সোমবার, ১৫ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভে বিপর্যস্ত আমেরিকা

মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)

বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভে বিপর্যস্ত আমেরিকা

আমার ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি ও আগামী প্রজন্মের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমি মরার জন্য প্রস্তুত হয়ে রাস্তায় নেমেছি, আর ফিরে যাব না। আমরা এর শেষ চাই। মরে বোঝাতে চাই কালোরাও মানুষ এবং আমেরিকার বিপর্যস্ত নিউইয়র্ক শহরের ব্যস্ততম সড়ক ম্যানহাটনের রাস্তায় গত ৫ জুন বিক্ষোভে অগ্নিশর্মা মানুষের মধ্য থেকে একজন মধ্যবয়সী কৃষাঙ্গ নারী সিএনএনের সরাসরি প্রচারে সংযুক্ত হয়ে উপরোক্ত কথাগুলো বলছিলেন। ১৮৬৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেড়শ বছরের বেশি সময় ধরে সমঅধিকার আদায়ের সংগ্রাম আমেরিকার কৃষাঙ্গ জনগোষ্ঠী করে এলেও তা যে এখনো পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি তারই প্রতিধ্বনি শোনা গেছে কৃষাঙ্গ ওই নারীর কণ্ঠে। এখানে উল্লেখ্য, ১৮৬৫ সালের আগ পর্যন্ত আমেরিকান কালোদের অধিকারের প্রশ্নই ওঠেনি। কারণ, সে পর্যন্ত তারা ছিল শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের ক্রীতদাস, অর্থাৎ কেনা গোলাম। এসব কথায় একটু পরে আসছি। আমেরিকার মিনোসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়াপোলিস শহরে গত ২৫ মে জাল নোট রাখার অভিযোগে কৃষাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডকে গ্রেফতার করলে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে জর্জ ফ্লয়েড নিচে পড়ে যায়। তখন টহলরত চার শ্বেতাঙ্গ পুলিশের মধ্যে একজন হাঁটু দিয়ে ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড তার গলা চেপে ধরে রাখে এবং তাতেই নিহত হয় জর্জ ফ্লয়েড। ফ্লয়েডের শেষ কথা ছিল, আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। এখন হ্যাশট্যাগ হয়ে আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না কথাটি সারা বিশ্বের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে। জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকান্ডের বিচার শুধু নয়, এ রকম বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড  আর যাতে না ঘটে তার দাবি এবং প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে মিনিয়াপোলিসসহ আমেরিকার শত শত শহর। আমার বাবা দুনিয়া বদলে দিয়েছে, জর্জের ৮ বছর বয়সী মেয়ের মুখ থেকে বেরিয়া আসা এ কথাটি আজ বাস্তবেই প্রতিফলিত হচ্ছে। দেশে দেশে মানবাধিকার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড নিয়ে আমেরিকার বড় বড় কথা বলার অধিকার আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। শান্তিপ্রিয় প্রতিবাদ বিক্ষোভের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী নামিয়ে বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির খেলায় চীন ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে এতদিন ধরে ব্যবহৃত আমেরিকার বড় দাবার ঘুঁটিকে হাতছাড়া করায় দেশের বিরোধী দল ডেমোক্রেটদের তোপের মুখে পড়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। হংকংয়ে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে চীনের শক্তি প্রয়োগ নিয়ে কথা বলার নৈতিকতা আমেরিকা হারিয়ে ফেলেছে এ ঘটনার মধ্য দিয়ে। সামষ্টিক অর্থে চীনের সঙ্গে পরাশক্তির লড়াইয়ে আরেক ধাপ পিছিয়ে গেল আমেরিকা। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, এমনকি খোদ আমেরিকাতেও শুধু কালো বা আফ্রিকান আমেরিকান নয়, শ্বেতাঙ্গদের বড় একটা অংশ একই দাবিতে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছে। এর মধ্যে অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। তাতে সাদা-কালো উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৯ শতকের মাঝামাঝিতে সংঘটিত গৃহযুদ্ধের পর আমেরিকার আধা সামরিক বাহিনী নিজ দেশের অভ্যন্তরে এবারই প্রথমবারের মতো বিক্ষোভ দমনে নিয়োজিত হয়েছে। তাতে মানুষ আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে।

শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের বিরুদ্ধে পুলিশ যতই বাড়াবাড়ি করছে ততই জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে বিক্ষোভকারীর সংখ্যা। ৪০টি শহরে কার্ফু জারি করেও বিক্ষোভকারীদের সেখানে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। আন্তর্জাতিক সব মিডিয়া করোনা মহামারীর খবরকে দুই নম্বরে নিয়ে আমেরিকার বিক্ষোভের ঘটনাকে প্রধান খবর হিসেবে প্রচার করছে। ৯ জুন হিউস্টনে জর্জ ফ্লয়েডের স্মরণ সভা ঘণ্টার পর ঘণ্টা টানা লাইভ সম্প্রচার করেছে সিএনএন, বিবিসি ও আল-জাজিরাসহ আরও অনেক টেলিভিশন চ্যানেল। ট্রাম্প প্রশাসন দিশাহারা। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। মূলস্রোতের সব মিডিয়াসহ রাজনীতিক ও সুশীল সমাজ বিক্ষোভ এভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অসংলগ্ন কথাবার্তা এবং প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও বিতর্কিত পদক্ষেপকেই দায়ী করছেন। আগামী নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী জো-বাইডেন তো সরাসরি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে বলেছেন, নেতৃত্বের ব্যর্থতার জন্যই আমেরিকা আজ আর আমেরিকা নেই। নির্বাচন সামনে, ডেমোক্রেটরা রাজনৈতিক সুযোগ নেবে-সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু খোদ রিপাবলিকান দলের প্রভাবশালী নেতা এবং ট্রাম্পের ক্যাবিনেট থেকে সদ্য বিদায়ী মন্ত্রীগণও সব কিছুর জন্য ট্রাম্পকে দায়ী করছেন। বছর দেড়েক আগে পদত্যাগকারী ডিফেন্স সেক্রেটারি জেনারেল ম্যাটিশ বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকান জাতিকে বিভক্ত করে ফেলেছেন। আরেক রিপাবলিকান ভেটারেন, ২০০১-২০০৫ পর্যন্ত জর্জ ডব্লিউ বুশের সেক্রেটারি অব স্টেট জেনারেল কলিন পাওয়েল প্রকাশ্যে মিডিয়ায় বলেছেন, প্রায় আড়াইশ’ বছরের ইতিহাসে এমন প্রেসিডেন্ট আমেরিকা কখনো দেখেনি। তিনি ট্রাম্পকে সরাসরি মিথ্যাবাদী বলেছেন এবং ঘোষণা দিয়েছেন আগামী নির্বাচনে তিনি ডেমোক্রেট প্রার্থী জো-বাইডেনের পক্ষ নেবেন। ৯৫ বছর বয়সী সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার মন্তব্য করেছেন, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি অর্থনৈতিক বৈষম্য ক্রমশই আমাদের গণতন্ত্রকে নিচে টেনে নামাচ্ছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো জনসম্মুখে হাঁটু গেড়ে জর্জ ফ্লয়েডের প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকান্ডকে আত্মঘাতী বলে মন্তব্য করেছেন। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খোমেনি বলেছেন, এটাই আমেরিকার চরিত্র, তারা সারা বিশ্বের গলার ওপর চেপে বসেছে। কিন্তু সব দোষ নন্দঘোষ মর্মে এর জন্য বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এককভাবে দায়ী করলে এই একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রাণঘাতী ভাইরাস বর্ণবাদের আসল স্বরূপ উন্মোচিত হবে না। আজকের এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে বারাক ওবামা, জো-বাইডেন, জিমি কার্টার, জাস্টিন ট্রুডো, বরিস জনসন সবাই বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। কিন্তু বিগত সময়ে ওবামা, কার্টারসহ ১৮৬৫ সালের পর থেকে যত প্রেসিডেন্ট ছিলেন তারা সত্যিই যদি বর্ণবাদ দূরীকরণে সার্থক হতেন তাহলে জর্জ ফ্লয়েডকে এভাবে জীবন দিতে হতো না। বিগত কয়েক বছরে তো মনে হচ্ছে বর্ণবাদী চিন্তা ও শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি আমেরিকা-ইউরোপসহ সর্বত্রই আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

২০১৪ সালে স্টাটেন আইল্যান্ডের এরিকগার্নার, একই বছর মিসৌরির কলেজছাত্র ব্রাউন, ২০১৩ সালে ফ্লোরিডার স্কুলছাত্র ট্রেইডন মার্টিন, একই বছরে কেন্টাকির ব্রেওনা টেলর, ২০১৫ সালে মেরিল্যান্ডের ওয়াল্টার স্কট, একই বছর টেক্সাসের স্যাল্ডো ব্লান্ডসহ আরও অনেক কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের হত্যাকান্ড প্রমাণ করে সব সময় বর্ণবাদ ছিল এবং এখনো তা সমানভাবে বিদ্যমান। আরও পেছনে গেলে এ তালিকা কখনো শেষ হবে না। আমেরিকার মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ১৪ ভাগ আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ। তাতে প্রায় পাঁচ কোটি কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ এখন আমেরিকার নাগরিক।

রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বত্র তারা এখন অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। এতদিন সবচেয়ে বড় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এই কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের দল কি করে আমেরিকায় এলো তার ইতিহাস বড় করুণ, মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক। ক্রীতদাসের করুণ কাহিনী সেই যে ১৬১৯ সাল থেকে শুরু, তারপর প্রায় আড়াইশ’ বছর ধরে কী অমানবিক সে ইতিহাস তা এখন কমবেশি সবাই জানেন। অ্যালেক্স হেলির বিখ্যাত উপন্যাস রুটস দ্য সাগা অব অ্যান আমেরিকান ফ্যামিলি অবলম্বনে টেলিভিশন সিরিয়াল রুটস যারা দেখেছেন তারা চোখের জলের বিনিময়ে সেই মর্মান্তিক কাহিনীর সামান্য কিছুটা হয়তো অনুভব করেছেন। ১৯৭৭ সালে আমেরিকার এবিসি টেলিভিশন চ্যানেল আট পর্বে ওই ধারাবাহিকটি প্রচার করে। ১৭৮৩ সালে স্বাধীন, ১৭৮৮ সালে সংবিধান প্রণয়ন এবং ১৭৯১ সালে তাতে বিল অব রাইটস সংযোজন করার মধ্য দিয়ে আমেরিকা সাংবিধানিকভাবে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকারকে স্বীকার করে নেয়। সেই থেকে প্রায় আড়াইশ’ বছর কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই মর্মার্থের মতো আমেরিকায় আজো বর্ণবাদের অবসান হয়নি, যার সর্বশেষ বলি জর্জ ফ্লয়েড। সংবিধান প্রণয়নের ৭৭ বছর পর ১৮৬৫ সালে দাসপ্রথা বাতিল হলেও বর্ণবাদের শেকড় উৎপাটিত হয়নি। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন নিজের জীবন এবং গৃহযুদ্ধে আরও প্রায় সাত লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে দাসপ্রথা বাতিল করতে পেরেছিলেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ সাদা বর্ণের মানুষের ভিতরে বর্ণবাদী চিন্তা থেকেই যায়। তবে সংগ্রাম করে একেকটির ঘটনার মধ্য দিয়ে কালোরা তাদের অধিকার আদায়ের পথে এগোচ্ছে। যে ঘটনাটির মধ্য দিয়ে কালোরা ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার পায় তার কথা একটু উল্লেখ করি। তাহলে বোঝা যাবে জর্জ ফ্লয়েডের রক্ত বৃথা যাবে না। ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বর মাসের ঘটনা। সে সময়ে দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে জিম ক্রো আইন নামে একটা আইন ছিল যার পরিপ্রেক্ষিতে বাসে চলাচলের সময় সামনের সিটগুলো শ্বেতাঙ্গদের জন্য রিজার্ভ থাকত। পেছনের মাত্র দুই-তিনটি সারি থাকত কালোদের জন্য। ১৯৫৫ সালের ১ ডিসেম্বর অ্যালাবামা রাজ্যের মন্টগোমার শহরের একটি বাসে রোজা পার্ক নামের একজন কালো মহিলা একটি বাসে উঠে পিছনে গিয়ে কালোদের জন্য নির্দিষ্ট সিটে বসে পড়েন। বাস চলতে চলতে শ্বেতাঙ্গদের জন্য নির্দিষ্ট সিট ভর্তি হওয়ার পর আরও শ্বেতাঙ্গ বাসে উঠলে তারা রোজা পার্ককে ওঠে যেতে বলে। রোজা পার্ক সিট ছাড়তে অস্বীকার করলে তাকে হেনস্থা করা হয় এবং পুলিশ এসে তাকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। শুরু হয় আজকের মতো আন্দোলন এবং একই সঙ্গে আদালতের লড়াই। এক বছরের মাথায় সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্ত রায় দিয়ে ঘোষণা করে জিম ক্রো আইন অবৈধ, কালোদের সেগ্রিগেশন বা আলাদা রাখার নিয়ম বাতিল/একজন সাহসী নারীর একটি প্রতিবাদই সব কিছু পাল্টে দেয়। মার্টিন লুথার কিংয়ের নেতৃত্বে ওই আন্দোলন আরও বিস্তৃতি লাভ করে। এক পর্যায়ে মার্টিন লুথার কিং সেই বিখ্যাত ভাষণটি দেন- আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম। ১৯৬৫ সালে কালোদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৬৮ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হন লুথার কিং। ধারণা করা হয় শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী সংগঠন কু ক্লাক্স ক্লানের সন্ত্রাসীরাই লুথার কিংকে হত্যা করে। লেখক মাইকেল ইগনাটিফ রচিত ‘ব্লাড অ্যান্ড বিলংগিং’ গ্রন্থে বর্ণবাদ পরিস্থিতির সমালোচনা করে বলা হয়েছে, অভিবাসন ও বহিরাগত আত্মীকরণ আমেরিকার সমৃদ্ধি এবং শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক, এটিকে রক্ষা করা না হলে এবং শুধু আমেরিকান, এই পরিচয় সমাপ্ত কিছুর নির্ধারক না হলে সেটি হয়ে উঠতে পারে আমেরিকার জন্য সর্বনাশের প্রতীক। নাগরিক অধিকারের বেলায় ধর্ম, বর্ণ ও জাতিগত বৈষম্য সৃষ্টি করা হলে তা রাষ্ট্রের অখন্ডতা এবং নিরাপত্তার জন্য কত বড় হুমকি সৃষ্টি করতে পারে তার উদাহরণ ভূতপূর্ব যুগোশ্লাভিয়া। ইন্দোনেশিয়া থেকে পূর্ব তিমুর এবং সুদান থেকে দক্ষিণ সুদানের বিচ্ছিন্ন হওয়া সমসাময়িক কালের ঘটনা। কারণ, ওই একই ধর্ম, বর্ণ ও জাতিগত ভেদাভেদ। ফিরে আসি আমেরিকার কথায়।

বর্ণবাদী ভাইরাসের প্রবল উপস্থিতির মধ্যেও সব শ্রেণি-পেশার ভিতর থেকে শ্বেতাঙ্গদের বড় একটা অংশ বর্ণবাদসহ সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার। এবারও সেটা দেখা গেছে। আমেরিকার নাগরিক হয়ে দেশের মাটিতে বসেই অ্যাডওয়ার্ড সাঈদ (১৯৩৫-২০০৩) ও নোয়াম চমস্কিসহ বুদ্ধিজীবীরা সব ধরনের বৈষম্য, বিভাজন, অনৈতিকতা ও রাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে সেভাবে তীব্রকণ্ঠে বিরোধিতা করতে পারে তাতে অন্য দেশের একজন পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক হিসেবে আমি অভিভূত হই। প্রেসিডেন্টকে মিথ্যাবাদী ও অপদার্থ বলে গালি দেওয়া হচ্ছে। মুদ্রার অপর পিঠের মতো এগুলোই আমেরিকার শক্তি এবং এখনো একটা ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে। সবাই বলছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা নতুন করে জেগে উঠেছে।

শরৎচন্দ্রের নিষ্কৃতি গল্পে একটা কথা আছে, ‘স্বার্থের জন্য নিরীহ লোকের মনে সন্দেহের বীজ বপন করলে যথাকালে তার খারাপ পরিণতি হইতে নিজেকেও দূরে রাখা যায় না।’ নির্বাচন ও ক্ষমতায় আসার শুরু থেকে অভিবাসন এবং অন্য বর্ণের মানুষ সম্পর্কে ট্রাম্প যে সন্দেহবাদের বীজ শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের মনে ঢুকিয়ে দিয়েছেন তারই বলি জর্জ ফ্লয়েড এবং তার জের ধরেই ট্রাম্পের জনপ্রিয়তায় ধস। জরিপে দেখা যায়, জর্জ ফ্লয়েড ইস্যুর আগ পর্যন্ত ট্রাম্পের জনসমর্থন ছিল শতকরা ৫৬ ভাগ, এখন সেটি ৪০ ভাগ। ট্রাম্পের জন্য নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আশার আলো ক্রমেই নিভে যাচ্ছে। ২০১১ সালের প্রথম দিকে তিউনিশিয়ায় পুলিশের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ সবজি বিক্রেতা মোহামেদ বুয়াজিজি নিজের গায়ে আগুন জ্বালিয়ে আত্মাহুতি দিলে তার জেরে পুরো আরব বিশ্বের মানচিত্র বদলে যায়। সুতরাং ক্ষমতার জোরে একজন নগণ্য মানুষের জীবনকেও যদি ছোট করে দেখা হয় তাহলে তার পরিণতি রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি পর্যায়ে ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে আনতে পারে। লেজে আগুন দিয়ে হনুমানকে অপমান করতে চেয়েছিল রাক্ষস রাজ রাবণ। কিন্তু সেই আগুনেই লঙ্কা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ট্রাম্পের উপদেষ্টারা রামায়ণ পড়েছেন কিনা জানি না। তবে বর্ণবাদের আগুনে আমেরিকা আজ বিপর্যস্ত। তার তাপে হয়তো আগামী নভেম্বরে ট্রাম্পকে সিংহাসন ছাড়তে হতে পারে।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক।

ই-মেইল : [email protected]

সর্বশেষ খবর