মঙ্গলবার, ৩০ জুন, ২০২০ ০০:০০ টা

যুদ্ধ ও প্রতিরোধ : অদৃশ্য শত্রু

ডা. মো. নাজমুল করিম মানিক

যুদ্ধ ও প্রতিরোধ : অদৃশ্য শত্রু

করোনা একটি ভাইরাস যা আরএনএ ভাইরাস হিসেবে পরিচিত। ষাটের দশকে এটি আবিষ্কৃত হয়। এ ভাইরাসটি একটি আরএনএ প্রোটিন যার বহিরাবরণ দুই স্তরবিশিষ্ট চর্বির আবরণ দিয়ে আবৃত। বাইরের আবরণটি কাঁটাযুক্ত যা অনেকটা মুকুটের মতো। এজন্য এ ভাইরাসটির নাম করোনাভাইরাস হয়েছে। ভাইরাসটি অতিক্ষুদ্র যা শুধু ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখা যায়। আয়তন মাত্র ১১২ থেকে ১২০ মাইক্রন ভাইরাসটি প্রাণহীন অণুজীব মাত্র। অথচ কি বিস্ময়! প্রাণহীন এ অণুজীবটি মানবদেহে প্রবেশ করে নির্দিষ্ট কোষের সংস্পর্শে এসে ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী সক্রিয় ভাইরাসে পরিণত হয়ে সংক্রামিত করে করোনা রোগ সৃষ্টি করছে। ভাইরাসটির ভিতরে আরএনএ (রাইবো নিউক্লিয়িক অ্যাসিড)-তে কিছু জিন থাকে যা ক্ষণে ক্ষণে রূপান্তর ঘটিয়ে মারাত্মক প্রাণঘাতীরূপে বিবর্তিত হচ্ছে। ২০১৯-এর শেষ দিকে চীনের উহানে প্রথম করোনা আক্রান্তের সন্ধান মেলে। এ ভাইরাসটি আগের সব ভাইরাস থেকে আকৃতি ও প্রকৃতিতে একেবারেই ভিন্ন, একেবারেই নতুন। এজন্য এ ভাইরাসটির নাম দেওয়া হয়েছে নভেল করোনাভাইরাস, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা Covid-19 নামকরণ করেছে।

করোনাভাইরাস দ্রুত সংক্রামিত হলেও সার্স বা মার্সের মতো মারাত্মক প্রাণঘাতী নয়। এ ভাইরাসটির একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এটা শ্বাসতন্ত্রের উপরিভাগে সংক্রমণ করতে পারে আবার শ্বাসযন্ত্রের নিম্নভাগ ফুসফুস ও এর এলভিওলাইকে সংক্রামিত করে। উপরিভাগে সংক্রামিত হলে হালকা কাশি, হাঁচি বা মৃদুজ্বর থাকতে পারে। আবার শ্বাসযন্ত্রের নিম্নভাগে সংক্রমণ হলে মারাত্মক উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তখন জ্বর, কাশি ও হাঁচি, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া দেখা দিতে পারে। অনেক সময় ডায়রিয়া শরীর ব্যথা থাকতে পারে। অন্যান্য অঙ্গ যেমন হৃদযন্ত্র আক্রান্ত হতে পারে।

কীভাবে ভাইরাসটি মানবদেহে প্রবেশ করে : ভাইরাসটির মুকুটের মতো অংশে এস প্রোটিন থাকে যা শ্বাসযন্ত্রের সেসব কোষকে আক্রান্ত করে যেখানে এসিই-২ (এনজিও টেনসিন কনভার্টিং এনজাইম-২) থাকবে।

কাঁটাযুক্ত আবরণের এস প্রোটিন আক্রান্ত কোষের এসিই-২-এর সঙ্গে লেগে যায়। এরপর মুকুটের কাঁটাগুলো খসে যায়। ফলে ভাইরাসটির আর এন এ সক্রিয় হয়। দ্রুত বংশ বিস্তার করে এবং এসিই-২ আবরণযুক্ত নতুন নতুন কোষকে আক্রান্ত করে। আক্রান্ত কোষের এন্ডোসোমের ভিতর আস্তানা গাড়ে। এন্ডোসোম অনেকটা অম্ল-জাতীয়। ফলে ভাইরাসটি দ্রুত বংশ বিস্তার করতে থাকে। তাই ফুসফুস ছাড়া অন্যান্য অঙ্গে যেখানে এসিই-২ এনজাইম থাকে সেগুলোকেও আক্রান্ত করে। ফুসফুসের এলভিওলাই ধ্বংস করে। খসে পড়া কাঁটাগুলোও ধ্বংসাবশেষ ও রক্ত দিয়ে ফুসফুসের ফাঁপা কোষগুলো পূর্ণ হয়ে অকার্যকর হতে থাকে। ফলে শ্বাসকষ্ট, কাশি হতে থাকে, রক্ত জমাট বাঁধে। অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দেয়। এ সময় আইসিইউর সহায়তা প্রয়োজন হয় নতুবা আক্রান্ত মানুষ মারা যায়। ফুসফুস ছাড়া হৃদযন্ত্রও আক্রান্ত হতে পারে। ফুসফুসের কোষ আক্রান্ত হওয়ার পর মানুষের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হতে থাকে ফলে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এটাকে ইমিউন রেসপন্স বা প্রতিরোধী সক্রিয়তা বলে।

Covid-19এর সংক্রমণের ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইমিউন রেসপন্সটা অস্বাভাবিক। মানবশরীরে তৈরি অ্যান্টিবডি করোনাভাইরাসকে আক্রমণ করে। কিন্তু নির্দিষ্ট ভাইরাসকে প্রতিরোধ করতে পারে না। ফলে অস্বাভাবিকভাবে অ্যান্টিবডিগুলো দিগি¦দিক ছোটাছুটি করে অস্বাভাবিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। রক্তনালির দেয়ালের ছিদ্রগুলো প্রসারিত হয়, রক্তরস রক্তনালি থেকে বের হয়ে আসে। এ অস্বাভাবিক ইমিউন সক্রিয়তাকে সাইটোকাইন স্টর্ম বলে। এ ধরনের প্রতিক্রিয়ার ফলে জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও অন্য উপসর্গগুলো তীব্র হয়। কীভাবে এলো নভেল করোনাভাইরাস Covid-19  : ২০১৯ -এর শেষ দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে বন্যপ্রাণীর বাজারে সম্ভবত বাদুড় থেকে মানবশরীরে এ ভাইরাসটি সংক্রামিত হয়। মতান্তরে ভাইরোলজি ইনস্টিটিউট থেকে দুর্ঘটনাক্রমে বা ইচ্ছাকৃতভাবে ভাইরাসটি মানবশরীরে সংক্রামিত হতে পারে। এরপর বিদ্যুৎ গতিতে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে অদৃশ্য ভাইরাসটি। লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে। আক্রান্ত মানুষ পরিণত হচ্ছে অচ্ছুত প্রাণীতে। যখনই কেউ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে তখন থেকে আক্রান্ত মানুষটি পরিবার, সমাজ সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। তবে ভয়ের কথা যখন বেশির ভাগ আক্রান্ত মানুষ উপসর্গহীন থাকছে। এরা নিজের অজান্তেই অন্যকে আক্রান্ত করছে।

যেভাবেই মানবশরীরে এসে থাকুক এখন একমাত্র মানুষ থেকেই রোগটি সংক্রামিত হচ্ছে। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি বা কফ থেকে অন্য মানুষের নাক, মুখ ও চোখ দিয়ে সংক্রামিত হয়। স্বাস্থ্য সচেতনতাই পারে রোগটি থেকে মুক্ত থাকতে। যেহেতু নাক, মুখ, চোখ দিয়ে ভাইরাসটি মানবদেহে প্রবেশ করে, এজন্য নাকে-মুখে মাস্ক, হাত বারবার সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে পরিষ্কার করা, হাত না ধুয়ে নাক, মুখ বা চোখ স্পর্শ না করলে এ রোগটির সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। রোগটি প্রতিরোধে সারা বিশ্ব সামাজিক দূরত্ব ও লকডাউনকে মূল ভরসা হিসেবে গ্রহণ করেছে। হাত না মেলানো, উন্মুক্ত স্থানে হাঁচি, কাশি বা কফ-থুথু না ফেলা; কোলাকুলি না করা, ভিড় বা জনসমগম এড়িয়ে চলা- এসবই করোনা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দুর্ভাগ্য আমাদের দেশে নিষ্ফল প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও লকডাউন বা সামাজিক দূরত্ব তেমন সফল হয়নি। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতি দরিদ্র দেশে এর চেয়ে বেশি সম্ভব নয়। তার পরও বাংলাদেশে তুলনামূলকভাবে অন্যান্য দেশের তুলনায় সংক্রমণ ও মৃতের হার অনেক কম। করোনা রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। তবে যতক্ষণ কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি না হচ্ছে অদৃশ্য শত্রুর আতঙ্ক নিয়েই আমাদের এ পৃথিবীতে বসবাস করতে হবে। যত বেশি রোগ নির্ণয় হবে তত রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, মাস্ক ও স্যানিটাইজার নিয়ে আরও কত দিন আমাদের চলতে হবে একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই তা বলতে পারেন। সবাই সচেতন হোন, সুস্থ থাকুন সুন্দর ভবিষ্যতের প্রত্যাশায়। এ মহামারী নির্মূল হোক- সৃষ্টিকর্তার কাছে এ প্রত্যাশা সবার।

লেখক : অতিরিক্ত পরিচালক (হাসপাতাল) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা।

সর্বশেষ খবর