শনিবার, ২৯ আগস্ট, ২০২০ ০০:০০ টা

এখন সময় উঠে দাঁড়াবার

মাহমুদুর রহমান সুমন

এখন সময় উঠে দাঁড়াবার

মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’র মতো বিপদে পড়েছে  বাংলাদেশ।

করোনায় ঘায়েল হয়ে পড়েছে অর্থনীতি। লাখ লাখ মানুষ বেকারত্বের শিকার। আয় কমেছে অন্তত ২ কোটি মানুষের। সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া কেউই ভালো নেই করোনাকালে।

সুখে নেই ব্যবসায়ী এমনকি শিল্প উদ্যোক্তারাও। কারণটি সোজা। তাদের ব্যবসা নেই। এ দুঃসময়ে একের পর এক বন্যার ছোবল ত্রিশঙ্কু অবস্থা সৃষ্টি করেছে। ১৯৯৮ সালের পর এ বছর বন্যা দেশের বেশির ভাগ জেলায় আঘাত হেনেছে। উপকূলভাগে লোনা পানির প্লাবন হাজার হাজার মানুষের জন্য সর্বনাশ ডেকে এনেছে। এক বছরে তিনবার বন্যার ছোবল দেশের অর্থনীতি তো বটেই সাধারণ মানুষের মেরুদ-ও অনেকাংশে ভেঙে দিয়েছে।

বন্যার কারণে বেড়ে গেছে চাল-ডালসহ নিত্যপণ্যের দাম। সবজির দাম গড়ে তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কাঁচা মরিচের দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে। বন্যা যেমন ফসল নষ্ট করে কৃষককে পথে বসিয়েছে তেমন সাধারণ ভোক্তাদের জীবনযাপনের খরচ আরও এক ধাপ বাড়িয়েছে। বন্যা আমাদের দেশের সাংবৎসরিক সমস্যা। এ সমস্যা ছিল কয়েক শতাব্দী আগেও। আধুনিক যুগেও সে সমস্যা সুযোগ পেলেই জাতির টুঁটি চেপে ধরছে। ১৯৭৪ সালের খাদ্যাভাবের অন্যতম কারণ ছিল বন্যা। এ বছর করোনাকালে পুরো জাতি যখন বিপর্যস্ত, কয়েক কোটি মানুষ যখন জীবন-জীবিকার সংগ্রামে দিশাহারা তখন বন্যা আঘাত হেনেছে প্রচ-ভাবে। সমুদ্রপ্রান্তে বাঁধ ভেঙে এমনই সর্বনাশ ডেকে এনেছে যে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালীসহ আরও কয়েকটি জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় লোনা পানি ঢুকে হাহাকার অবস্থা সৃষ্টি করেছে।

বন্যা সাংবৎসরিক সমস্যা হলেও এর হাত থেকে নিজেদের সুরক্ষায় এখন পর্যন্ত টেকসই কোনো পরিকল্পনা হাতে নেওয়া সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি উপকূল রক্ষায় একই ধরনের সীমাবদ্ধতা বিরাজ করছে।

তিন দফা বন্যার পর পানি দেশের বেশির ভাগ উপদ্রুত এলাকা থেকে নামতে শুরু করেছে। এখন দ্রুত কৃষি পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মেরামতে নিতে হবে উদ্যোগ। রাস্তাঘাট চলাচল উপযোগী করাও সরকারের কর্তব্য বলে বিবেচিত হওয়া উচিত।

সাংবৎসরিক বন্যা জাতির জন্য অভিশাপের বদলে আশীর্বাদ বয়ে আনতে পারে। এজন্য নদ-নদী খনন করে পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে। টেকসই বাঁধ নির্মাণ করতে হবে নদ-নদী রক্ষায়। সে বাঁধের দুই পাশে লাগাতে হবে খেজুর, তাল, নারকেল জাতীয় গাছ; যা বাঁধের মাটি ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়াবে। বাঁধগুলোকে একই সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে রাস্তা হিসেবে; যা এগুলোর সংরক্ষণের পাশাপাশি যোগাযোগব্যবস্থার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে।

এ বছর বন্যা ও সমুদ্রে নিম্নচাপের কারণে উচ্চমাত্রার জোয়ারে উপকূল-ভাগের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গত মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ল-ভ- করে দেয় উপকূলের বেড়িবাঁধগুলো। বাঁধ ভেঙে হু হু করে পানি ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। তলিয়ে যায় উপকূলীয় এলাকার ফসলি জমি। ভেসে যায় হাজার হাজার মাছ ও চিংড়ি ঘের। বরিশাল বিভাগের ছয় জেলার ৫৮টি স্থানের ৬৫০ মিটার বাঁধ পানির তোড়ে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত এবং আংশিক ক্ষতি হয় ১৬১টির। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের পরিমাণ ১৬১ কিলোমিটার। নদীর পাড় ভেঙেছে ১০টি স্থানে। এর দৈর্ঘ্য ২ কিলোমিটারের বেশি। সাতক্ষীরার চার উপজেলার ২০টির বেশি পয়েন্টে নদ-নদীর গ্রামরক্ষা বেড়িবাঁধ ভেঙে বিলীন হয়ে যায়। শ্যামনগরের পদ্মপুকুর, গাবুরা ও আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়নের কয়েকটি স্পটে কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। কক্সবাজারের কুতুবদিয়া ও মহেশখালীর বিভিন্ন এলাকায় সমুদ্র-তীরবর্তী বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাগেরহাটের বেড়িবাঁধ। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বড় ত্রুটিটি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে যে যাচ্ছেতাই ধরনের দুর্নীতি ঘটে তারই প্রমাণ মেলে উপকূলভাগের বিপুল পরিমাণ বাঁধ ভেঙে যাওয়ার ঘটনায়। ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকায় ত্রাণকাজ করতে গিয়ে প্রশাসনের লোকজন যে গণদাবির সম্মুখীন হয় তা হলো ‘আমাদের ত্রাণের দরকার নেই। ঠিকমতো বাঁধ বেঁধে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।’ দেশের উপকূলীয় ও হাওর এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণে শত শত কোটি টাকা ব্যয় হয়। এ অর্থের শতকরা ৭০ ভাগই চুরি ও অপচয়ের শিকার হয়। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বছরের পর বছর ধরে দাবি উঠছে বেড়িবাঁধ নির্মাণে এলাকাবাসীকে সম্পৃক্তের, তাদের নিয়ে গণকমিটি করার। তাদের দ্বারা বাঁধ নির্মাণ ও স্বেচ্ছাশ্রমের উদ্যোগ নেওয়া হলে মাত্র ২০ শতাংশ খরচে যে মজবুত বাঁধ গড়ে উঠবে, তাতে প্রতি বছর মেরামতের নামে লুটপাটের অবকাশ থাকবে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের মধ্যে সক্রিয় আরব্য উপন্যাসের ‘থিপ অব বাগদাদ’ মহোদয়দের সর্বনাশা খাদক আচরণও বন্ধ হবে। দেশবাসীর ট্যাক্সের টাকায় অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে নিশ্চিতভাবে। সে বিষয়ে নজর দেওয়া হয়নি বলেই আম্ফানের আঘাত কাটিয়ে ওঠার আগেই ভাঙা বাঁধ আরও ভেঙে উপকূলীয় এলাকায় লোনা পানি ছোবল হানতে পেরেছে। আশা করব এবারের বন্যা থেকে আমরা শিক্ষা নেব। নদ-নদী খনন ও বাঁধ নির্মাণে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। করোনা  ও বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে জাতি যাতে একসঙ্গে কাজ করতে পারে এমন পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। এজন্য দরকার দেশের সব সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির ঐক্য। সে পরিবেশ নিশ্চিত করতে রাজনীতিতে সহিষ্ণুতার হাওয়া বইয়ে দেওয়ার উদারতা দেখাতে হবে সরকারকে। বুঝতে হবে এখন করোনাভাইরাস ও বন্যাজনিত ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সময়। সোজা হয়ে দাঁড়াবার সময়।

লেখক : কলামিস্ট।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর