বৃহস্পতিবার, ৪ মার্চ, ২০২১ ০০:০০ টা

‘তাহারা কাহার জন্ম...’

মহিউদ্দিন খান মোহন

‘তাহারা কাহার জন্ম...’

দেশের একটি পোশাকশিল্প গ্রুপের অবৈধভাবে বিদেশে অর্থ পাচারের খবর বেরিয়েছে ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ প্রায় সব দৈনিকে। খবরে বলা হয়েছে, দুদক সচিব মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার আগের দিন সাংবাদিকদের ওই তথ্যটি দিয়ে বলেছেন, রপ্তানিমুখী ওই পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানটি আমদানি-রপ্তানির আড়ালে কৌশলে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে বলে এনবিআর সূত্রে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দুদক এখন সে অভিযোগ তদন্ত করে দেখবে। এ জন্য তিন ও চার সদস্যের দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠনের কথাও তিনি জানিয়েছেন। দুদক সচিব আরও একটি ভয়াবহ তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, কিছু পোশাকশিল্প মালিক সরকারি কতিপয় কর্মকর্তার যোগসাজশে এভাবে অর্থ পাচার করে থাকে এবং এ প্রক্রিয়ায় গড়ে প্রতি বছর দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে প্রায় ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এ খবরে চমকে ওঠেননি এমন কাউকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। কেননা, যেখানে সরকার প্রতিনিয়ত চেষ্টা করছে দেশের অর্থনীতিকে একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে, সৎ ব্যবসায়ীরা ট্যাক্স-ইনকাম ট্যাক্স দিয়ে রাষ্ট্রের কোষাগার সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রাখছেন, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসীরা তাদের রক্ত পানি-করা অর্থ দেশে পাঠিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করছে, সেখানে কতিপয় দেশপ্রেমহীন অর্থশকুন এভাবে দেশের অর্থনীতিকে মৃত পশুর মাংসের মতো খুবলে খুবলে খাবে, এটা মেনে নেওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। দেশ এবং জাতিকে নিয়ে যারা ভাবেন, তাদের কাছে এটি একটি বড় ধরনের শকিং নিউজ। অবশ্য এটাও ঠিক যে, প্রতিনিয়ত আমরা দেশ থেকে টাকা পাচার হওয়ার কথা শুনি। তবে, ওইসব পাচারকারীর কোনো পাত্তা শেষ পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় পাওয়া যায় না। পিপলস লিজিংয়ের প্রশান্ত কুমার হালদার, ওরফে পি কে হালদার টাকা পাচার করে নিজেও দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। শত চেষ্টা করেও সরকার তাকে দেশে ফেরত আনতে পারছে না। কেউ কেউ অবশ্য তার দেশত্যাগের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সে কীভাবে সরকারকে ফাঁকি দিয়ে হাওয়াই জাহাজে চড়ে হাওয়া হয়ে গেল, সবার কাছেই তা ভেলকিবাজির মতো মনে হচ্ছে।

আমাদের দেশে সরকারি তথা রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ বা পাচার নতুন কোনো ঘটনা নয়। বরং এসব খবর দিন দিন পান্তাভাতে পরিণত হচ্ছে। আগে পাঁচ-দশ লাখ টাকা আত্মসাতের খবরে মানুষ যেভাবে চমকে উঠত, এখন শত কোটি টাকা তছরুপের ঘটনা শুনলেও সেভাবে রিঅ্যাক্ট করে না। শুধু মন্তব্য শোনা যায়- এ আর এমনকী! এদের কিছু হবে না। আইনের ফোকর দিয়ে এরা দিব্যি সাফ-সুতরো মানুষ হিসেবে বেরিয়ে আসবে। এই আইনের ফাঁক-ফোকর নিয়ে আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারা আছি একরকম ধন্দে। আইন তো তৈরি হয় বা হয়েছে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য। তার আবার ফাঁক-ফোকর থাকবে কেন? আর যদি থাকেও, তা বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয় না কেন? আসলে গলদটা কোথায় তা ভেবে অনেকেই কূলকিনারা পান না। দেশ থেকে গোপনে অবৈধ পথে অর্থ পাচার রাষ্ট্রের দেহে দুরারোগ্য ব্যাধির মতো হয়ে উঠেছে। অসাধু ব্যক্তিরা যে যেভাবে পারছে অবৈধ পথে পাচার করে দিচ্ছে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ। এটা নতুন করে বলার দরকার পড়ে না যে, ওইসব কালো টাকা দেশে রাখা নিরাপদ নয় জেনেই ওরা তা ভিনদেশে পাচার করে দেয়। আর এভাবেই মালয়েশিয়ায় গড়ে উঠেছে বাংলাদেশিদের সেকেন্ড হোম, কানাডায় গড়ে উঠেছে বেগমপাড়া। রাষ্ট্রকে ঠকিয়ে যারা এভাবে অর্থ পাচার করে তাদের দেশপ্রেম নিয়ে কথা না বলাই ভালো। কেননা, যারা অর্থ পাচার করে, তাদের হৃদয়ে যে দেশপ্রেমের ছিটেফোঁটাও নেই তা না বললেও চলে। আলোচ্য খবরটি পড়ে ক্ষুব্ধ এক নাগরিক মন্তব্য করলেন, ‘যারা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে, আপন স্বার্থে তারা তাদের মাকেও বেচে দিতে পারে’। ভদ্রলোকের কথায় তীব্র শ্লেষ হয়তো আছে। তবে তা অযৌক্তিক বলা যাবে না। দেশটা তো আমাদের মায়ের মতোই। বক্তৃতা-বিবৃতিতে মা বলে সম্বোধনও করি। অথচ সে মায়ের শরীর থেকে রক্ত-মাংস খাবলে নিতে দ্বিধা করে না একশ্রেণির বিবেকহীন মানুষ।

এখন চলছে মুক্তিযুদ্ধের মাস এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা অর্জনে অকাতরে আত্মদান করেছিলেন। শুধু তাই নয়, দেশপ্রেমের চূড়ান্ত পরীক্ষা আমরা দিয়েছিলাম উনিশ শ একাত্তরে। কতিপয় দালাল ছাড়া গোটা জাতি সেদিন দেশমাতৃকার মুক্তির লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তখনো কিন্তু দেশবিরোধীরা ছিল। অবশ্য এটা ঠিক যে, একাত্তরে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদরের সংখ্যা স্বাধীনতাকামী মুক্তিপাগল বাঙালির তুলনায় কম ছিল। কিন্তু ওদের কার্যকলাপ ছিল ভয়ংকর। ওদের কারণে বহু বাঙালি সেদিন প্রাণ হারিয়েছে, লাখো মা-বোনকে ওরা তুলে দিয়েছে হানাদার বাহিনীর হাতে। আজ যারা দুর্নীতি করে টাকা কামাই করে সে অর্থ বিদেশে পাচার করে, তাদের সঙ্গে একাত্তরের রাজাকার-আলবদরের পার্থক্য কতটুকু? আমি কোনো পার্থক্য দেখি না। একাত্তরের রাজাকাররা আমাদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা চায়নি, এখনকার এই দুর্বৃত্তরা দেশকে ধ্বংস করে দেওয়ার এক সর্বনাশা তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। একাত্তরে যেমন ওরা সংখ্যায় কম ছিল, এখনো ওরা সংখ্যায় খুব বেশি না। কিন্তু দেশ ও জাতির ক্ষতি সাধনের শক্তি ওদের অনেক বেশি। এরা কারা? কী এদের পরিচয়? কবি আবদুল হাকিম তাঁর কবিতায় বলেছেন- ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী,/তাহারা কাহার জন্ম নির্ণয় ন’ জানি/দেশি ভাষা বিদ্যা যার মনে না জুয়ায়,/নিজ দেশ ত্যাগী কেন বিদেশ ন’ যায়।’ কবি বাংলাভাষার প্রতি দরদহীন কতিপয় মানুষকে উদ্দেশ করেই ও কথা বলেছিলেন। আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন তাহলে দুর্নীতি-পাচার দেখে যে কষ্ট পেতেন, তাতে নিশ্চয়ই দুর্নীতিবাজ-পাচারকারীদের জন্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। এরা কি বাংলা মায়েরই সন্তান? এটা ঠিক, কোনো কোনো মায়ের সব সন্তান মানুষ হয় না, দুয়েকটা বখে যায়। আর যারা বখে যায়, দুর্বৃত্ত হয়ে ওঠে, পরিবার ও সমাজ তাদের ঘৃণার চোখে দেখে। কিন্তু আমাদের সমাজে এখন ঘটছে উল্টোটা। দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, সরকারি অর্থ লুটেরা, দেশের সম্পদ পাচারকারীরা সমাজে আর ঘৃণিত নয়। বরং উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত। তারা সমাজের কেউকেটা। কেউ কেউ রাজনীতির নামাবলি গায়ে জড়িয়ে মানুষকে নীতিকথাও নসিহত করে থাকে। এরা বড় বড় রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন কেনার জন্য কোটি কোটি টাকা নজরানা দিতে দ্বিধা করে না।

টাকার জোরে এরা রাজনীতি না করেও রাজনৈতিক নেতা বনে যায়। এদেরই একজন লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সদ্য সাবেক এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল। প্রচারিত আছে, সংসদ সদস্য হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও শুধু টাকার জোরে সে তা হতে পেরেছিল। ‘সমুদ্রের পানি শুকাতে পারে, কিন্তু আমার টাকা ফুরাবে না’- এমন দম্ভোক্তি করা পাপুলের শেষ রক্ষা হয়নি। অর্থ ও মানব পাচারের অভিযোগে কুয়েতের আদালত তাকে চার বছরের কারাদ- দিয়েছেন। সে কারণে আমাদের সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) ধারা মোতাবেক তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে গেছে। ২২ ফেব্রুয়ারি সংসদ সচিবালয়ের প্রজ্ঞাপনে এ কথা জানানো হয়েছে। একজন পাপুলের সংসদ সদস্য পদ থাকল কী গেল সেটা খুব বড় কথা নয়। ভাবার বিষয় হলো, এই চরিত্রের লোকজন মহান জাতীয় সংসদের ফ্লোরে পা রাখার সুযোগ পায় কীভাবে? তাহলে কি ‘টাকায় সব হয়’ কথাটি সত্য? হয়তো সত্য। আর সে জন্যই পাপুল-বদিরা আমাদের সংসদের শোভাবর্ধন করার সুযোগ পায়।

একটি বিষয় অবশ্যই খেয়াল করার মতো। এ পর্যন্ত যতগুলো বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা উদঘাটিত হয়েছে, সবগুলোর সঙ্গেই বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়টি জড়িত। অর্থাৎ অবৈধ পথে অর্জিত অর্থ ওরা দেশে রাখতে সাহস পায় না। আর না পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কেননা, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক হিসাবগুলোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কড়া নজরদারির কারণে অবৈধ অর্থ সেখানে জমা রাখা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় কখনো এরা বাসায় রীতিমতো ভল্ট বানিয়ে জমা রাখে, কখনো বা পাচার করে দেয় বিদেশে। কয়েক মাস আগে ক্ষমতাসীন দলটির জেলা পর্যায়ের দুই নেতার প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা পাচারের খবর দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। তারা এখন আইনের হেফাজতে জেলবন্দী। কবে তাদের বিচার হবে, কী শাস্তি তাদের কপালে জুটবে তা কেউ জানে না। কিংবা আইনের ফাঁক দিয়ে তারা আবার বাইমমাছের মতো বেরিয়ে যাবে কি না তাও বলা যায় না। সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন যে, দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করতে হলে আইনের সংশোধন এবং এর কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সমাজে খুন-ধর্ষণ-সন্ত্রাস বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তা দমনের জন্য সন্ত্রাস দমন আইন করা হয়েছে, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল করা হয়েছে। ঘুষ-দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ বা বিদেশে পাচার ওইসব অপরাধের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। সন্ত্রাসীদের সঙ্গে অর্থ পাচারকারীদের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। সন্ত্রাসীরা মানুষ খুন করে, এরা দেশ ও জাতিকে খুন করছে। উভয়েই সমাজ ও দেশের জন্য ক্ষতিকর। তাই এসব অপরাধীর বিচারের জন্য দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা জরুরি হয়ে পড়েছে বলে সচেতন মানুষ মনে করেন। কেননা, এসব দুর্বৃত্ত সব সময় আইনের ফাঁক খুঁজে বেড়ায়। বিচার বিলম্বিত হলে সে ফাঁক খুঁজে পেতে এদের সুবিধা হয়। ঠিক এ অভিমতই ব্যক্ত করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। সম্প্রতি একটি দৈনিকে তিনি মন্তব্য করেছেন, আদালতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে মামলা নিষ্পত্তি হতে বিলম্ব হচ্ছে। রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের অর্থ যারা লুট করেছে, তাদের বিচার দ্রুত করতে হবে। এদের অধিকাংশই সাজা পায় না। অপরাধের বিচার বিলম্বে হওয়ার কারণে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।

দেশ থেকে অর্থ পাচারের ঘটনা বৃদ্ধিকে অনেকেই অশনিসংকেত হিসেবে দেখছেন। এখানে দুটি বিষয় খুব পরিষ্কার। এক. একশ্রেণির মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে, যে কারণে তারা দেশের সর্বনাশ করতে দ্বিধা করছে না। দুই. যারা অর্থ পাচার করছে তারা সঙ্গীহীন নয়, রাষ্ট্র বা সরকারের নানা স্তরে এদের অনেক সঙ্গী-সাথী আছে, যারা তাদের সহযোগিতা করে। দুদক সচিব সে কথা স্পষ্ট করেই বলেছেন। এখন সরকারের দায়িত্ব রাষ্ট্রের নানা স্তরে ঘাঁপটি মেরে থাকা ওইসব ব্ল্যাকশিপকে খুঁজে বের করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার সরকারের জিরো টলারেন্সের কথা বলেছেন। দেশবাসী তার কথায় আস্থা রেখেছে এবং আশ্বস্ত হতে চেয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, দুর্নীতির প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রীর শূন্য সহিষ্ণুতার অবস্থান সত্ত্বেও দুর্নীতিবাজরা থেমে নেই। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণাকে থোড়াই কেয়ার করে ওরা ঘুষ, দুর্নীতি, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, পাচার দেদার চালিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রবিরোধী ওই চক্রের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর না হলে পুরো রাষ্ট্রকেই ওরা এক সময় গিলে খাবে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তে কেনা এ দেশকে রক্ষায় সরকারকে সে পদক্ষেপ নিতেই হবে।

            লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর