৭ মার্চের পৃথিবী কাঁপানো স্বাধীনতার ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন : ‘...আমি, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না; আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। ...তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। ...এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ একই লক্ষ্যে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে মানিক মিয়া এভিনিউতে ঐতিহাসিক ভাষণে শেখ হাসিনা বলেছিলেন : ‘বাংলার জনগণের পাশে থাকার জন্য আমি এসেছি, মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণের জন্য আমি এসেছি; আমি আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার জন্য আসিনি। আমি আপনাদের বোন হিসেবে, কন্যা হিসেবে এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আপনাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। ...বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তাঁর আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। বাংলার দুঃখী মানুষের সেবায় আমি আমার এ জীবন দান করতে চাই। পিতা-মাতা, ছোট ভাই রাসেলসহ সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, আমি আপনাদের মাঝেই তাঁদের ফিরে পেতে চাই। ...আমি বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই, বাঙালি জাতির আর্থসামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনতে চাই।’
জীবনের সংগ্রামে ও সংকল্পে পিতা মুজিব আর কন্যা শেখ হাসিনার মধ্যে কি অপূর্ব মিল! পিতার মতোই তিনিও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রিত্বের চেয়ে নিজেকে দেশের সেবক ও বঙ্গবন্ধুকন্যা হিসেবে পরিচয় দিতে অধিক গর্বিত বোধ করেন। জাতির পিতা সারা জীবন কি অমানবিক জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আমরা সবাই তা জানি। তাই আজ কন্যার কণ্ঠেও জাতির পিতার বজ্রকণ্ঠের প্রতিধ্বনি শুনি : ...‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’। ১৯৯৮ সালে কোটালীপাড়ায় ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পুঁতে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্নের অপচেষ্টা করে। মহান সৃষ্টিকর্তার অসীম রহমতে প্রতিবারই শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পান। ২০০৭ সালে তৎকালীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে এবং রাজনীতি থেকে সরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে একটার পর একটা মিথ্যা মামলা দিয়ে ১১ মাস কারারুদ্ধ করে রাখে। কিন্তু কেউ তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। কারণ ৭ মার্চ জাতির পিতা বলেছেন : ‘...কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবা না’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এ অমোঘ বাণী সব যুগে, সব কালে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি-সিডিপির ত্রিবার্ষিক পর্যালোচনা সভার চূড়ান্ত সুপারিশে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। ফলে পাঁচ বছর প্রস্তুতিকালীন কাটানোর পর ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশ। সমুজ্জ্বল হবে দেশের ভাবমূর্তি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এটি আমাদের অনন্য অর্জন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে অর্জিত এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিত বর্তমান বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। উল্লেখ্য, স্বাধীনতাবিরোধী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির গায়ে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র তকমা এঁটে দিয়েছিল। ৫০ বছরে রক্তস্নাত নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ সেই অপবাদ ঘুচিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক দলিলপত্র এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত থেকে দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটায় উন্নত দেশসমূহ ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে অধিক হারে বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসবে। বিনিয়োগ বাড়ার সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষের কর্মসংস্থান ও মাথাপিছু আয় বাড়বে। বাড়তি আয়ের সঙ্গে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পেলে বিভিন্ন খাতে সরকারের বিনিয়োগ বাড়বে। শিল্পকারখানা ও শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধির কারণে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাবে। পণ্য রপ্তানিতে দরকষাকষির সুযোগ বাড়বে বাংলাদেশের। এভাবে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির ফলে অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও মানবসম্পদ সূচকে দ্রুত উন্নয়ন ঘটবে। ফলে আমদানি-রপ্তানিসহ বহির্বাণিজ্যে দেশের সক্ষমতা বাড়বে। তবে বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন বাংলাদেশ বেশ কিছু ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। যেমন ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে বাংলাদেশের জন্য ভারত, চীন ছাড়াও উন্নত দেশগুলোয় বাণিজ্য সুবিধা হ্রাস পাবে; কিছু শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা হারাবে; মেধাস্বত্ব, পেটেন্ট, তথ্যপ্রযুক্তি ও সেবা খাতে বিশেষ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে; উন্নয়ন অনুদান ও সহজশর্তে ঋণ সহায়তা কমবে; এমনকি সহজ শর্তে বিশ্বব্যাংক, এডিবি থেকে ঋণ মিলবে না। এ ছাড়া বাংলাদেশ কৃষিসহ কিছু খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা দেওয়া সহজ হবে না।
আমাদের সহজ প্রশ্ন- দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয়ী বাংলাদেশ কি হাত গুটিয়ে স্থির-নিশ্চল হয়ে বসে থাকবে। বর্তমান উন্নয়নের ধারা আরও বেগবান না হয়ে কি পেছনের দিকে হাঁটবে? বিশ্বব্যাংকের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু; সারা দেশে নির্মিত সড়ক যোগাযোগ, নৌপথ, নতুন নতুন রেলপথ, সমুদ্রবন্দর, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল, কর্ণফুলীর নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণসহ হাজার-লাখ অবকাঠামো কি কোনো সহায়তা দেবে না? খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, কমিউনিটি ক্লিনিক, ঘরহীন মানুষকে ঘরদান, শিক্ষার ব্যাপক বিস্তৃতি এসব কি কোনো অবদান রাখবে না? নিশ্চয়ই সহায়তা দেবে, নিশ্চয়ই অবদান রাখবে। নিশ্চয়ই সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে বলেছেন, জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল একটি শোষণ-বঞ্চনা মুক্ত গণতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের। যেখানে সব ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-পেশার মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সদ্য-স্বাধীনতাপ্রাপ্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ যখন পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের পাশাপাশি এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে সপরিবার হত্যা করে। তাঁকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত করে। এরপর চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ও সামরিক শাসনের জাঁতাকলে নিষ্পেষণ, গণতন্ত্রহীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিচ্যুতি, ইতিহাস বিকৃতিসহ শাসকদের নানা অপকীর্তি প্রত্যক্ষ করেছে এ দেশের মানুষ। জনগণের সম্পদ লুটপাট করে, তাদের বঞ্চিত রেখে, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করে বাংলাদেশকে পরনির্ভরশীল করে রেখেছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেছেন, দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েই বাংলাদেশকে একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। মাঝখানে ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সে প্রচেষ্টায় ছেদ পড়েছিল। বঙ্গবন্ধুকন্যা জানিয়েছেন, ২০০৯ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১২ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আর্থসামাজিক ও অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। বিশ্বের ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম এবং ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।
প্রসঙ্গত, বঙ্গবন্ধুকন্যার রাজনৈতিক অর্জন অসামান্য। তিনি বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করে বাঙালি জাতির কলঙ্ক মোচন করেছেন ও দেশকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে ফিরিয়ে এনেছেন। এ ছাড়া জাতীয় চার নেতা ও বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার এবং একাত্তরের ঘাতক-যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখেছেন।
আসুন আবার স্মরণ করি ১৯৮১ সালের ১৭ মে জাতির জনকের রক্তে ভেজা মাটিতে পা রেখে, মেঘলা আকাশের ছায়ায়, অশ্রুভরা ভালোবাসার সাগরে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা সেদিন যে অঙ্গীকার করেছিলেন, দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম আর প্রজ্ঞাময় নেতৃত্ব দিয়ে বাংলার মানুষকে, আমাদের বাংলাদেশকে নিরলস নিষ্ঠায় সে পথেই এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। তাই আসুন বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে সবাই সমস্বরে উচ্চারণ করি : আপনাকে অভিবাদন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। আপনাকে অভিনন্দন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও জনগণমননন্দিত নেত্রী শেখ হাসিনা!
লেখক : কবি ও প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।