পাশাপাশি দুই গ্রামের মানুষের মধ্যে সব বিষয়েই তীব্র প্রতিযোগিতা। দুই গ্রামে দুটি স্কুল আছে। সেই দুই স্কুলের দুই শিক্ষক ঘিরে তাদের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। একবার ঠিক হলো দুই গ্রামের মাঝখানের মাঠে দুই শিক্ষকের মধ্যে প্রতিযোগিতা হবে। যিনি প্রতিপক্ষের প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারবেন তিনিই জয়ী। ভুল উত্তর দিলে হার। এক গ্রামের শিক্ষক খুব চতুর। তিনি প্রতিপক্ষের শিক্ষককে বললেন, আমি আপনাকে প্রশ্ন করব। আপনি জোরে সবাইকে শুনিয়ে উত্তর দেবেন। তিনি জানতে চাইলেন, বলুন তো I don’t know অর্থ কী? সহজ-সরল-বোকা প্রতিপক্ষের সেই শিক্ষক জোরে চিৎকার করে বললেন, আমি জানি না। ব্যস, প্রতিপক্ষের লোকজন চিৎকার শুরু করল, জানে না, জানে না। তারা বিজয়োল্লাস শুরু করল। বোকা মাস্টারের গলার স্বর হারিয়ে গেল। জিতেও হেরে গেলেন তিনি।
চতুর কাঠমোল্লারা বাংলাদেশের সহজ-সরল সাধারণ মানুষের সঙ্গে এ খেলাটা খেলছে। তাদের প্রশ্নটা হলো- ইসলাম। দিনের পর দিন তারা এমন একটা ধারণা তৈরি করেছে, ইসলাম নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না এবং সাধারণ মানুষের ইসলাম নিয়ে কিছু বলার বা কৌতূহল দেখানোরও অধিকার নেই। তারা শুধু নামাজ-রোজা করবে এবং হুজুরদের চাপিয়ে দেওয়া মত মেনে চলবে। যেন মাদরাসায় কিছু আরবি মুখস্থ করা, আর আরবীয় পোশাক পরা মোল্লাদের কাছে ইসলামকে লিজ দেওয়া হয়েছে। তারা যা বলবে, তাই মানতে হবে। না মানলে বা প্রশ্ন তুললেই নাস্তিক, মুরতাদ, কল্লা ফেলে দাও। অথচ বাংলাদেশের সবাই তো বটেই; বিশ্বের যে কোনো মানুষের ইসলাম ধর্ম নিয়ে পড়ার, গবেষণা করার, প্রশ্ন করার অধিকার রয়েছে। আর এখন ইন্টারনেটে খুঁজলেই এত কিছু পাওয়া যাবে, যা পড়ে এক জীবনে শেষ করা যাবে না। কিন্তু কাঠমোল্লারা ইসলামের ওপর তাদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া করতে দিতে রাজি নয়। নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতেই তারা সহজিয়া শান্তির ধর্মকে কঠিন করে তুলছে। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তারা সাধারণ মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দিতে চায়। এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না, ওটা হালাল, ওটা অবৈধ- এমন হাজারটা নিষেধের বেড়াজালে তারা ইসলামকে বন্দী রাখতে চায়। যখনই আপনি প্রশ্ন করবেন, জানতে চাইবেন, বিভ্রান্তি ঘোচাতে চাইবেন, তখনই তারা আপনার বিলো দ্য বেল্ট আঘাত করবে- ওই মিয়া! তোমার দাড়ি নাই কেন, তুমি টুপি পর নাই কেন, তুমি টাকনুর নিচে প্যান্ট পরছ কেন। ওই মেয়ে তোমার মাথায় ঘোমটা নাই কেন, হিজাব নাই কেন? হাজারটা প্রশ্ন করে আপনার প্রশ্ন করার মনোবল নষ্ট করে দেবে। আপনি নিজের প্রশ্ন ভুলে তাদের প্রশ্নবাণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতেই ব্যস্ত হয়ে যাবেন।
একদম লালসালুর মজিদ স্টাইল। ৮০ বছর আগে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যা লিখেছিলেন, এখনো তা সত্যি। বরং সমাজে মজিদদের দাপট যেন দিন দিন বাড়ছে। এ বাংলাদেশে এখন ধর্মের চেয়ে আগাছা বেশি। আধুনিককালের এ ধর্ম ব্যবসায়ী মজিদরা এখন ইসলামের সবচেয়ে বড় শত্রু। তারা দিনের পর দিন ওয়াজের নামে অশ্লীলতা ছড়াচ্ছে, ইসলামের অবমাননা করছে।১৪০০ বছর আগে এলেও ইসলাম একটি সম্পূর্ণ জীবনব্যবস্থা। বিশ্বের কোটি কোটি শান্তিপ্রিয় মানুষ ইসলামেই মুক্তি খুঁজেছে। কিন্তু উগ্র মৌলবাদীরা ইসলামকে সন্ত্রাসের ধর্ম বানানোর চেষ্টা করছে। নারীদের ঘরে আটকে রেখে উন্নয়ন রুদ্ধ করতে চাইছে। ইসলাম সম্পর্কে মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দিতে চাইছে। তাদের নিষেধাজ্ঞার তালিকা বহু লম্ব^া। সব মানতে গেলে জীবন চলবে না। মুসলমানরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে, রোজা রাখবে, জাকাত দেবে, সামর্থ্যে কুলালে হজ করবে। আর সৎ পথে চলবে, দুর্নীতি করবে না, নারী নির্যাতন করবে না, মানুষকে ঠকাবে না, ভিন্ন ধর্মের মানুষকেও মর্যাদা দেবে। ব্যস, এটুকুই একজন ভালো মুসলমানের কর্তব্য। একজন ভালো মুসলমানের হাত থেকে সব মানুষ নিরাপদ, তার জিব থেকে সব বিশ্বাস নিরাপদ। কিন্তু এখন যারা ইসলাম নিয়ে ব্যবসা করছে, তাদের দেখলে অন্য ধর্মের লোকেরা তো বটেই মুসলমানরাও ভয় পাবে।
দেশে এখন হাজারটা সমস্যা। কোনো সমস্যার ব্যাপারেই ধর্ম ব্যবসায়ীদের মাথাব্যথা নেই। দেশজুড়ে যখন ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন চলছিল তখনো মুখ খুলতে দেখা যায়নি। ফ্রান্সে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে অবমাননায় কোটি মুসলমানের মতো আমিও ব্যথিত হয়েছি। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু মামুনুল হক যখন মূকাভিনয় করে মহানবী (সা.) কীভাবে কথা বলতেন তা ব্যঙ্গ করে দেখায়, তখন কোনো মুসলমানের অনুভূতি আহত হয় না। ইসলামী লেবাস ধারণ করা মামুনুল হকরা চাইলেই যেন ইসলামের নামে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। মামুনুল যে ভঙ্গিতে মহানবী (সা.)-এর অবমাননা করেছে, সাধারণ কেউ করলে এতক্ষণে তাকে পিটিয়ে-পুড়িয়ে মারার জন্য চাপাতি হাতে ঘুরত উগ্র মৌলবাদীরা। লালমনিরহাটে যখন একজন নামাজি মুসলমানকে পিটিয়ে-পুড়িয়ে মেরে ফেলা হলো, কোনো ‘আলেম’কে প্রতিবাদ করতে দেখিনি। দেশে দুর্নীতি, নারী নির্যাতন, ঘুষ, অর্থ পাচার চলছে। কোনো আলেম কোনো দিন প্রতিবাদ করেননি। মাদরাসায় ছাত্র ধর্ষণের ঘটনা ঘটে আসছে অনেক আগে থেকেই। ইদানীং মিডিয়ার কল্যাণে নিয়মিত তা প্রকাশিত হচ্ছে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অনেকে গ্রেফতারও হচ্ছেন। মাদরাসার ধরা না পড়া ধর্ষকরাই কিন্তু ইসলামী লেবাস আর মুখস্থ করা কিছু আরবি আয়াতের সুবাদে ইসলামের লিজ নিয়ে নেওয়া ‘আলেম’ বনে যান। মাদরাসায় দিনের পর দিন এ যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনো আলেমকে মুখ খুলতে দেখেছেন? আচ্ছা একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে, একজন মানবিক মানুষ হিসেবে বলুন তো আপনার কাছে হাজার বছর ধরে চলে আসা ভাস্কর্যটা সমস্যা নাকি মাদরাসায় দিনের পর দিন যৌন নির্যাতনটা বড় সমস্যা? ইসলামের সত্যিকারের আলেমদের দায়িত্ব এখন অনেক বেশি। তারাই পারেন এ উগ্রবাদীদের হাত থেকে শান্তির ধর্ম ইমলামকে রক্ষা করতে। ইসলাম যে ভয়ংকর কোনো ধর্ম নয়, ইসলাম যে শান্তির ধর্ম তার বাণী আরও বেশি করে ছড়িয়ে দিতে হবে।
আমাদেরই কারও কারও নীরব বা সরব প্রশ্রয় আর লাইয়ের সুবাদেই মামুনুল গং আজ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার হুমকি দিতে সাহস পায়। তাদের উসকানিতেই কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার সাহস পায় দুর্বৃত্তরা। তাদের বাড় এতটাই বেড়েছে, তাদের আক্রমণের মুখে অসাম্প্রদায়িক মানুষ আজ ভাস্কর্য না মূর্তি এ যুক্তি প্রমাণে ব্যস্ত। বিশ্বের কোন কোন দেশে ভাস্কর্য আছে, কোন মসজিদের সামনে কোন কৃতী মুসলমানের ভাস্কর্য আছে তা দেখিয়ে বাংলাদেশে ভাস্কর্য থাকার যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করছেন। এই যে আমাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের নানা যুক্তি, এটাই কিন্তু মৌলবাদী গোষ্ঠীর এক ধরনের বিজয়। ব্যাপারটা এমন নয়, আজ প্রথম বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গেই ভাস্কর্য শিল্পের বিকাশ ও বিস্তার। বিশ্বজুড়েই ভাস্কর্য এক অসাধারণ শিল্প। বিশ্বের সব দেশেই ভাস্কর্য শিল্প সে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ধারণ করে আছে। আসলে বিমানবন্দরে লালনের ভাস্কর্য স্থাপন থেকে সরে আসার মধ্য দিয়েই মৌলবাদীদের আমরা ছাড় দিতে শুরু করেছি। তাদের দ্বিতীয় বিজয় হাই কোর্ট চত্বর থেকে ভাস্কর্য সরানো। তখনই প্রয়াত জাসদ নেতা মইনউদ্দিন খান বাদল আশঙ্কা করেছিলেন, একদিন তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য সরাতে বলবে।
তাঁর আশঙ্কা সত্যি হয়েছে। এরপর তারা অপরাজেয় বাংলা সরাতে বলবে, শহীদ মিনার সরাতে বলবে, স্মৃতিসৌধ সরাতে বলবে। অথচ ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত এ বাংলাদেশে একাত্তরের পরাজিত শক্তির এত ঔদ্ধত্য থাকার কথা ছিল না।
আমরা যখন বলি ভাস্কর্য আর মূর্তি এক নয়, তখন মনের অজান্তেই কিন্তু আমরা বলে দিচ্ছি, ভাস্কর্য থাকতে পারবে, মূর্তি থাকতে পারবে না। এ উগ্রবাদীরা দুর্গাপূজার সময় দেশজুড়ে মূর্তি-প্রতিমা ভাঙার উৎসবে মেতে ওঠে। আমরা যেন ভাস্কর্য না মূর্তি এ বিতর্কে তাদের সে উৎসবকে জায়েজ করে দিই। অথচ এ বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। স্বপ্ন ছিল সবার জন্য বাসযোগ্য একটি দেশ গড়ার। অথচ মৌলবাদীদের কথা শুনলে মনে হয় দেশটা শুধু মুসলমানদের। অথচ আবহমান কাল ধরে এ বাংলায় সব ধর্মের মানুষ নির্বিঘ্নে নিজ নিজ ধর্ম পালন করছে।
বিশ্বের কোন কোন দেশে ভাস্কর্য আছে, এ যুক্তির জবাবে মৌলবাদীরা বলে, বিশ্বের অন্য দেশে যাই থাকুক, বাংলাদেশে ভাস্কর্য বা মূর্তি কিছুই থাকবে না। তাদের এবার দাঁতভাঙা জবাব দিতে হবে। বলতে হবে, ৩০ লাখ শহীদের রক্তে অর্জিত এ বাংলা নির্দিষ্ট কোনো ধর্মের মানুষের নয়। এখানে ভাস্কর্য তো থাকবেই, মূর্তিও থাকবে। এখানে ওয়াজ থাকবে, পালাগান থাকবে। এখানে নামাজ থাকবে, পূজাও থাকবে। এখানে হামদন্ডনাত থাকবে, জারি-সারি-ভাটিয়ালিও থাকবে।
সব মানুষের বিশ্বাস কখনো এক হবে না, ধর্ম কখনো এক হবে না। মতের ভিন্নতা থাকবে, যুক্তি থাকবে-পাল্টা যুক্তি থাকবে। বৈচিত্র্যেই সভ্যতার আসল সৌন্দর্য। আর বাংলাদেশ হলো বৈচিত্র্যের এক অনন্য সৌন্দর্যের আধার। যে কোনো মানুষের ধর্ম পালন করার, বিশ্বাস করার অধিকার যেমন থাকবে; বিশ্বাস না করার অধিকারও থাকতে হবে। আমরা কেউ যেন কারও বিশ্বাসে, কারও অনুভূতিতে আঘাত না দিই। আমাদের আবার গলা ছেড়ে গাইতে হবে- চাষাদের, মুটেদের, মজুরের/গরিবের নিঃস্বের ফকিরের/আমার এ দেশ সব মানুষের, সব মানুষের/নেই ভেদাভেদ হেথা চাষা আর চামারে/নেই ভেদাভেদ হেথা কুলি আর কামারে/হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান/দেশ মাতা এক সকলের আমার এ দেশ সব মানুষের।
লেখক : সাংবাদিক।