শুক্রবার, ১৭ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ ও চিকিৎসা ব্যয়

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও শরিফুল হক রুমি


বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ ও চিকিৎসা ব্যয়

‘সুলভে যৌক্তিক চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার সবার’- বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার আলমা আটা ঘোষণাপত্র, ১৯৭৮।

বাংলাদেশে চিকিৎসা অপচয়ের মূল কারণসমূহ : বাংলাদেশে ব্যক্তি স্বাস্থ্য খাতে প্রায় ৭০% ব্যয় হয় যা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। এত অধিক ব্যয়ের মূল কারণ বাংলাদেশে কোনোরূপ উন্নতমানের প্রাইভেট স্বাস্থ্যবীমা কিংবা সরকার নিয়ন্ত্রিত জাতীয় স্বাস্থ্যবীমা না থাকা। রোগীরা চিকিৎসকের কাছ থেকে ন্যূনতম ৫ মিনিট পরামর্শ সময় না পাওয়ায়, রোগী ও আত্মীয়স্বজন চিকিৎসকের ওপর আস্থা হারান, এমনকি নামিদামি চিকিৎসকের ওপরও। রোগীর উপসর্গ-সমূহের বর্ণনা শেষ করার আগে চিকিৎসক রোগীকে একটি ব্যবস্থাপত্র ধরিয়ে দেন, কোন ওষুধ কোন উপসর্গ উপশমের জন্য দিয়েছেন, কখন সেবন করতে হবে- খাওয়ার আগে না পরে তা চিকিৎসক বুঝিয়ে বলার আগে পরবর্তী রোগী পরামর্শ কক্ষে প্রবেশ করেন, কোনটা কোন রোগের ওষুধ এবং এসব ওষুধের সম্ভাব্য পাশর্^প্রতিক্রিয়া মিথস্ক্রিয়া রোগী জানার সময় পান না, রোগী ওষুধের ব্যবহার সম্পর্কিত পুরো তথ্য না জানার অসন্তোষ নিয়ে চিকিৎসকের চেম্বার ত্যাগ করেন। সামান্য সমস্যা হলে রোগী ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেন এবং অনেক সময় অন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।

রোগীরা চিকিৎসকের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে দামি ওষুধকে বেশি ভালো ওষুধ মনে করেন। রোগী এবং চিকিৎসক উভয়ে জানেন না যে, দামি ওষুধ বেশি নকল এবং ভেজাল ও নিম্নমানের হয়। রোগী দামও বেশি দিলেন, আবার অকেজো খারাপ ওষুধও সেবন করলেন। রোগ না সারায় প্রতি বছর কয়েক লাখ বাংলাদেশি রোগী ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া এমন কি কতক আমেরিকা ও ইংল্যান্ড যাচ্ছেন এবং চিকিৎসা ব্যয়ের কারণে তাদের দুর্নীতি ও দরিদ্রতা বাড়ছে। গবেষক ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বিআইডিএসে কর্মরত থাকাকালে ১৯৯৪ সালে তথ্য প্রকাশ করেছিলেন যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অতিরিক্ত চিকিৎসা ব্যয় এবং পুলিশের হয়রানির কারণে বাংলাদেশে দরিদ্রতার অবসান হচ্ছে না।

চিকিৎসকরা বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছেন। সোজা কথায়, ঘুষ নিচ্ছেন। তারা আর্থিক বিবেচনায় নির্ধারিত কোম্পানির ওষুধ লেখা ও অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত রোগ নির্ণয় পরীক্ষা করানোর জন্য ক্লিনিক/ল্যাবরেটরি থেকে ৫০-৬০%-এর বেশি কমিশন বাবদ পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ চিকিৎসকরা অতিরিক্ত দামি ওষুধ লিখছেন এবং অতিরিক্ত রোগ নির্ণয় পরীক্ষাও করাচ্ছেন। চিকিৎসকের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রোগীরা আইসিইউ/সিসিইউর সন্ধানে হন্নে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে, এমনকি নাম-গোত্রহীন ক্লিনিকে। কতক হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ভেনটিলেটর, সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা, ডিফিব্রিলেটর, কার্ডিয়াক মনিটর, ইসিজি ও ইকো এবং বিবিধ সিরিঞ্জ পাম্প থাকলেও আইসিইউ পরিচালনার জন্য সার্বক্ষণিক  প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আইসিইউ/সিসিইউ বিশেষজ্ঞ নেই।

অথচ হাসপাতালের বিছানার চাদর, মাস্ক, পেপার গাউন, তোয়ালে, জুতার কভার ও বালিশের কভার পরিবর্তন এবং সময়ে অসময়ে বিভিন্ন চিকিৎসক রোগীকে পরিদর্শন করে রোগী থেকে ফি আদায় করছেন। আইসিইউ/ সিসিইউতে ভর্তি থাকা সময়ে ভেনটিলেটর, কার্ডিয়াক মনিটর, পালস অক্সিমিটার, সিরিঞ্জ পাম্প, ওষুধের ডোজ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র প্রভৃতি ব্যবহারের জন্য আলাদা চার্জ আদায় করা হয়। এটা অনৈতিক ও দুর্নীতির অংশ। দৈনিক কত লিটার অক্সিজেন ব্যবহার করা হয়েছে তার হিসাব নেই, অথচ আইসিইউ বিদায়কালে ৪০ হাজার/৫০ হাজার টাকা অক্সিজেন চার্জ বাবদ রোগী থেকে আদায় করা হয়। দিনদুপুরে ডাকাতি! দুদক কী করছে? উল্লেখ্য, রোগী বা তাদের আত্মীয়স্বজনরা এমনকি চিকিৎসকরা প্রতি হাজার লিটার O2 (অক্সিজেন) ক্রয় মূল্য জানেন না। তাই প্রাইভেট হাসপাতাল মালিকরা রোগীদের ঠকায়, প্রতারণা করে। ফলে প্রতিদিন আইসিইউ বিল বাড়ে দ্রুত গতিতে, যা দৈনিক ৫০ হাজার থেকে দেড় লাখ) টাকাও হতে পারে।

সৌভাগ্যবশত গণস্বাস্থ্য আইসিইউতে এমন একজন দায়িত্বে আছেন যিনি অত্যন্ত নিবেদিত এবং কানাডা, ব্রিটেন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। আইসিইউ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজীব মোহাম্মদ ২০০১ সালে ইউরোপিয়ান ডিপ্লোমা ইন ইনটেনসিভ কেয়ার মেডিসিন অর্জন করেছেন। সম্ভবত বর্তমানে বাংলাদেশে অধ্যাপক নজীবের চেয়ে অধিকতর জ্ঞানসম্পন্ন সিনিয়র কোনো আইসিইউ বিশেষজ্ঞ নেই। পরবর্তীতে তিনি ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট (Critical Care Unit), Liver ITU (ICU) ও Multidisciplinary ICU-তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত হাসপাতালসমূহে এবং সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল ও অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন হাসপাতালে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন এবং বিশেষ কর্মদক্ষতা অর্জন করে দেশে ফিরেছেন।

আইসিইউতে রোগী থাকলে তিনি দৈনিক ১৬-১৮ ঘণ্টা সময় হাসপাতালে কাটান। আইসিইউ বিশেষজ্ঞরা জুনিয়র চিকিৎসক বা নার্সদের ফোন পাওয়ার পর কত দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছেন তার ওপর আইসিইউ রোগীর জীবন নির্ভরশীল। তাকে দ্রুত ডাকার জন্য তিনি হাসিমুখে সব জুনিয়রকে ধন্যবাদ জানান, তাদের সঙ্গে নিয়ে ইন্টার্ন চিকিৎসকদের নিয়ে রোগী দেখেন, রোগী পরীক্ষা করা শেখান এবং পরে আলাদাভাবে প্যারামেডিক, ওয়ার্ডবয়, ক্লিনার এবং রোগীর আত্মীয়স্বজনকে সযতেœ রোগীর সমস্যা বুঝিয়ে বলেন।

সব প্রাইভেট হাসপাতাল মালিক এবং দুর্নীতিতে অংশগ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে। উদাহরণ ছাড়া চরিত্র পরিবর্তন হবে না।

বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ একটিও আন্তর্জাতিক জার্নাল কিনে না পড়ায় তাদের জ্ঞানের পরিধি সীমিত হয়ে যাচ্ছে এবং সহজে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের মিথ্যাচারে বিভ্রান্ত হচ্ছেন, আস্থাহীনতায় ভুগছেন। চিকিৎসকরা ওষুধের মূল্য জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেন না। দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি। বাণিজ্যিক নামের ওষুধে দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে রোগের উপশম না হলে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক বদলিয়ে দেন। প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজনীয়তাই নেই। চিকিৎসকরা ওষুধ লেখেন জিনেরিক নামে নয়, ফলে রোগী ওষুধের প্রকৃত নাম জানতে পারেন না। তারা ওষুধের প্রকৃত দামও জানেন না বলে অপ্রয়োজনে বেশি মূল্যের অধিক পার্শ^প্রতিক্রিয়া সমন্বিত ওষুধসমূহের বিধিব্যবস্থাপত্র লিখে থাকেন। খেয়াল করেন না যে, বিভিন্ন ব্র্যান্ড নামের ওষুধ লিখছেন যা মূলত একই জিনেরিক গোত্রের।

বাংলাদেশের গ্রামে প্রথম স্বাস্থ্যবীমার প্রচলন : স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭৩ সালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র সাভার এলাকায় একই দরের কিস্তিতে (প্রিমিয়ামে) গণস্বাস্থ্য বীমা চালু করে। স্থানীয় প্রতি পরিবার প্রতি মাসে দুই টাকার কিস্তি (প্রিমিয়াম) দিত। বিনিময়ে রোগী বিনা ফি-তে বিবিধ স্বাস্থ্যবীমা সুবিধা পেতেন। যেমন প্যারামেডিক ও চিকিৎসকদের ফ্রি পরামর্শ, ওষুধ এবং রক্ত, পায়খানা-প্রস্রাবের সাধারণ পরীক্ষাসমূহের সুবিধা পেতেন বিনা খরচে। দুর্ভাগ্যবশত এই নীতিতে না দরিদ্র পরিবার না ধনীরা খুশি ছিলেন। মধ্যবিত্ত ও ধনীরা লাইন করে দরিদ্র রোগীর পেছনে দাঁড়াতে অস্বস্তিবোধ করতেন। ধনী ও মধ্যবিত্তরা আলাদাভাবে প্রাইভেটে বাড়িতে ডাক্তার নিয়ে দেখাতে চান। অন্য পক্ষে দরিদ্র রোগীরা মনে করতেন ধনীদের আয় এত বেশি কিন্তু তাদের কাছ থেকেও মাসিক দুই টাকা চাঁদা ধার্য করা যৌক্তিক নয়, গরিবের হক হরণ করা হচ্ছে, তাদের প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে, অবস্থাপন্নদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, খাতির করা হচ্ছে।

একই শ্রেণির স্বাস্থ্যবীমার পরিবর্তে ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার জনসাধারণের সঙ্গে একাধিক আলোচনা সভা করে সাভারসহ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সব কর্ম-এলাকায় সব জনসাধারণকে ৬টি সামাজিক শ্রেণিতে বিভক্ত করে সামাজিক শ্রেণিভিত্তিক গণস্বাস্থ্য বীমা চালু করা হয়- ১. অতিদরিদ্র ২. দরিদ্র ৩. নিম্নমধ্যবিত্ত ৪. মধ্যবিত্ত ৫. উচ্চমধ্যবিত্ত ও ৬. ধনী/উচ্চবিত্ত। স্বাস্থ্যবীমাহীনরা ৭ নম্বরে নিবন্ধিত হন। দরিদ্ররা নগণ্য প্রিমিয়াম দিয়ে বেশি সুবিধা পান, ওপিডিতে পরামর্শ ফ্রি। কিন্তু অবস্থাপন্ন উচ্চবিত্ত পরিবাররা দেন অনেক বেশি প্রিমিয়াম। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখাতে অবস্থাপন্নরা বেশি ফি দেন। অধূমপায়ী দরিদ্র পরিবার দেয় বছরে ২০০ টাকা, অন্য পক্ষে উচ্চবিত্ত ধনী পরিবার স্বাস্থ্যবীমা দেয় বছরে ২ হাজার ৮০০ টাকা, উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবার দেয় ২ হাজার ৪০০ টাকা এবং অধূমপায়ী মধ্যবিত্ত পরিবার দেয় মাত্র ১ হাজার ৮০০ টাকা। এত কম প্রিমিয়ামে পৃথিবীর কোথাও নেই। কিন্তু এ বিষয়ে পরীক্ষা বা প্রচারে সরকারি আগ্রহ কোনোটাই নেই। প্রতি দুই বছর পরপর পর্যালোচনা করে স্বাস্থ্যবীমার প্রিমিয়ামের পরিবর্তন করা হয়।

ঢাকা শহরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাত্র ৪ হাজার ৯৮২টি পরিবারের গণস্বাস্থ্য বীমা আছে। অন্য পক্ষে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গ্রামীণ কর্ম-এলাকায় প্রায় ১৫ লাখ লোকসংখ্যার ২ লাখ ২৮ হাজার ৭৬২টি পরিবারের মধ্যে মাত্র ৪৭ হাজার ৬০৪টি পরিবার গণস্বাস্থ্য বীমা নিবন্ধিত। প্রকৃতপক্ষে যথেষ্ট প্রচারের অভাবে পল্লী এলাকায় গণস্বাস্থ্য বীমার প্রসার হয়নি। ফলে জনসাধারণ একটি আধুনিক জনসেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

কভিড-১৯ রোগের সংক্রমণ ও চিকিৎসা : চীনের সবচেয়ে বড় শিল্পাঞ্চল উহান প্রদেশে ২০১৯ সালের নভেম্ব^রে নভেল করোনা কভিড-১৯ ভাইরাস আত্মপ্রকাশ করে এবং দ্রুত বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে প্রবেশ করে প্রথম মৃত্যু ঘটে ৮ মার্চ, ২০২০ তারিখে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার ২৬ মার্চের সতর্কবাণীকে বাংলাদেশ সরকার গুরুত্ব দেয়নি। ফলে রোগটি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে এবং করোনা রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে মাগুরার চিকিৎসক ডা. খলিলুর রহমান (ফোন- ০১৭১২৮১৯৪০৫, ০১৯৬০৪৬৩৭৩৫) তার অভিজ্ঞতার আলোকে তিন পর্যায়ে ভাগ করে করোনা রোগ ও তার চিকিৎসা সম্পর্কে একটি ছোট লেখা লিখেছিলেন তা শিক্ষণীয় বলে কিছু অংশ আমি পুনরুল্লেখ করছি। ‘কভিড-১৯ একটি স্পর্শকীয় ভাইরাস যা আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশি থেকে বা আশপাশের ৩-৬ ফুটের মধ্যে অবস্থিত বস্তু থেকে ব্যক্তিদের অসতর্কতার কারণে ছড়িয়ে পড়ে। স্টেফাইলো কক্কাস, স্ট্রেপটোকক্কাস, নিউমোকক্কাস প্রভৃতি ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে অন্য ব্যক্তিদের মধ্যে সংক্রমিত হয়। সাধারণত ৩ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে কভিড-১৯ উপসর্গ প্রকাশ পায় তিন পর্যায়ে।

প্রথম পর্যায়ে ১-৩ দিন : শুরু হয় সাধারণ জ্বর, গায়ে মাথায় সামান্য ব্যথা ও শুষ্ক কাশি দিয়ে, যোগ হয় নাক দিয়ে হালকা পানি পড়া, হাঁচি-কাশি ও তৃতীয় দিনে মৃদু শ্বাসকষ্ট। চুলকানি ও হাঁচি-কাশি অ্যালার্জির লক্ষণ।

দ্বিতীয় পর্যায় ৪-৬ দিন : হঠাৎ জ্বর বেড়ে ১০২০ থেকে ১০৪০ ফারেনহাইটে উঠে, শুকনা কাশির সঙ্গে শ্লেষ্মা যুক্ত হয়। সর্বত্র মৃদু ব্যথা বিশেষত গলায়, শ^াসকষ্ট ক্রমান্বয়ে বেড়ে যায়, শ্লেষ্মাসহ হাঁচি-কাশি বৃদ্ধি এবং খাওয়ায় অরুচি ও অনিদ্রা যোগ হয়। নিউমোনিয়ার লক্ষণ প্রকাশমান এবং রোগীর অস্বস্তি বোধের সঙ্গে ভীতি সঞ্চার ও লক্ষণীয়।

তৃতীয় পর্যায় : রক্তে অক্সিজেন সংমিশ্রণ বিভ্রাটে নিউমোনিয়ার সংক্রমণ ও কফ শ্লেষ্মা বৃদ্ধি বুকের ভিতর গড়গড় শব্দ শোনা যায় এবং স্বাভাবিকভাবে শুয়ে থাকায় অসুবিধা হয়; রোগী ক্রমে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

করোনা রোগীর চিকিৎসা ও ব্যয়  : প্রথম পর্যায়ে রোগীকে আলাদা ঘরে রেখে আলাদাভাবে দেখাশোনা করাই মূল কাজ। এলাকার একজন চিকিৎসকের নিয়মিত পরামর্শ নিলে ভালো হয়। প্রায় ৭০ থেকে ৮০ ভাগ রোগী নিরাময় হয় নিজ বাড়িতে স্বল্প খরচে, স্বল্প সময়ে ও ¯েœহ-ভালোবাসায়। বোকামি করতে হবে না একই ওষুধ অকারণে বেশি দামে কিনে, এতে ভালোর চেয়ে অন্য সমস্যাও সৃষ্টি হতে পারে। দিনে ১টি বা ২টি করে ৫০০ মিলিগ্রামের প্যারাসিটামল ট্যাবলেট এক থেকে তিনবার সেবন যুক্তিসংগত। প্যারাসিটামলের সঙ্গে অন্য উপাদান যেমন কেফিন বা ঘুমের ওষুধ মিশ্রিত না থাকা ভালো, এতে অন্য পাশর্^প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালসের প্যারাসিটামল বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশমতো উৎপাদিত, জিনেরিক নাম জি-প্যারাসিটামল, প্রতি ট্যাবলেটের মূল্য ৭০ পয়সা (০.৭০ টাকা) অর্থাৎ ৭ টাকায় ১০টি জি-প্যারাসিটামল কিনতে পাওয়া যায়। অন্য পক্ষে বাণিজ্যিক নামে বাজারজাতকৃত নাপা, নাপা প্লাস, নাপা এক্সট্রা প্রভৃতি এবং অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত উৎপাদনে প্রস্তুত প্রতি ট্যাবলেট ২ টাকা থেকে আড়াই টাকায় বিক্রি হয়। এতে রোগ দ্রুত সারে না, কিন্তু অর্থের অপচয় হয়।

হাঁচি-কাশি অর্থাৎ অ্যালার্জি নিবারণের অ্যান্টি অ্যালার্জির ওষুধ ৪ মিলিগ্রামের ক্লোরফেনারামিন (Chlorpheneramine/G-Antihistamin Tablet) দিনে ১টি করে খেলে ভালো উপকার হয়। প্রতি ট্যাবলেটের মূল্য মাত্র ২৫ পয়সা (অর্থাৎ ১ টাকায় ৪টি অ্যান্টিহিস্টামিন ট্যাবলেট কিনতে পাওয়া যাবে)। গরম চা, মধু ও আদায় গলায় আরাম পাওয়া যায়। চুষে চুষে জি-ভিটামিন জি-২৫০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট দিনে ৩/৪টি খাওয়া যেতে পারে, প্রতি ট্যাবলেট জি ভিটামিন মূল্য ১ টাকা ৩০ পয়সা (১০টি ট্যাবলেটের মূল্য ১৩.০০ টাকা) অনেকে প্রতিদিন ২০ মিলিগ্রামের ১টি বা ২টি জিংক ট্যাবলেট গ্রহণের পরামর্শ দেন, খরচ প্রতি ট্যাবলেট ১.০০ টাকা অর্থাৎ ১০টি জিংক ট্যাবলেটের মূল্য ১০ টাকা। কোয়ারেন্টাইন (একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পৃথক থাকা) রুমে অবশ্যই ১ বোতল ১০০ মিলিলিটারের জাইনানল বা জি-ক্লোরহেক্সাডিন ব্যবহার অবশ্যকর্তব্য। ১০০ মিলিলিটারের মূল্য ১০০ টাকা। সাবানও ব্যবহার করবেন। ভালো উপকার পাওয়া যায় গরম পানিতে কয়েক ফোঁটা টিংচার আয়োডিন কিংবা ইউক্যালিপটাস তেল মিশিয়ে গরম বাষ্প নিলে।

অন্য সমস্যা যেমন পেট বা বুক জ্বালা-পোড়া বা অ্যাসিড ভাব লাগলে দিনে ১টি বা ২টি ২০ মিলিগ্রামের জি-ওমিপ্রাজল ক্যাপসুল সেবন করলে নিরাময় নিশ্চিত। খরচ প্রতি ক্যাপসুলের মূল্য ৩.০০ (১০ ক্যাপসুলের মূল্য ৩০ টাকা)। প্রথম পর্যায়ে নিরাময়ে ব্যর্থ ২০% রোগীকে অবশ্যই নিকটবর্তী সরকারি বা বেসরকারি ক্লিনিক/ হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি হতে হবে। তবে ভর্তির আগে নিশ্চিত হতে হবে যে, সেখানে ছোট অক্সিজেন পালস অক্সিমিটার যন্ত্র এবং রোগীকে প্রয়োজনমাফিক সরাসরি অক্সিজেন দেওয়ার সুবিধা আছে কিনা। রক্তে পরিমিত অক্সিজেন সংমিশ্রিত না হলে রোগীকে মুখে বা নাক দিয়ে অক্সিজেন কিছুক্ষণ দিতে হয়। দেখতে হবে অক্সিজেন সংমিশ্রণ ৯২%-৯৫% মধ্যে যেন থাকে। অতিরিক্ত অক্সিজেন দেওয়া অপচয় তো বটে, অনেক সময় ক্ষতিকরও। ঢাকা বাংলাদেশ মেডিকেল হাসপাতালের মেডিসিনের অধ্যাপক তারিক আলম করোনা পজিটিভ একটি দ্বিতীয় পর্যায়ের রোগীদের প্রতিদিন একটি অ্যান্টি হেলমিনথির আইভারম্যাকটিন যার প্রতি ট্যাবলেটের মূল্য ৫ টাকা এবং ১০০ মিলিগ্রামের ডক্সিসাইক্লিন ট্যাবলেট দিনে দুবার পাঁচ দিন সেবন করিয়ে রোগ নিরাময় লক্ষ্য করেছেন।

হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি প্রথম দিন ইনজেকশন মিথাইল প্রেডনিশোলন ২৫০ মিলিগ্রাম ২টি কিংবা ইনজেকশন ডেক্সামশন ৪ মিলিগ্রাম

(G-Dexamethsone 4 mg Injection) মূল্য প্রতি ইনজেকশন মাত্র ১৫ টাকা দিনে দুবার তিন দিন, খরচ ৯০ টাকা। নিউমোনিয়ার চিকিৎসার জন্য কো-এমক্সিক্লেভ (Co- Amoxiclav) ১-২ গ্রাম দিনে তিনবার কিংবা এরিত্রোমাইসিন/এজিথ্রোমাইসিন কিংবা ক্যাপসুল সেফেক্সিন (G-Cefixime 20 mg, মূল্য ২০ টাকা) পাঁচ দিন সেবনের জন্য দেওয়া হয়। দিনে কয়েকবার গরম জলের বাষ্প বা মেশিনের মাধ্যমে সালবুটামল (G-Salbutamol Solution .05% mg) মূল্য প্রতি ভায়াল ৮০ টাকা কিংবা বুডিসোনাইড (Budesonide 0.5mg) অথবা এনএসিটি (Injection N- Acetyl Cysteine-NAC) সংমিশ্রণে নেবুলাইজার ব্যবহারে শ্লেষ্মা বের করায় খুব উপকার পাওয়া যায়। ব্যয়বহুল অ্যান্টিভাইরাল রেমসিডিসিবির ব্যবহারে নিরাময়ে তিন দিন সাশ্রয় করায়। অন্য অ্যান্টি ভাইরালের ব্যবহারে সুফলের প্রমাণ নেই। অর্থের অপচয় মাত্র। শিক্ষিত পেশাজীবীও প্রতারিত হচ্ছেন অপ্রমাণিত বিভিন্ন ধরনের ওষুধ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায় কিনে, তাদের জ্ঞানচক্ষু কবে উন্মীলিত হবে?

আইসোলেশন ওয়ার্ডে ৮-১০ দিন ভালো নার্সিং সেবা ও নিয়মিত চিকিৎসা পেলে দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রায় সব রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যান, অনধিক ১০% রোগী বিভিন্ন জটিলতা ও একাধিক বিকল অঙ্গের সমস্যা নিয়ে তৃতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করেন। তৃতীয় পর্যায়ের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং মূলত নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউতে চিকিৎসা করাতে হয়। করোনা রোগে মৃত্যুহার ২-৩% সীমিত।

অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্কতা প্রয়োজন : সারা পৃথিবীতে এমনকি উন্নত বিশ্বের চিকিৎসকরা সহজে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সুলভ ওষুধ থাকা সত্ত্বেও অযাচিতভাবে অধিকতর মূল্যের নতুন ওষুধের ভুল প্রয়োগ রহিত করার লক্ষ্যে প্রায়ই পরামর্শ প্রকাশ করে থাকেন। সময়মতো চিকিৎসা না হলে বা চিকিৎসা বিভ্রাট হলে কভিড-১৯ রোগের মূল সমস্যা হাসপাতালে ভর্তির সময় বা ভর্তির ৪৮ ঘণ্টা আগে বাড়ি ও এলাকার পরিবেশ থেকে অর্জিত নিউমোনিয়া অথবা হাসপাতালে অন্য কারণে আগত রোগীরা হাসপাতালের পরিবেশ থেকে অর্জিত সংক্রমণ দ্রুত ফুসফুসের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। সে সমস্যার দ্রুত চিকিৎসার জন্য মে, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক চিকিৎসাবিষয়ক পরামর্শ কমিটির সুপারিশসমূহ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। অ্যান্টিবায়োটিক সাধারণত পাঁচ দিন সেব্য। তবে ক্ষেত্রবিশেষ বিশেষত ফুসফুসের সমস্যায় দু-তিন সপ্তাহ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়।

স্বাভাবিক পরিবেশ থেকে অর্জিত (Community Acquired) : পরিমিত ও তীব্র নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় : মুখে ডক্সিসাইক্লিন ২০০ মিলিগ্রাম প্রথম দিনে এবং দ্বিতীয় দিন থেকে ১০০ মিলিগ্রাম করে বা কো-এমক্সিক্লেব ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে তিনবার সঙ্গে ক্লেরিথ্রোমাইসিন  ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে দুবার সেবন করতে হবে। রোগের তীব্রতা বেড়ে গেলে লেভোফোক্লাসিন ৫০০ মিলিগ্রাম দিনে একবার বা দুবার পাঁচ দিন সেব্য। মুখে সেব্য অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে আন্তঃশিরায় ওপরোল্লিখিত অ্যান্টিবায়োটিকসমূহ ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছেন।

 লেখক : ট্রাস্টি এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র মেডিকেল অফিসার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল।

সর্বশেষ খবর