শিরোনাম
বুধবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

নারী জাগরণের ইতিকথা

ওয়াহিদা আক্তার

নারী জাগরণের ইতিকথা

বিশ শতকে বাঙালি সমাজের সবচেয়ে বড় অর্জন নারী জাগরণ। এখন সমাজ-সংসারে বা দেশে নারীর যে অবস্থান ৫০ বছর আগে তা কল্পনা করা যেত না। নারীর অবস্থান উন্নত হওয়ার পেছনে যে কারণ সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে তা হলো নারী শিক্ষার প্রসার। নারী শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে কর্মজীবী মহিলার সংখ্যাও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। যে স্তরের শিক্ষায় শিক্ষিত হোক না কেন প্রত্যেক নারীই সমাজে কোনো না কোনোভাবে কর্মের সঙ্গে সংযুক্ত। তারা পরিবার এবং সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। নারী শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি নগরায়ণ ও শিল্পায়ন তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে ফলে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে নারী-পুরুষের লিঙ্গবৈষম্য ভারসাম্য পর্যায়ে চলে এসেছে। বাংলাদেশের ক্ষমতার শীর্ষ পর্যায়ে নারী নেতৃত্ব দিচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের সর্বস্তরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীদের ওপর আস্থা রেখে নারীর ক্ষমতায়নে সরাসরি অবদান রেখে চলেছেন। আমাদের দেশের নারীর ক্ষমতায়নে অন্যান্য দেশও বিস্মিত।

শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। যতবার তিনি ক্ষমতায় এসেছেন নারীর ক্ষমতায়নে নতুন নতুন উদ্ভাবনী পদক্ষেপ নিয়েছেন। নারী স্পিকার, নারী বিচারপতি, নারী জেলা প্রশাসক, নারী পুলিশ সুপারসহ শত পেশায় শত প্রথমা নারী শেখ হাসিনারই অবদান বলা যায়। তিনি প্রমাণ করেছেন কোনো পেশাতেই নারী অযোগ্য নয়। নারীবান্ধব নীতিমালা, আইন ও অনুশাসনে তিনি কর্মজীবী নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করেছেন। মেয়েদের দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা, উপবৃত্তির টাকা সরাসরি মায়ের হাতে; মহিলাদের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ ৬০% কোটা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি পর্যন্ত রাখাসহ যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের নারী শিক্ষায় বিপ্লব সাধিত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের অংশ হিসেবে দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে একজন নারী জেলা প্রশাসক বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চ জেলার ১ হাজার ৭০০ কিশোরী মেয়েকে ১ হাজার ৭০০ বাইসাইকেল বিতরণ করে তাদের নাম দিয়েছেন ‘কন্যারত্ন’। ‘সুস্থ কিশোরী, নিরাপদ আগামী’ স্লোগানে তারা প্রশাসনের দূত হিসেবে তাদের সমবয়সী কিশোরীদের কাছে প্রজনন স্বাস্থ্যসহ বাল্যবিয়ের কুফল প্রচারে কাজ করছে। উত্তরাঞ্চলের স্কুল-কলেজের মেয়েরা স্কুল বা কলেজ ড্রেস পরে দলে দলে সাইকেল নিয়ে দূরদূরান্তে স্কুল-কলেজে যায়। তাদের মাথা উন্নত, মনে আত্মবিশ্বাস। এ অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখার জন্য আমৃত্যু যিনি স্বপ্ন দেখেন তিনি বেগম রোকেয়া। উত্তরবঙ্গের রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্ম নেন এই ক্ষণজন্মা নারী। আজকের মুসলিম নারী জাগরণের তিনি অগ্রদূত। তমসাচ্ছন্ন নারী জাতির কাছে শিক্ষার আলোকবর্তিকা নিয়ে আসেন তিনি। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া দিবস পালিত হয়। নারী শিক্ষায় বা নারীকল্যাণে অবদান রাখায় গুণী নারী নির্বাচন করে দেওয়া হয় ‘রোকেয়া পদক’। এ উপমহাদেশের নারী আমরা বেগম রোকেয়াকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করি। তিনি উর্দু ও ফারসি ভালো জানতেন। কিন্তু বাংলা ভাষায় তাঁর সাহিত্য ‘অবরোধবাসিনী’, ‘মতিচূর’সহ অসংখ্য প্রবন্ধ প্রকাশ করে বাংলার নারীসমাজকে শিক্ষার আলো জ্বালাতে অনুপ্রেরণা জোগান।

বিশ শতকের আগে ধনী-দরিদ্র কোনো মহিলার শিক্ষার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ব্যবস্থা ছিল না। দু-চারটি ব্যতিক্রম ছাড়া তখন পর্যন্ত খুব অল্প বয়সে বা অধিকাংশ মেয়ের আট-দশ বছরে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হতো। বিয়ের উদ্দেশ্যই ছিল ‘পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা’। মানে পুত্র লাভের জন্য স্ত্রী গ্রহণ। মেয়েদের সন্তান লালনপালন ও গৃহকর্মে নিপুণা করে তৈরি করা হতো। মেয়েরা তাদের স্বামীসেবা, সন্তান লালনপালন, গৃহকর্ম, পরিবারের সদস্যদের সেবার মধ্যেই জীবনের সব উদ্দেশ্য নিহিত বলে মেনে নিত। বৃহত্তর সমাজে মেয়েদের বিয়ের বয়স না বাড়লেও উনিশ শতকের শেষ দিকে শিক্ষার কারণে মেয়েদের বিয়ের বয়স কিছুটা বিলম্বিত হয়। প্রথম দিকে সামাজিক মর্যাদায় অভিজাত শ্রেণির কিছু হিন্দু ও খ্রিস্টান নারী একজন দুজন করে শিক্ষার দিকে এগিয়ে আসেন।

প্রাচীন বাংলার ঐতিহাসিক সূত্রে নারী শিক্ষার বিষয়ে চমকপ্রদ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। রাজা রামমোহন রায় ১৮১৯ সালে পুরুষদের উদ্দেশ করে লেখেন, ‘পুরুষরা কি কখনো মহিলাদের মননশক্তি আছে কিনা তার পরীক্ষা নিয়েছেন?’ ১৮২১ সালে গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার সপক্ষে ‘স্ত্রী শিক্ষা বিষয়’ নামে একটি বই লেখেন। তিনিও তাতে সমাজপতিদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, লেখাপড়া শেখার জন্য যে মননশক্তি প্রয়োজন মেয়েদের তা আছে এবং তাদের লেখাপড়া শেখানো উচিত। মেয়েরা যাতে উপযুক্ত জীবনসঙ্গিনী হয়ে উঠতে পারেন এবং যথার্থভাবে সন্তান লালনপালন করতে পারেন তার জন্য শিক্ষার প্রয়োজন- এই ধারণা প্রসার লাভ করে ১৯৩০ সাল থেকে। অশিক্ষিত স্ত্রী নিয়ে সংসার করা যে বিড়ম্বনা তা অনুভব করলেও প্রকাশ্যে স্ত্রী শিক্ষা দেওয়ার মতো সাহস কারও ছিল না।

১৮৪০ সালে স্ত্রী শিক্ষার পক্ষে পত্রিকায় লেখা প্রকাশ হতে থাকে। ১৮৪৯ সালে উচ্চবর্ণের হিন্দু মেয়েদের জন্য বেথুন স্কুল স্থাপিত হয় রক্ষণশীল সমাজপতিদের তীব্র সমালোচনা ও বাধার মুখে। উচ্চবর্ণের হিন্দু ও খ্রিস্টান ছাড়া বেথুন স্কুলে মুসলমান কোনো নারীর ভর্তির সুযোগ ছিল না। মুসলিম নারীদের মধ্যে শিক্ষার বিকাশ ঘটে হিন্দু নারীদের ৫০-৬০ বছর পরে। তখন হাতে গোনা যে কজন মুসলমান মেয়ে লেখাপড়া শেখেন তারা ছিলেন নিতান্তই ব্যতিক্রম।

১৮৬৩ সালে ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকা প্রকাশ হতে শুরু করে। এ পত্রিকায় মেয়েদের রচনা নিয়মিত প্রকাশ হতো। প্রথম ৪০ বছরে একজনমাত্র মুসলমান মেয়ের লেখা প্রকাশ হয় তাঁর নাম তাহেরন নেছা। নওয়াব ফয়জুন নেছা শিক্ষক রেখে আরবি, ফারসি, বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা শেখেন। তিনি প্রথম মুসলিম মহিলা যিনি কুমিল্লায় মেয়েদের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলেন। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৩১ সালে যা উচ্চবিদ্যালয়ে পরিণত হয়।

১৮৮০-এর দশকে হিন্দু ও খ্রিস্টান মহিলারা রীতিমতো উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করেন এবং চাকরিতে ঢোকেন। হিন্দু নারী কাদম্বিনী প্রথম ডাক্তারি পাস করেন। তখনকার শিক্ষিত মেয়েরা নারী শিক্ষা বিস্তারে শিক্ষকের প্রয়োজন হওয়ায় শিক্ষকতা পেশা বেছে নেন। ব্যতিক্রম যেসব মহিলা সেখানে লেখাপড়া শেখেন, আত্মীয়স্বজন ও পন্ডিতদের কাছ থেকে। রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের বড় বোন করিমুন্নেসাও বাড়িতে আরবি ও ফারসি শেখেন। কিন্তু বাংলা ও ইংরেজি শেখেন ১৮৬৯ সালে তাঁর বিয়ের পর স্বামীর উৎসাহে এবং শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের কাছে। আর ১৮৮৮-এর দশকে বেগম রোকেয়া একান্ত গোপনে লেখাপড়া শেখেন বোন করিমুন্নেসা ও বড় ভাইয়ের সাহায্য নিয়ে। ১৮৯৬ সালে বিয়ের পর স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের কাছ থেকে বেগম রোকেয়া ভালোভাবে ইংরেজি শেখেন। স্বামীর মৃত্যুর পর ১৯০৯ সালে তিনি শ্বশুরবাড়ি বিহারের ভাগলপুরে প্রথম বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করে মুসলমান মেয়েদের শিক্ষা দিতে চেষ্টা করেন। তখন ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে সমাজপতিদের প্রবল বাধার সম্মুখীন হন মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদূত এই মহীয়সী নারী। মুসলিম নারীদের ভয়াবহ পর্দাপ্রথা মেনে চলতে হতো। অনেক সময় তাদের বোরকায় চোখের জালিও থাকত না। অন্তঃপুরে অনাত্মীয় কোনো মহিলাকে দর্শন দেওয়াও নিষেধ ছিল। মুসলিম নারীদের জীবন দুর্বিষহ ছিল। কিন্তু তারা নীরবে মেনে নিত যে এটাই তাদের জীবন! এটাই তাদের নিয়তি! বেগম রোকেয়ার মন কেঁদে ওঠে। তিনি অনুভব করেন শিক্ষার আলো প্রয়োজন এসব নারীকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন জীবন থেকে মুক্তি দিতে। তিনি লেখনীর মাধ্যমে সমাজকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, শিশু বয়ঃপ্রাপ্ত হলে নারীতে রূপান্তরিত হয়। সংসার জীবনে নারীর বহুরূপে অবস্থান কন্যা, জায়া, জননী, ভগিনী যে রূপেই বলা হোক সে ভবিষ্যৎ বংশধরদের মাতা ও গৃহশিক্ষক। তার শিক্ষা গ্রহণ জরুরি; অভাবনীয় এবং কল্পনাতীত বিরূপ পরিবেশে সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ঘরে ঘরে অবরোধবাসিনীদের শিক্ষার আলোয় পথ  দেখান বেগম রোকেয়া। তাঁর সাহিত্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, তিনি ইসলাম ধর্মের কোনো বিষয়ে কটূক্তি না করে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি বিরূপ সমালোচনা না করে কঠোর পর্দাপ্রথা যে নারীর জীবনের দুর্দশার কারণ হচ্ছে তা উল্লেখ করেন। কখনো তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে, প্রাণের আবেগে দরদি অথচ প্রতিবাদের ভাষায়; কখনো করুণ হাস্যরসের ছলে তখনকার অন্তঃপুরবাসিনী নারীসমাজের চিত্র তুলে ধরেন।

তাঁর লেখনীর মূল আবেদন ছিল সমাজের মুসলিম নারী তথা সমগ্র নারীসমাজের অবরোধের অবসান। একটি শিক্ষিত জাতির জন্য শিক্ষিত মা প্রয়োজন এবং নারী জাতিকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে মর্যাদার আসনে বসানো। তাঁর লেখনী মুসলিম নারীসমাজের তথা সব নারী জাতির চেতনার জগতে আলোড়ন তুলেছিল। পরমতসহিষ্ণুতার সঙ্গে তিনি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে চেয়েছিলেন। তখন ধর্মান্ধ সমাজপতিরা ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে নারী শিক্ষার বিরুদ্ধে প্রবলভাবে বাধার সৃষ্টি করেন।

১৯১১ সালে কলকাতায় মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন ছাত্রী নিয়ে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ স্থাপন করলেও বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্রী জোগাড় করতে হতো। অভিভাবকদের কটূক্তি শুনেও তিনি লক্ষ্য স্থির করে নিশ্চুপ থাকেন। অসীম ধৈর্য নিয়ে বাড়ি বাড়ি যেতেন। সে যুগে নারীদের প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখার অধিকার ছিল না পালকির ঘেরাটোপে জানালাবিহীন স্কুলবাসে চলাফেরা করতে গিয়ে অনেক ছাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ত। বাড়ির অন্তঃপুরের নিয়ম-কানুনও অত্যন্ত কঠোর ছিল। তখন বাড়ির পুরুষ মানুষও সহজে দিনের বেলায় অন্তঃপুরে প্রবেশ করতে পারত না। নারী জাতি কর্মে বিশ্বাসী, সহজাত সততা ও মায়া-মমতার অধিকারী। সুদক্ষ ও কঠোর সেবা তাদের থেকেই পাওয়া সম্ভব এটা তিনি বিশ্বাস করতেন। বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন, ভাবনা, কল্পনা আজ বাস্তবতায় রূপ লাভ করেছে। ১৯০৫ সালে লিখিত ‘সুলতানার স্বপ্ন’ আজ কোনো কল্পচিত্র নয়। একাধিক ভাষায় দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁর প্রাণের মাতৃভাষা বাংলাকে বেছে নেন সাহিত্য রচনা, চিঠিপত্র লেখায়। তাঁর লেখায় অনুপ্রাণিত হয় বাংলার লাখো কোটি নারী।

সুলেখিকা ও বলিষ্ঠ মনের অধিকারী বেগম রোকেয়ার দুটি কন্যাসন্তান শিশুকালে মৃত্যুবরণ করায় পৃথিবীতে তাঁর মায়ার বাঁধন ছিল সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। সামাজিক প্রতিকূল পরিবেশ ও আর্থিক সংকটে স্কুল পরিচালনায় তিনি হতাশা বোধ করতে থাকেন। দিনরাত শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমে ১৯৩২ সালের ৮ ডিসেম্বর রাতে মৃত্যুবরণ করেন এই মহীয়সী নারী। তাঁর জীবনের শেষ লেখা ‘নারীর অধিকার’ পড়ার টেবিলে সেদিন উন্মুক্ত পাওয়া যায়।

মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার নামে রংপুরে ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপন করা হয়েছে। শিক্ষা প্রসারে নারীর ক্ষমতায়নে যে দীপশিখা তিনি জ্বালেন সেই বিস্ময়কর, অভাবনীয় আলোকবর্তিকা অনির্বাণ প্রজ্বলিত দীপশিখায় পরিণত হয়েছে।

নারী ক্ষমতায়নের ইতিহাসে ‘শেখ হাসিনার আমল’ ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। শেখ হাসিনাকে পোশাক-পরিচ্ছদে ও চিন্তা-চেতনায় বেগম রোকেয়ার ভাবশিষ্য বললে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পারিবারিক বিভীষিকাময় ঘটনার শোককে শক্তিতে পরিণত করে ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে তিনি বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের টানে ফিরে আসেন। বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত কাজ ও চিন্তা বাস্তবায়নে তিনি বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের মানুষকে ভালোভাবে বুঝতে শহর, নগর ও গ্রামের মানুষের কাছে যান; তাদের মনের কথা বুঝতে তাদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি অনুধাবন করেন বাংলাদেশের ভাগ্য ফেরাতে হলে প্রতিটি ঘরে ঘরে নারীর ক্ষমতায়ন করতে হবে। নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলে সে তার পরিবারকে ভালো রাখতে ব্যয় করে। তিনি বিভিন্ন মৌলিক চিন্তার সমাবেশ ঘটান। নারীর ক্ষমতায়নে, নারীর অবস্থা উন্নয়নে, নারী শিক্ষা বিস্তারে তিনি উদ্ভাবনী চিন্তাধারা প্রয়োগ করেন।

দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। আজ বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরে নারীর প্রতিনিধিত্ব দীপ্যমান। সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী, বিমান বাহিনীতে নারী নিয়োগ দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন কোনো পেশায় নারী অযোগ্য নয় বরং নারীর সহজাত বুদ্ধিমত্তা ও সততা তাকে সব ক্ষেত্রে অনন্য আসন দিয়েছে। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, শেখ হাসিনা বিশ্বে একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক। তাঁর প্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব, উদ্ভাবনী চিন্তা, সংকট উত্তরণে ভূমিকায় তিনি বিশ্বনেতা। বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন সে যুগে অসম্ভব ও অবাস্তব মনে হলেও আজ শেখ হাসিনার হাতে তা বাস্তবে রূপলাভ করেছে।

আমরা বেগম রোকেয়ার উত্তরসূরি হিসেবে পেয়েছি জননী সাহসিকা বেগম সুফিয়া কামাল, শহীদজননী জাহানারা ইমাম, বেগম নূরজাহানসহ অনেক নারী নেতৃত্ব। প্রত্যেকের সম্মিলিত প্রয়াসে আজ বাংলার মুসলিম নারী জাগরণ বর্তমান রূপলাভ করেছে।

‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে বেগম রোকেয়া বলেছেন, ‘আমাদের সাংসারিক জীবনটা দ্বিচক্র শকটের ন্যায়- এ শকটের এক চক্র পতি, অপরটি পত্নী। জীবনের কর্তব্য অতি গুরুত্ব, সহজ নহে। যদি দ্বিচক্র শকটের গতি দেখাই যে শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছোট (পত্নী) হয়, সে শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না- সে কেবল একই স্থানে (গৃহকোণেই) ঘুরিতে থাকিবে। তাই ভারতবাসী উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না।’

আজ বাংলাদেশের নারী-পুরুষ বৈষম্য কমে ভারসাম্য পর্যায়ে এসেছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে। বেগম রোকেয়ার উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে শেষ করছি-

 

‘সুকঠিন গার্হস্থ্য ব্যাপার।

সুশৃঙ্খলে কে পারে চালাতে?

রাজ্যশাসনের রীতিনীতি

সূক্ষ্মভাবে রয়েছে ইহাতে।

লেখক : প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-২ (অতিরিক্ত সচিব)।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর