শুক্রবার, ১৭ জুলাই, ২০২০ ০০:০০ টা

স্মৃতির মণিকোঠায় তুমি অম্লান

নূরে আলম সিদ্দিকী

স্মৃতির মণিকোঠায় তুমি অম্লান

স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যসচিব, স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠক, মুক্তিযুদ্ধের গর্র্বিত সংগঠক জনাব শাজাহান সিরাজ মৃত্যুবরণ করেছেন। ইহজগৎ থেকে পরলোক গমন করলেও স্বাধীনতাযুদ্ধ সংঘটনের গৌরবে চিরঞ্জীব ও কালজয়ী মহান নেতা হিসেবে ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন, ইনশা আল্লাহ। রাজনীতিতে মতের ভিন্নতা থাকলেও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি আমার সহোদরপ্রতিম ছিলেন। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের এককালীন প্রধানমন্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মহান নেতা শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সুযোগ্য সন্তান মো. নাসিমও মৃৃত্যুবরণ করেছেন। নাসিম আওয়ামী লীগের অনন্যসাধারণ জনপ্রিয় নেতাই ছিলেন না, দেশ ও জাতির জন্য নিবেদিতপ্রাণ সত্তা ছিলেন। আমি তার অতি শৈশবকাল থেকে তাকে চিনি। মাটি ও মানুষের সঙ্গে তার নিবিড় মমত্ববোধ আমাকে কেবল মুগ্ধই করেনি, বিস্ময়াভিভূতও করেছে। তার মৃত্যুতে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা হারালেন তাদের সুহৃদকে, দেশ ও জাতি হারাল একজন নিষ্ঠাবান, নিবেদিত, জাতির প্রতি উৎসর্গীকৃত সত্তাকে। এ অভাব অপূরণীয়। আমি তাদের উভয়ের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। ’৭০-এর নির্বাচন ও ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালীন শাজাহান সিরাজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। চলনে-বলনে- আচরণে তিনি ছিলেন সমাজতান্ত্রিক মানসিকতার অনুসারী। তখন সময়টাই ছিল সমাজতান্ত্রিক প্রবহমান মননশীলতার। সারা পৃথিবীর তারুণ্য আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো ফুটন্ত ছিল। শাজাহান সিরাজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সমাজতান্ত্রিক মননশীলতায় কেবল উজ্জীবিতই ছিলেন না, হদয়ের নিভৃত কন্দরে নিজেকে কমিউনিস্ট ভাবতে একটা শিহরণ বোধ করতেন। অন্যদিকে আমি গণতান্ত্রিক মানসিকতার তো বটেই, সমাজতন্ত্রের কঠোর বিরোধী ছিলাম। তখন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে দুটি সুস্পষ্ট ধারা প্রবহমান ছিল। বক্তৃতা-বিবৃতি, মিছিলের স্লেøাগান সবকিছুর মধ্যেই এ দুটি ধারার বহিঃপ্রকাশও ছিল উদগ্র। স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব- এ দুটি প্রশ্নে একটা সৃৃষ্ট যোগসূত্র স্বাধীনতার প্রবহমান চেতনাকে রাখতে পেরেছিল। স্বাধীনতা আসবে কোন পথে, এ নিয়ে মতবিরোধের কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। শাজাহান সিরাজের গুরু সিরাজুল আলম খান, তিনি স্থির লক্ষ্যে কখনোই তার চেতনাকে প্রতিস্থাপিত করতে পারেননি। তবু তিনি ’৭০-এর নির্বাচনের বিপক্ষে ছিলেন। সিরাজুল আলম খানের সব অনুসারী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, বন্দুকের নলই সব ক্ষমতার উৎস। নিবাচন এমনকি ’৭০-এর নির্র্বাচনও একটি প্রহসন মাত্র। নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়া যায়, স্বাধীনতার স্বর্ণসৈকতে তরণি ভেড়ানো যায় না। যারা ভাবতেন, নির্বাচনপূর্বে সশস্ত্র বিপ্লবই স্বাধীনতা অর্জনের মূল অস্ত্র, তাদের মধ্যে আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ নেতৃত্বের অগ্রভাগে ছিলেন। তা সত্ত্বেও আমি নিষ্কলুষ চিত্তে, কৃতজ্ঞ সত্তায় সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত অকপটে বিশ্বাস করি, শাজাহান সিরাজ রাজনীতিতে যেখানেই অবস্থান করুন না কেন, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার প্রতি তার ভালোবাসা, আন্তরিকতা ও ঐকান্তিকতা ছিল প্রগাঢ়। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে যে একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তখনকার ছাত্রলীগের নেতৃত্বে পরিলক্ষিত ও প্রতিভাত হতো, সেটি আমার প্রতি শাজাহান সিরাজের হদয়ের অকৃত্রিম বন্ধনের কারণে কখনোই দেখা যায়নি। নীতি-আদর্শ, বিপ্লব, নির্বাচন- এসব প্রশ্নে মতপার্থক্যে যোজন-যোজন দূরের হলেও শাজাহান সিরাজ তার হদয়ের নিভৃত কন্দরে আমাকে অগ্রজের আসনে অকৃত্রিমভাবে স্থান দিয়েছিলেন বলেই বিভেদটা প্রকট হয়ে প্রকাশ তো করেইনি, বরং একটা আন্তরিকতার আবিরমাখা হয়ে প্রতিভাত হতো। শাজাহান সিরাজ যখন আমাকে আলম ভাই বলে ডাক দিতেন, আমি বিমুগ্ধ তো হতামই, তার অনুসারী ছাত্রলীগের কর্র্মীদের মধ্যেও তা অনেকটা প্রভাব ফেলত। সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার উগ্র নেতা-কর্মীরা অনেক সময় তার নমনীয়তার প্রশ্নে তাকে চ্যালেঞ্জ করলে তিনি তার স্বভাবসুলভ ¯িœগ্ধ হাসি হেসে বলতেন- ‘প্রেসিডেন্ট, রাইট অর রং। সর্র্বোপরি প্রেসিডেন্ট আমার আলম ভাই। তোমরা চাইলেই আমি তার মুখোমুখি তর্ক করতে পারব না।’ পল্টন ময়দান থেকে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানসহ সারা দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জেলায় আমরা জনসভা করেছি, ছাত্রলীগের সম্মেলন একত্রে করেছি। আমি দীর্ঘ সময় ধরে বক্তৃতা করতাম। এটা বদভ্যাস কিনা জানি না। বক্তৃতার প্রাক্কালে আমি বর্ণমালার অতলান্ত সাগরে অবগাহন করতাম। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শাজাহান সিরাজেরও সে সুযোগ ও অধিকার ছিল। আমার আগেই তিনি বক্তৃতা করতেন, কিন্তু কখনোই অধিকারত্ব ফলাননি। আমার প্রতি এক গভীর ভালোবাসায় জনসভার সময় সংরক্ষিত রাখতেন, যেন আমি অবারিত হৃদয়ে আমার কথাগুলো তুলে ধরতে পারি। ছাত্রলীগ বিভক্ত হওয়ার পর বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক ছাত্রলীগ এবং পরে জাসদের কোনো জনসভা থেকেই তিনি কখনো আমার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত বিষোদগার করতে দেননি। প্রসঙ্গত আমি সিরাজুল আলম খান এবং আ স ম আবদুর রবকেও এ ক্ষেত্রে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করতে চাই। তারাও চাইতেন আমি প্রাণ খুলে যেন আমার প্রাণের কথা বলতে পারি। শব্দচয়নে আমি আলঙ্কারিক শব্দই পছন্দ করতাম। প্রাসঙ্গিকতা এনে নানা কবিতার উদ্ধৃতি দিতাম, বক্তৃৃৃতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে উদ্ধৃৃতি দিতাম। এ প্রশ্নে শাজাহান সিরাজের অনুপ্রেরণা আমাকে উদ্বুদ্ধ, উজ্জীবিত ও উদ্বেলিত করত।

শাজাহান সিরাজ আমার কাছে শুধু একটি নাম বা একটি পদই নয়, সে আমার হৃদয়ের ধড়কানি। যত দিন বেঁচে থাকব, প্রতিটি মুহূর্তে নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে হৃদয়ের নিভৃত কন্দরে তার অবিস্মরণীয় স্মৃৃৃতি ও অম্লান সম্মানবোধ আমার হৃদয়ের মণিকোঠায় জাজ্বল্যমান থাকবে। আমরা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ছিলাম না। ব্যক্তিগত সম্পর্কে আমরা ছিলাম পরস্পরের অগ্রজ ও অনুজ। আমাদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্য, মমত্ববোধ ও ঐকান্তিকতার যে পবিত্রতা প্রকাশিত হয়েছে, আজকের ছাত্রলীগের নেতৃত্বের ওপর আল্লাহ তাঁর অসীম রহমতে তা প্রতিফলিত করবেন, এ প্রার্থনা করি

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।

সর্বশেষ খবর