শেরশাহ ভারতবর্ষের সম্রাট (১৫৪০-১৫৪৫) ও শূর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন বিহারের অন্তর্গত সাসারামের জায়গিরদার হাসান খান শূরের পুত্র। ১৪৭২ খ্রিস্টাব্দে তার জন্ম। তার প্রকৃত নাম ফরিদ। অল্প বয়সে গৃহত্যাগ করে তিনি বিহারের সুলতান বাহার খান লোহানির অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। তার সাহস ও বীরত্বের জন্য বাহার খান তাকে ‘শের খান’ খেতাবে ভূষিত করেন। বাহার খানের মৃত্যুর পর তার নাবালক পুত্র জালাল খানের অভিভাবক হিসেবে শের খান কার্যত বিহারের সর্বময় কর্তৃত্ব লাভ করেন। বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে সামরিক সুবিধাজনক স্থানে অবস্থিত চুনার দুর্গ তার অধিকারে আসে। তার ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে জালাল খানের অন্য অমাত্যবর্গ শের খানের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন। এঁদের দুরভিসন্ধিতে প্ররোচিত হয়ে জালাল খান শের খানের আধিপত্য থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য বাংলার সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু শের খান ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দে সুরজগড়ের যুদ্ধে মাহমুদ শাহ ও জালাল খানের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন। এ বিজয়ের ফলে বিহারের ওপর তার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে শের খান বাংলা আক্রমণ করে সুলতান মাহমুদ শাহকে পরাজিত করেন। কিন্তু মুঘল সম্রাট হুমায়ুন বাংলা অভিমুখে অগ্রসর হলে শের খান বাংলা ত্যাগ করেন। ১৫৩৯ খ্রিস্টাব্দে চৌসার যুদ্ধে (বক্সারের কাছে) হুমায়ুনকে পরাভূত করে তিনি ‘শাহ’ উপাধি গ্রহণ এবং বাংলা পুনর্দখল করে খিজির খানকে এর শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। পরের বছর পুনরায় হুমায়ুনকে পরাজিত ও ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করে দিল্লির সিংহাসন অধিকার করেন। মাত্র পাঁচ বছরের স্বল্পকালীন শাসনে শেরশাহ সাম্রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা বিধান করে প্রশাসনকে পুনর্বিন্যাস করেন। তিনি তার সাম্রাজ্যকে ৪৭টি সরকারে এবং প্রতিটি সরকারকে কয়েকটি পরগনায় বিভক্ত করেন।
এ প্রশাসনিক ব্যবস্থায় বাংলায় ১৯টি সরকার ছিল। প্রতিটি সরকারে ‘শিকদার-ই-শিকদারান’ (মুখ্য শিকদার) ও ‘মুনসিফ-ই-মুনসিফান’ (মুখ্য মুনসিফ) খেতাবধারী দুজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়োগ করা হতো। এঁরা শিকদার, আমিন, মুনসিফ, কারকুন, পাটোয়ারী, চৌধুরী ও মুকাদ্দাম প্রমুখ পরগনা কর্মকর্তার কার্যাবলি তদারক করতেন। যথাযথভাবে ভূমি জরিপ করে উৎপাদিত ফসলের এক-চতুর্থাংশ রাজস্ব ধার্য করা হতো এবং এ রাজস্ব নগদ অর্থে অথবা ফসলের অংশ দ্বারা পরিশোধ করতে হতো। তিনিই সর্বপ্রথম ‘পাট্টা’ (ভূমিস্বত্বের দলিল) ও ‘কবুলিয়াত’ (চুক্তি দলিল) প্রথা চালু করে জমির ওপর প্রজার (রায়তের) মালিকানা সুনিশ্চিত করেন এবং কৃষিকার্যে উৎসাহদানের জন্য কৃষককে ঋণদানের ব্যবস্থা করেন।