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে কি একটি অনন্য পরিকল্পনা করা যেত না? অন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন ও জাতীয়ভাবে স্বীকৃত পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির একজন শিক্ষাবিদ ও গবেষককে কি গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেত না? এ বিশ্ববিদ্যালয়টি হতে পারত একটি মডেল বিশ্ববিদ্যালয়। আন্তর্জাতিক মানের অবকাঠামো, ল্যাব, লজিস্টিকস, দেশি-বিদেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর পদচারণে এটি হতে পারত এশিয়ার অন্যতম প্রধান একটি বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবার্ষিকীতে সেটি কি জাতির জন্য এক অনন্য উপহার হতো না?
জওহরলাল নেহরু ছিলেন ভারতের কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তাঁর নামে দিল্লিতে ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জওহরলাল নেহরু বিশ^বিদ্যালয়। এটি এশিয়ার প্রথম ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি এবং বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশ-বিদেশের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর পদচারণে মুখরিত এবং পড়াশোনা ও গবেষণায় উচ্চকণ্ঠ। সিঙ্গাপুরের জাতির জনক হিসেবে স্বীকৃত লি কুয়ান ইয়ের নামে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরে (এনইউএস) লি কুয়ান ইয়ে স্কুল অব পাবলিক পলিসি আছে। এনইউএস ও স্বায়ত্তশাসিত এই পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্কুলটি কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভর্সিটি র্যাংকিংয়ে বিশ্বে ১১তম এবং এশিয়ার মধ্যে ১ নম্বর। আমরা কি বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থানে তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টিকে নিয়ে একটি ‘ভিশনারি’ পরিকল্পনা করতে পারি না? হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এই বাঙালির শততম জন্মবার্ষিকীতে এটিই হতে পারে তাঁর প্রতি অনন্য এক সম্মাননা।
লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।