বুধবার, ২৬ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

মানবসমাজের বৈশ্বিক ঐক্য সময়ের দাবি

খায়রুল কবীর খোকন

মানবসমাজের বৈশ্বিক ঐক্য সময়ের দাবি

আমরা কি এ বিশ্বের মানবসভ্যতাকে কভিড-১৯ দানবের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য সঠিক, দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারছি? প্রশ্নটা এখন বিলিয়ন ডলারের। কারণ, বিশ্বব্যাপী এ পর্যন্ত সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা প্রায় প্রায় ২ কোটি ৩৫ লাখ। প্রাণহানির সংখ্যাও প্রায় ৮ লাখ ২০ হাজার। জুলাইর শেষ প্রান্তে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় বিশ্বব্যাপী রোগ সংক্রমণ ২ লাখ ৭৯ হাজার অবধি উঠে গিয়েছিল, এখন একটু কমেছে। আর প্রতিদিন প্রাণহানি ৭ হাজার সীমা ছুঁয়েছিল এ সময়ে। এখন একটু নিচের দিকে। তবে সামগ্রিক পরিস্থিতির তেমন একটা উন্নতি হয়নি। যদিও করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের টিকা আবিষ্কারের ১৭৩টি উদ্যোগ চলেছে বিভিন্ন বিজ্ঞানী গ্রুপ ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে। তবে টিকার শতভাগ কার্যকারিতা বিশ্ববাসীর কাছে, বিশেষভাবে দরিদ্র দেশগুলো ও অনুন্নত রাষ্ট্রগুলোর অধিবাসীদের কাছে তার সহজলভ্যতা এবং তার ব্যাপক সফল উৎপাদন কার্যক্রম নিয়ে এখনো নানা সন্দেহ রয়েই গেছে।

বাংলাদেশে ২৫ আগস্ট অবধি করোনাভাইরাস সংক্রমণে মোট প্রাণহানি ৪ হাজারে পৌঁছে গেছে। আর ইতোমধ্যে এ দেশে করোনা উপসর্গ নিয়ে যারা প্রাণ হারিয়েছে তার সংখ্যাও প্রায় ২ হাজার। তাদের কেউ গণনায় ধরছে না, যেহেতু করোনা টেস্ট করা হয়নি তাদের। আর যাদের করোনা পরীক্ষা করা হয়নি বা যায়নি তাদের সংখ্যা যে কত তা বলা মুশকিল। অনেকের মতে তাদের মধ্যে সংক্রমণ-সংখ্যা ১ কোটিও হতে পারে।

করোনায় সবচেয়ে খারাপ দশা ব্রাজিল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। এখন করোনা সংক্রমণের চেয়েও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে চিকিৎসার অব্যবস্থাপনা। রোগী ও রোগী স্বজনরা এখানে নিদারুণ অসহায়। এ দেশের স্বাস্থ্য অধিদফতরের আমলাগোষ্ঠী চিকিৎসাব্যবস্থার সবকিছু ধসিয়ে দিয়েছে, নিজেরা দুর্নীতিতে ডুবে গিয়ে কোটি কোটি টাকার রাষ্ট্রসম্পদ দখল করে নিয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য অধিদফতরকে পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের কাজে কোনো সমন্বয় নেই। আর রোগীর চিকিৎসা রেখেছে ‘নিয়তির হাতে সমর্পিত’। বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেই কভিড-১৯ চিকিৎসার দশা বাংলাদেশের মতোই দুর্বল। উন্নত দেশগুলো ছাড়া অন্যসব দেশের মানুষ এখন নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়েছে তার ভাগ্য। এমনকি অনেক উন্নত দেশের মানুষও কভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমণের পর সুচিকিৎসার অভাবে দারুণভাবে হতাশাগ্রস্ত।

পাশাপাশি বিশ্বের দেশে দেশে মধ্যবিত্ত আর নিম্নমধ্যবিত্ত এ ভাইরাস সংক্রমণের প্রাদুর্ভাবের পরিণামে দরিদ্র, আর হতদরিদ্র এবং দরিদ্র মানুষ নিঃস্ব হয়ে রাস্তায় ভাঙা থালা পেতে বসার পথে রয়েছে। কর্মহীনতার টেনশন মানুষকে দিশাহারা করে ছাড়ছে। বিশ্বমন্দা পরিস্থিতি পুরো স্বরূপে পৌঁছার আগেই অর্থাৎ মূল আঘাতের আগেই মানবসমাজ দিশাহারা অর্থনৈতিক দুর্দশার কথা ভেবে, তার আওয়াজ শুনতে পেয়ে। দুঃখ এই যে, হাজার বছরের বিজ্ঞানের উন্নয়ন, প্রযুক্তির অসীম উন্নতি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থাপনায় সীমাহীন অগ্রগতির পরও আজ এ অজানা ভাইরাসটি বিশ্ববাসীকে ‘পোকামাকড়ের’ মতো অসহায় করে ছেড়েছে। কভিড-১৯ সংক্রমণ ঠেকানোর পন্থাগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিচালিত লকডাউন, আর কোয়ারেন্টাইন পদ্ধতির প্রতিরোধব্যবস্থার সাফল্য অর্জনের পথে যে প্রক্রিয়া তা বাস্তবায়নে বিশ্বের কলকারখানা ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়ার ফলে শত কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। আর সেই কর্মহীনতার পরিণতির জন্যই বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার ফলে কোটি কোটি মানুষের দারিদ্র্য এমন পর্যায়ে চলে যেতে পারে, দেশে দেশে অতীতের দুর্ভিক্ষাবস্থার চেয়েও খারাপ দশা হতে পারে। দুর্ভিক্ষে বা নীরব দুর্ভিক্ষে পুষ্টিহীনতায় মারা যেতে পারে লাখ লাখ এমনকি কোটি মানুষ। এমনকি বৈশি^ক অর্থনৈতিক মন্দা অপুষ্টির শিকার বানিয়ে শত কোটি লোকের প্রাণও কেড়ে নিতে পারে অকালে।

বিশ্বের ২১৩টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ গোটা দশেক রাষ্ট্র সংক্রমণ ও প্রাণহানির তথ্য পরিসংখ্যানে একেবারে নিচের দিকের অবস্থানে থাকার স্বস্তি কিছুটা হলেও মানবসমাজকে আশাবাদী করতে পারে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, স্পেন, ইতালি, জার্মানি, রাশিয়া, পেরুসহ অনেক দেশের ভিতরে রোগ সংক্রমণ ও প্রাণহানির খবর বিশ্ব জনতার মধ্যে ভয়ঙ্কর ‘ট্রমা’ সৃষ্টি করে চলেছে।

বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীরা ১০২ বছর আগেকার (১৯১৮ সালের) স্প্যানিশ ফ্লুর সংক্রমণ ও প্রাণহানির (প্রায় ১ কোটি লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল)/বিশ্বের তখনকার ১৫০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে) অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, কভিড-১৯ ভাইরাসটির কার্যকর টিকা আবিষ্কারের ও তা বিশ্বের অন্তত ৯৯ শতাংশ মানুষের ব্যবহারের ব্যবস্থাপনা সফল না হওয়া অবধি এ ভাইরাসটি বিশ্ব থেকে বিদায় না-ও নিতে পারে। তার মানে, এ ভাইরাস আগামী তিন বছর পুরো মাত্রায় বিভিন্ন দেশে রোগ সংক্রমণ ও প্রাণহানি ঘটাতে পারে- সে আতঙ্ক কাটবে না। ওষুধ আবিষ্কারও অনিশ্চিত পর্যায়ে রয়ে যাবে। বিশ্বখ্যাত কোনো কোনো বিজ্ঞানীর মতে কভিড-১৯ ভাইরাস দুনিয়া থেকে পুরোপুরি উচ্ছেদ কখনই সম্ভব না-ও হতে পারে। সে পরিস্থিতিতে কভিড-১৯-এর সঙ্গে অবিরাম লড়াই করতে করতে বাঁচতে হতে পারে মানবসমাজকে। বিশেষভাবে ভাবনার বিষয়, শতভাগ কার্যকর টিকা আবিষ্কার ও তা বিশ্বের শতভাগ মানুষের ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ, বিশ্বে ১২০ কোটি মানুষ এখন ক্ষুধাপীড়িত দশায় প্রতি বেলার খাবারই জোটাতে ব্যর্থ, তারা ভয়ঙ্কর অপুষ্টির শিকার, ন্যূনতম দাম দিয়ে টিকা গ্রহণের সামর্থ্য তাদের আসবে কোত্থেকে! তার ওপর ‘মাফিয়া-দস্যু’ মার্কা ওষুধ কোম্পানিগুলো টিকার দাম এমনও রাখতে পারে যাতে বিশ্বের অর্ধেক মানুষেরই তা কেনার সামর্থ্য না-ও থাকতে পারে। সে অবস্থায় টিকা আবিষ্কারের কার্যকর সুবিধাও পাবে না বিশ্ব মানবসমাজ। কারণ, দুনিয়ার কোনো প্রান্তে কোনো দেশে এ ভাইরাসটির অস্তিত্ব থাকলে তা অন্যসব দেশে সংক্রমণের আতঙ্ক বিরাজমান থাকবে সদা। এসব কারণে বিশ্ব মানবসমাজ এখন কভিড-১৯ আতঙ্কে দিশাহারা।

৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯ (প্রাপ্ত অন্য সূত্রের মতে আগস্ট বা অক্টোবর, ২০১৯) চীনের হুবেই প্রদেশের উহান নগরীর বন্যপ্রাণী বাজারের বনরুই-দেহ থেকে (কিংবা অন্যভাবে) এ নভেল করোনাভাইরাস (পরে দেওয়া নাম ‘কভিড-১৯’) মানবদেহে এবং পরে মানবশরীর থেকে অন্য মানবশরীরে সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। চীনের সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মকর্তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণে বিশ্বে ছড়াচ্ছে জানুয়ারি, ২০২০ থেকে। আট মাসে কভিড-১৯ সংক্রমণ ও প্রাণহানির পরিস্থিতি বিশ্ব মানবসমাজকে একেবারে ‘অসহায় দশায়’ পোকামাকড়ের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে হয়তো মানবজাতি আজ সবচেয়ে বেশি অসহায় বোধ করছে।

অথচ চীন এ ভাইরাস সংক্রমণের এক সপ্তাহের মধ্যেও যদি হুবেই প্রদেশটিকে ‘লকডাউন’ করে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে অন্তত ৫৬ দিন (সর্বোচ্চ ছয় মাস হয়তো লাগতে পারত, সে লকডাউন ব্যবস্থার সাফল্য পেতে) এ ভাইরাস উচ্ছেদ কার্যক্রম চালু রাখতে পারত, তাহলে বিশ্বে এটি ছড়াতে পারত না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও চীন সরকার উহানে এ ভাইরাস সংক্রমণের প্রক্রিয়া (মানবশরীর থেকে মানবশরীরে হাঁচি-কাশির মতো ঘটনায় ছোঁয়াচে প্রক্রিয়ার সংক্রমণ) তথ্য লুকানোর জন্য শতভাগ দায়ী, কিন্তু তারা তা স্বীকার করতে চায় না। এমনকি এ ব্যাপারে একটি আন্তর্জাতিক তদন্তও করতে দিতে রাজি নয় চীন। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন তদন্তের কথা বলেও নিশ্চুপ হয়ে গেছে। তারা সবাই কি চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক স্বার্থে ‘ব্ল্যাক মেইলড’ হচ্ছে? কারণ, চীন তার অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থে কূটনৈতিক নোংরামির চরমে যেতে তৈরি এবং ইতোমধ্যে চীন কভিড-১৯ ভাইরাস সংক্রমণের বাণিজ্যিক সুবিধা পেয়ে গেছে ব্যাপকভাবে। ইউরোপে প্রচুর ভাইরাস প্রতিরোধক সরঞ্জাম বিক্রি করে শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে নিয়েছে। আর বৈশি^ক বাজারে পরোক্ষ সুবিধা অর্জনের প্রচেষ্টা তো অন্য রকম এবং নানারকম আছে- সেসব তো চীনের ভালোই জানা আছে।

একটাই সামান্য স্বস্তির বিষয়, বিশ্বব্যাপী দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান আর হাজার হাজার বিজ্ঞানী ও দানশীল প্রতিষ্ঠান মিলে দারুণ সব গবেষণা কাজ চালিয়ে এ ভাইরাস প্রতিরোধে টিকা আবিষ্কারের এবং চিকিৎসায় ওষুধ আবিষ্কারের জোর লড়াই চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে রাশিয়ায় ভ্যাকসিন বাজারজাত করা হয়েছে। চীন ও অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন বাজারে আসার পথে। সে টিকা দুনিয়ার সব মানুষের জন্য সহজলভ্য করার অসম্ভব কাজটি সম্পন্ন করতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে। কারণ, টিকা ব্যবহারের আর্থিক সংগতি বিশ্বের অর্ধেক মানুষেরই না-ও থাকতে পারে। কভিড-১৯ ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে দরকার মানবজাতির বৈশি^ক ঐক্য। বাংলাদেশ সরকারের ‘একলা চল’ নীতির জন্য সরকারপক্ষ অন্য কোনো রাজনৈতিক দল বা সামাজিক সংগঠনকে একই কর্মকান্ডে যুক্ত করতে চায় না। আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মধ্যে কভিড-১৯ সংক্রমণের প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা দেখা গেল না, কেন? কারণ, রাষ্ট্রীয় গোষ্ঠীস্বার্থ আর গ্রুপস্বার্থ সব সততার ওপর চলে গেছে। আমলাগোষ্ঠী চাটুকারিতা ও স্তাবকতা দিয়ে ক্ষমতাধরদের বশে রাখার চেষ্টা চালায়, লক্ষ্যটা সবারই জানা- অর্থনৈতিক দুর্নীতির মাধ্যমে লাভবান হওয়া এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা তাতে সাফল্য পেয়ে যায়। আর তার ফলে দুর্ভোগ পোহায় মানবসমাজ। কিন্তু সেই মানবসমাজ অনৈক্যের কারণে দুষ্টচক্রগুলোকে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ।

বাংলাদেশের মানুষকে এ ভাইরাস সংক্রমণের নরকতা-ব থেকে রক্ষা পেতে, ভবিষ্যতের টিকা ও চিকিৎসাসুবিধা নিশ্চিত করতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে- সে লড়াই এক্ষুনি শুরু করতে হবে এবং বিশ্ব মানবসমাজকেও তার নেতাদের সক্রিয়তায় সাফল্য অর্জনের পথে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করতে হবে। বিশ্বব্যাপী মানুষ যদি এ রকম ‘কিয়ামত পরিস্থিতি’-তেও ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে তাহলে মানবজনমই বৃথা, সমগ্র মানবসভ্যতাই বৃথা, দুনিয়ার প্রায় ২২৫টি রাষ্ট্র ও খুদে দেশে বছরে লাখ লাখ কোটি ডলার ব্যয় করে শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ, জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চাই বৃথা।

 

লেখক : বিএনপির যুগ্মমহাসচিব

সাবেক সংসদ সদস্য ও

ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর