ছোটবেলায় হযরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজারে গিয়েছিলাম। লাকসাম থেকে রাতে ট্রেনে সিলেট। সকালে ঘুম ভাঙা চোখে পৌঁছলাম। সুরমা নদী পার হয়েছি নৌকায়। তারপর রিকশায় মাজারে। তখন সুরমায় তীব্র স্রোত ছিল। যাত্রী বেশি উঠলে নৌকা ডুবো ডুবো করত। বেশির ভাগ নৌকা দেখলাম ডুবো ডুবোভাবে যাত্রী নিয়ে নদী পার হচ্ছে। মাঝিরা নিয়ম-কানুন মানত না। যাত্রী নিত বেশি। আমরা সংখ্যায় ছিলাম অনেক। এক নৌকায় পুরো পরিবার। নদী পার হতে গিয়ে আমার ভয় ধরে গিয়েছিল। সে ভয়ের রেশ এখনো কাটেনি। কানের পাশ দিয়ে বিপদ গিয়েছিল। সেই বিপদ আমাদের নৌকার ছিল না। পাশের নৌকার। মাঝনদীর তীব্র স্রোতে নৌকাটি ডুবতে বসেছিল। যাত্রীরা ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করছিল। মাঝি ঠান্ডা মাথায় বৈঠা ধরে বসে আছেন। তার চেহারা ছিল নির্বিকার। আমাদের মাঝি কথা না বলে থাকতে পারেন না। বললেন, লোভে হয় সর্বনাশ। এত যাত্রী তোলার কী দরকার ছিল? এখন কোনোভাবে তীরের দিকে যাও। যাত্রীরা যেন নড়াচড়া না করে। নড়াচড়া করলেই সর্বনাশ। টানটান উত্তেজনা নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম। শেষ পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। মনের মাঝে ঢুকে পড়া সেই ভয়ের স্মৃতি এখনো আছে। খেয়ানৌকায় যাত্রী বেশি হলেই দুর্ঘটনা ঘটে। সবকিছু জেনেও মাঝিরা নৌকায় যাত্রী ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি তোলে। ঈদ, পূজা-পার্বণে লঞ্চের অবস্থাও একই। প্রতি বছরই লঞ্চ ডুবে যাত্রী মরে। কিন্তু বেসামাল ভাব কমে না। বরং দুর্ঘটনার পর আরও অপতৎপরতা বাড়ে। পুরনো লঞ্চে লাগানো হয় নতুন রং।
দেশে এখন নৌকার যাত্রীর অভাব নেই। চারদিকে নৌকাভর্তি উপচে পড়া মানুষ। তবে এ নৌকা নদীর নয়, আওয়ামী লীগের। গাছের পাতাও এখন আওয়ামী লীগ করে। সরকারি কর্মকর্তারাও বাদ নেই। প্রতিযোগিতায় তারা পিছিয়ে থাকতে রাজি নন। তাই তারা মিছিল-সমাবেশ করেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিযোগিতা দেন। ক্ষমতাবানরাও নিজের সুবিধার জন্য এসব বিষয়ে আশকারা দেন। দিন দিন এ আশকারা বাড়ছে। আর বাড়ছে বলেই বিএনপি নেতা হয়ে যান তাঁতী লীগের সভাপতি। পৌর জামায়াত সভাপতি হয়ে যান পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি। কী চমৎকার বোঝাপড়া! মন্ত্রী-এমপি সাহেবরা শুধু নিজের পরিবার-পরিজনকে ঘাটে ঘাটে বসিয়ে খুশি নন। তারা আরও চান। আর চান বলেই অন্য দল থেকে যাত্রী এনে নৌকার মাঝি বানান। ভাই লীগ তৈরি করেন আলাদা করে। নিজের দলের খবর নেই। কর্মীদের ভালো-মন্দের খবর নেই। অথচ খেয়াল-খুশিমতো যা খুশি তা করে চলছেন। জবাবদিহি নেই। দলের প্রার্থীকে ডোবাতে রাখঢাক নেই। চক্রান্তে গোপনীয়তার বালাই নেই। অতীত থেকে কেউই শেখেন না। ভাবেন চিরদিন এমনই যাবে। আসমানি তারারা বারবার সহায়তা করবেন। বাস্তবতা অনেক কঠিন। বিশ্ববাস্তবতা সব সময় এক রকম নাও থাকতে পারে। জোয়ারের পর ভাটা আসতে পারে। সরকারি আমলাদের মতিগতি আবহাওয়া দেখে বদলে যেতে পারে। পশ্চিমা দেশে নারী, আবহাওয়া আর চাকরির ঠিকঠিকানা নেই। আমাদের আমলাদেরও একই হাল। এখন ঠিক আছে, কাল নাও থাকতে পারে।
![](/assets/archive/images/Print-Edition/2021/January/24-01-2021/Bd-Pratidin-24-01-21-F-36.jpg)
পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলেন মির্জা আজম। তার আসন দুটো উপজেলা নিয়ে। একটি উপজেলায় সকালেই সংঘাত শুরু হয়। তার নির্দেশপ্রাপ্ত কর্মীরা ঘটনা জানাতে সাইকেলে ছুটে যান সেনাক্যাম্পে। আর যাওয়ামাত্রই সেনা সদস্যরা তাদের নিয়ে যান ভিতরে। এরপর দুই হাতে দুটি ইট দিয়ে সূর্যের দিকে মাথা রেখে দাঁড় করিয়ে রাখেন লাইন ধরে। দূর থেকে এ দৃশ্য দেখে অভিযোগ করতে আসা বাকি সাইকেলধারী কর্মীরা পালিয়ে যান। পালানোর সময় অনেকে সাইকেলও ফেলে রেখে দৌড় দেন খেতের আইল ধরে। কোনো সহায়তাই কেউ পাননি। এমনও দিন আবার আসবে না ভোটের মাঠে কোনো গ্যারান্টি কি আছে? জোয়ার-ভাটার এই দেশে কখন কী হবে কেউ জানি না। মানবচরিত্র বড় জটিল। খারাপ সময়ে আপনজনরা দ্রুত পাশ থেকে সরে যায়। সামান্য একটা নিরপেক্ষ ভোট হলেই টের পাওয়া যায় কঠিন বাস্তবতা। আপনি যাকে আপন ভাবছেন তিনি কাল নাও থাকতে পারেন। আপনার পাশে নাও দাঁড়াতে পারেন।
১৫ আগস্ট মানবসভ্যতার ইতিহাসের ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার আগে এ দেশে সবাই বাকশাল হয়ে গিয়েছিলেন। পেশাজীবীরা বেশি যোগ দিয়েছিলেন দলে দলে। সারা দেশে আগাছা-পরগাছার শেষ ছিল না। ১৫ আগস্টের পর সেই আগাছারা কেটে পড়ে। তাদের হারিকেন দিয়ে খুঁজে পাওয়া যায়নি। যিনি যত বেশি সুবিধাভোগী ছিলেন তিনি আগে পালিয়েছেন। আওয়ামী লীগের নাম নেওয়া যেত না। ’৭০ সালের আওয়ামী লীগের অনেক এমএনএ ’৭৯ সালে ভোট করেন বাঘ মার্কা নিয়ে। শেখ হাসিনা দেশে ফিরে সবকিছু স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেন। ঘরে-বাইরে সবকিছু কঠিনভাবে সামাল দেন। তিনি শুরু করেন নতুনভাবে। সেই শেখ হাসিনাকে কাছ থেকে দেখেছি। তিল তিল শ্রম-ঘাম, মেধা-মননে নিজের মতো করে ধীরে ধীরে একটা অবস্থান তৈরি করেন। সব ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবিলা করেন। লড়ে যান বঙ্গবন্ধুর আসন পুনরায় জনমনে ফিরিয়ে আনতে। সফল হন।
সর্বশেষ ১২ বছরে দেশের অনেক কিছুর বদল হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বে নতুন মর্যাদার আসন পেয়েছে। কিন্তু ষড়যন্ত্র চক্রান্ত কি থেমে গেছে? জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশটা স্বাধীন করেছেন। শেখ হাসিনা এ দেশের উন্নয়নে এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছেন। আর কিছু মানুষ এ দলটিকে নিয়ে যা খুশি তা করে চলছে। যিনি যত বেশি পেয়েছেন তিনি তত বেশি নৌকাডুবির কাজ করছেন। ইতিহাস বড়ই নিষ্ঠুর। ভুলে গেলে চলবে না, খন্দকার মোশতাক আওয়ামী লীগই করতেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। বিশ্বাস আর আস্থার সম্পর্ক নিয়েই ছিলেন মুজিব পরিবারে। তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষীদের শক্ত অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগে। নিম্মির সঙ্গে বিয়ের পর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যান মেজর ডালিম। বেগম মুজিব তাকে সন্তান স্নেহে দেখতেন। খুনিদের সবাই আওয়ামী লীগের সঙ্গেই ছিল। বঙ্গবন্ধু পরিবার জুলিয়াস সিজারের কাহিনি জানত। তার পরও কেউ সতর্ক হননি। এ দেশে জহুরুল কাইউম বাচ্চু মিয়ারা আওয়ামী লীগ করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাননি। আবার মোশতাক, ডালিমরাও ছিলেন নিষ্ঠুরতার চোখ নিয়ে। সে চোখ ধরা পড়েনি। ব্রুটাসও ধরা পড়েননি সিজারের কাছে। প্রাচীন রোমে দাপটশালী শাসক ছিলেন জুলিয়াস সিজার। তাঁর প্রথম জীবনের বন্ধু ছিলেন ব্রুটাস। উইলিয়াম শেকসপিয়রের নাটক জুলিয়াস সিজারের সেই সংলাপ মনে গেঁথে আছে। সিজারকে হত্যার সময় খুনিদের হাতে ছিল তরবারি। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার মুহূর্তে সিজার দেখলেন প্রিয় বন্ধু ব্রুটাসকে। সিজার ভেবেছিলেন তাঁকে রক্ষা করতে এসেছে বন্ধু। একটু পর বুঝলেন হত্যায় অংশ নিতেই ব্রুটাস এসেছে। তখন সিজার ল্যাটিন ভাষায় বলেছিলেন, অ্যাট টু ব্রুটি?!! ও তুমিও ব্রুটাস! বঙ্গবন্ধুও বলেছিলেন, পাকিস্তান আর্মি আমাকে হত্যার সাহস পায়নি। তোরা কারা? জবাব মেলেনি। তারা খুন করে জাতির পিতাকে। রেহাই দেয়নি শিশু ও নারীকে। কেউ কি বলতে পারেন মোশতাকরা এখন নেই? অবশ্যই তারা আছে নতুন নামে। মীর জাফর তো এ বাংলারই সন্তান। আমাদের চারপাশে মোশতাকরাই ঘুরে বেড়ায়। নানামুখী ষড়যন্ত্র করে। তার পরও তাদের কিছু বলা যায় না। বিষ খেয়ে হজম করে নিতে হয়। আওয়ামী লীগ ’৯১ সালে ক্ষমতায় আসতে পারেনি ষড়যন্ত্রের কারণে। ২০০১ সালের পরের ইতিহাস এখন সবাই ভুলে গেছে। অনেক মন্ত্রী-এমপির কান্ডকীর্তি মাঝেমধ্যে মনে ভয় ধরিয়ে দেয়। এ যুগেও নিজের এলাকায় অনেকে নৌকা ডুবিয়ে দেন। পছন্দের প্রার্থী না পেলে দাঁড় করিয়ে দেন নিজের আপন ভাই থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন অথবা ভাই লীগের সদস্যকে। অনেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের পাত্তাও দেন না। অবশ্য কেন্দ্রে জাতীয় পর্যায়ের খ্যাতিমান নেতার সংখ্যাও কমে গেছে। মাঠের কর্মীরা অনেক কেন্দ্রীয় নেতাকে চেনেন না। মন্ত্রী-এমপিরা সে সুযোগ নেন। আরে ভাই! এতে খুশির কিছু নেই। শেখ হাসিনা হিমালয়সমান ইমেজ নিয়ে আছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শেষ ঠিকানা। সবকিছু সামাল দিয়ে চলেন। ম্যানেজ করে নেন। দেশের সাফল্যে মন্ত্রী, এমপি আর নেতাদের ভাব দেখানোর কিছু নেই। নিরপেক্ষ ভোট এলে অনেকের অস্তিত্ব থাকবে না। অর্থকড়ি কামাইকারী অনেকে ভাগবেন। থাকবেন না। আবার অনেকে এলাকায়ও যেতে পারবেন না। নিজে এমপি হয়েছেন। মন্ত্রী হয়েছেন। ভাই, ছেলে, স্ত্রীকে এলাকায় প্রতিষ্ঠিত করতে নৌকা ডোবাচ্ছেন কেন? আপনি এমপি আপনার ভাইকে কেন বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী করতে হবে? কত চান আপনারা? এ দলে কি অন্য কেউ আর নেই? অনেক হয়েছে। এবার নিজেদের লাগাম টানুন।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।