মঙ্গলবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

পশ্চিম বাংলার নির্বাচনে কী ঘটতে যাচ্ছে

রণেশ মৈত্র

পশ্চিম বাংলার নির্বাচনে কী ঘটতে যাচ্ছে

মার্কিন মুলুকের নির্বাচনী উত্তেজনা এবার ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বময়। ৩ নভেম্বর, ২০২০ যে নির্বাচন হলো তাতে পরাজিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের একগুঁয়েমি, নির্বাচনী ফলাফল ভদ্রভাবে না মেনে যে কুৎসিত মিথ্যার অবতারণা করলেন তা অতীতে আমেরিকায় ঘটেনি। অনেক নাটকের অভিনয় দেখা গেল এবারের নির্বাচন শেষ হতে না হতে হোয়াইট হাউসে। পশ্চিমবঙ্গ ছোট্ট একটি রাজ্য। বিশাল ভারতের পূর্ব প্রান্তে তার অবস্থান। জনসংখ্যা মাত্র ১২-১৩ কোটি। অর্থনৈতিক দিক থেকেও তার শক্তিশালী অবস্থান আজও তৈরি হয়নি। পশ্চিম বাংলার নির্বাচন সর্বভারতীয় নির্বাচনও নয়। তাই সমগ্র বিশ্বে পশ্চিম বাংলার আসন্ন নির্বাচন কোনো উত্তাপ ছড়াতে না পারলেও নিকটতম প্রতিবেশী এবং সীমান্তসংলগ্ন বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে ওই রাজ্যের মানুষের অসাধারণ সহমর্মিতার কারণে বাংলাদেশের জনগণের কাছে আজও সেখানকার নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পশ্চিম বাংলার দুটি টেলিভিশন চ্যানেল তাই নিয়মিত দেখছি। নির্বাচনের তারিখ বা শিডিউল আজও ঘোষিত হয়নি কিন্তু কুম্ভুসার কান্ড শুরু হয়েছে সেখানে মাসখানেক আগেই।

টেলিভিশন চ্যানেল দুটি খুললেই দেখা যায় মারদাঙ্গা লড়াই যেন শুরু হয়ে গেছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে আসন্ন নির্বাচনে পশ্চিম বাংলার দখল যে কোনো উপায়ে নিতে। দলটির কেন্দ্রীয় সভাপতি, দিল্লির মন্ত্রী এবং অন্যান্য প্রথম সারির বিজেপি নেতা ও আরএসএস নেতা প্রতি সপ্তাহে দিল্লি থেকে ছুটে আসছেন পশ্চিম বাংলার অন্দরে কন্দরে। কলকাতা বা দার্জিলিংয়ের মতো শহরে বসে তাঁরা পশ্চিম বাংলার রাজনীতি শুধু পর্যবেক্ষণ করছেন না, ছুটছেন প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত। বিজেপির প্রাদেশিক নেতারা সঙ্গে থাকছেন বটে কিন্তু তারা বড্ড অসহায় বলে মনে হয়। কেন্দ্রের নেতাদের আস্থা তাদের প্রতি কতটা তাও অনুমান করা দুরূহ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এখনো আসেননি পশ্চিম বাংলায় তবে আসবেন অবশ্যই। দিন-তারিখ এখনো স্থির হয়নি। তাঁর আসার আগে পশ্চিম বাংলার মাঠ-ঘাট চষে বীজ ছড়ানোর উপযোগী করে তুলতেই অমিত শাহ জাতীয় প্রথম সারির নেতাদের পাঠাচ্ছেন দফায় দফায়। যেন হিমালয় অভিযান চালাচ্ছে এনডিএ (ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স) যৌথভাবে। এ অভিযান অবশ্য একতরফা চলছে না। ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জিও বসে নেই। বিজেপি নেতারা যদি যান দক্ষিণবঙ্গে, তিনি যান উত্তরবঙ্গে অর্থাৎ সারাটি পশ্চিমবঙ্গ এখন রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত। কে কাকে ঘায়েল করবে, কীভাবে করবে তার নিত্যনতুন ছকও আবিষ্কৃত হচ্ছে। হঠাৎ দেখা গেল, মমতা ব্যানার্জি সব নাগরিকের জন্য হেলথ কার্ড বিলি করলেন। ওই কার্ডে সবাই ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত চিকিৎসা ব্যয় করতে পারবেন। এর বেশি খরচ করতে হলে নিজ পকেট থেকে করতে হবে। এর তিন-চার দিন যেতে না যেতেই দেখা গেল, বিজেপি আর একটা কার্ড বের করেছে। তাতে দেখানো হচ্ছে তৃণমূল সরকার গত ১০ বছরের শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গকে কতটা পিছিয়ে ফেলেছে। বিজেপির দাবি অনুযায়ী তৃণমূল সরকার এ রাজ্যে কোনো অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে পারেনি। তা ব্যাপকভাবেই করতে পারবে যদি পশ্চিম বাংলার মানুষ ভোটে বিজেপিকে জয়যুক্ত করে আনে।

মমতা ব্যানার্জি বলেন, তাঁর আমলে পশ্চিম বাংলার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে আরও ঘটতে পারত যদি কেন্দ্র তার পাওনা হাজার হাজার কোটি টাকা ছাড় করত। তাঁর অভিযোগ, কেন্দ্র পশ্চিম বাংলার প্রতি বিমাতাসুলভ ব্যবহার করে চলেছে বরাবর। হাসির পাত্রে পরিণত হন পশ্চিম বাংলার শিক্ষিতজনদের কাছে দিল্লি থেকে সম্প্রতি প্রচারে আসা বিজেপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা। তিনি বলে ফেললেন রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন রবীন্দ্রভারতীতে। তিনি তা পরিদর্শনেও যান। আরেকজন বিজেপি নেতা হঠাৎ বলে ফেললেন রবীন্দ্রনাথ রচিত ভারতের জাতীয় সংগীত বদলাতে হবে কারণ ওই সংগীত ভারতের বর্তমান বাস্তবতায় সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।  নিয়ে বাঙালি চিত্ত স্বভাবতই আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং বেশ কজন তৃণমূল নেতা বলে ওঠেন, রবীন্দ্রনাথ ও জাতীয় সংগীত দুটোতেই ভারতবাসীর ইতিহাস ও আবেগ জড়িত। এ বিতর্কে দৃশ্যতই পশ্চিম বাংলা বা ভারতের জনগণের কোনো স্বার্থ নেই। দ্বন্দ্বটা পুরোপুরি ক্ষমতার। বেশ কজন তৃণমূল নেতা বিধায়ক ইতিমধ্যে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। আরও বেশ কিছু রয়েছেন যোগদানের পথে। এ খবর অতিসম্প্রতি ভারতের মিডিয়াসূত্রে পাওয়া।

আবার পাহাড়ি এলাকায় ভিন্ন সুরও শোনা গেল। সে অঞ্চলের নেতা বিমল গুরুং তাঁর সংগঠন ও সম্প্রদায়ের সবাই মিলে তাদেরই প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী বিগত নির্বাচনে শতভাগ ভোট দিয়ে ওই এলাকায় বিজেপি প্রার্থীকে বিজয়ী করেছিলেন। বিজেপি নির্বাচনের আগে একগাদা প্রতিশ্রুতি দিলেও তার কোনোটাই কার্যকর না করে তাদের সঙ্গে ‘বেইমানি’ করেছে এমন অভিযোগে। তাই বিমল গুরুং প্রকাশ্য জনসভায় বিজেপিকে তুলাধোনা করে বলেছেন, ‘এবার একটি ভোটও আমরা বিজেপিকে দেব না- সব ভোট দেব দিদিকে।’ এই দিদি হলেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী ও পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। দিদি হিসেবেই তিনি ব্যাপকভাবে আখ্যায়িত।

চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে উভয় দলই সুবিধাবাদী, নীতি-আদর্শ বিবর্জিত। বিজেপি বলে তারা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি মেনে চলে। কিন্তু কাজে তারা বাবরি মসজিদ ভাঙে, মুসলিমদের জোর করে হিন্দুত্বে দীক্ষিত করে, গোমাংস খাওয়া, ফ্রিজে রাখা বা বহন করার অভিযোগে নিরীহ মুসলিমকে মারধর শুধু নয়, খুনও করেছে। মুসলিমদের ভারতীয় নাগরিকত্ব থাকা সত্ত্বেও বিদেশি বলে তাড়ানোর চেষ্টাও করছে আইন করে।

অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের অভিযোগ, বিজেপি সাম্প্রদায়িক দল। এ অভিযোগ যথার্থ, সর্বজনসমর্থিতও। কিন্তু ওই দলের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারে মমতা ব্যানার্জি রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে দ্বিধা করেননি। অন্যপক্ষে মুসলিম সংখ্যালঘুদের সমঅধিকার, সমমর্যাদাসম্পন্ন নাগরিকে পরিণত না করে অসংখ্য মাদরাসা গড়ে, মাদরাসা শিক্ষকদের বেতন ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে যে মুসলিমপ্রীতি দেখাচ্ছেন তার উদ্দেশ্য তাদের সামনে একটি অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি তুলে ধরে তাদের ভোট তৃণমূলের বাক্সে নেওয়া; যেমন বিজেপি চাইছে হিন্দু ভোট তাদের বাক্সে একচেটিয়া করতে এবং নানা প্রলোভনে দল ভাঙাভাঙি করতে। কিন্তু এ দুই শক্তির বাইরে ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল শক্তি ভারতে এবং পশ্চিম বাংলায় রয়েছে। ওই শক্তি বাম ও কংগ্রেসের যদিও মিডিয়ায় কার্যকলাপ আজও চোখে পড়ছে না। তবে তারা জোট বেঁধেছে কেন্দ্রে বিজেপি ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে। তৃণমূল বলছে তারা একাই লড়বে বিজেপি, বাম ও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। আর বিজেপির টার্গেট বাম কংগ্রেস তৃণমূল সবাই।

অন্যদিকে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও অন্যান্য রাজ্যের হাজার হাজার কৃষক লাঙ্গল-জোয়াল কাঁধে নিয়ে মাসভর দিল্লিতে অবস্থান করছেন প্রবল শীত উপেক্ষা করে। তাদের দাবি কৃষি ও কৃষক সংক্রান্ত যে তিনটি আইন কেন্দ্রীয় সরকার অনুমোদন করেছে তা কৃষকস্বার্থের পরিপন্থী হওয়ায় ওই আইন তিনটি বাতিল।

পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় কৃষক ট্রাক্টর নিয়ে আন্দোলনে অংশ নেয়। আন্দোলনের কারণে দিল্লি-জয়পুর মহাসড়কও বন্ধ হয়ে গেছে। রাজস্থানের বেশির ভাগ সড়কে দিল্লিমুখী স্রোতের কারণে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কবে নাগাদ এ আন্দোলন কীভাবে শেষ হবে তা না বলা গেলেও এ কথা বলা যায়, বিজয় না নিয়ে ঘরে না ফিরতে কৃষক দৃঢ়সংকল্প। এ অবস্থায় বহুমুখী তাৎপর্য নিয়ে ২০২১-এর পশ্চিম বাংলার নির্বাচন সেখানকার জনগণের সামনে হাজির হয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল শক্তি দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনা, শ্রমিক-কৃষক ও নিম্নবিত্তের স্বার্থ সমুন্নত রাখা ও সুবিধাবাদীদের হাত থেকে রাজনীতি ছিনিয়ে এনে দেশের রাজনীতি সুবিধাবাদমুক্ত করার লক্ষ্যে কাজ করছে।

দৃশ্যত এ কাজগুলো বিজেপি বা তৃণমূল কংগ্রেস করতে পারবে না। তৃণমূল তো শতভাগ আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল। পশ্চিম বাংলার বাইরে বিশাল ভারতের অন্য কোথাও তাদের অবস্থা নেই। অথচ কেন্দ্রই পারে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা মৌলিকভাবে মেটাতে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিহারের নির্বাচনে যদিও বিজেপি অধিকাংশ আসনে জিতেছে কিন্তু কংগ্রেস পেয়েছে পূর্বাপেক্ষা বেশিসংখ্যক আসন। কমিউনিস্টরা আগের বারের একটি মাত্র আসনের বিপরীতে এবার ১৬টিতে জয়লাভ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। তাই দেশজোড়া কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলনের পটভূমিতে অনুষ্ঠেয় পশ্চিম বাংলার নির্বাচন এক বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে। সেখানে প্রয়োজন বাম-কংগ্রেস মোর্চার ব্যাপক বিজয়, যাতে তারা এবারে পশ্চিম বাংলার মানুষকে একটি নীতিনিষ্ঠ, ধর্মনিরপেক্ষ ও শোষিত মানুষের পক্ষের সরকার বহুদিন পর যৌথভাবে গঠন করতে পারে। এ কথা ঠিক, পশ্চিমবঙ্গে বাম ফ্রন্ট-কংগ্রেস উভয়েই শক্তির দিক থেকে অনেকাংশে দুর্বল অবস্থানে। তবু তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে যৌথভাবে বাকি চার মাস জনগণের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম ও নির্বাচনী অভিযান পরিচালনা করলে বর্তমান পটভূমিতে তাদের ক্ষমতায় ফিরে আসা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। পশ্চিম বাংলার মানুষ রবীন্দ্রনাথকে বা জাতীয় সংগীত পরিবর্তন, সাম্প্রদায়িকতা, মেহনতি মানুষের মুক্তি ও রাজনীতি থেকে সুবিধাবাদীদের ও সুবিধাবাদের বিদায় ঘটাতে নিশ্চয় ইতিবাচক সাড়া দেবে। বিজেপি ও তৃণমূলের ব্যর্থতাগুলো থেকে জনগণও নতুন সিদ্ধান্ত নেবে ভাবা অযৌক্তিক নয়।

লেখক : সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত

সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, ঐক্য ন্যাপ।

Email : [email protected]

সর্বশেষ খবর