বিগত কয়েক দিন সারা বিশ্বে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মৃতের সংখ্যা ৩ অঙ্কে পৌঁছেছে। জনপ্রিয় অভিনেত্রী কবরীও মৃত্যুবরণ করেছেন। সারা বিশে^ করোনায় মৃতের সংখ্যা ৩০ লাখ ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশেও এখন পর্যন্ত সাড়ে ১০ হাজারের বেশি। ২০২০-এর শুরুটা হয়েছে করোনার ভয়ংকর আতঙ্ক দিয়ে। গত এক বছরে সারা বিশ্ব লন্ডভন্ড হয়ে গেছে অদৃশ্য এক অণুজীব দ্বারা। দেখা যায় না, অনুভব করা যায় না কিন্তু শরীরে প্রবেশ করে হাঁচি-কাশি, জ¦র, শ্বাসকষ্টসহ অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আক্রান্ত করছে এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাচ্ছে। গেল ফেব্রুয়ারিতে সংক্রমণ কমে যাওয়ায় মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। করোনা বোধহয় বিদায় নিয়েছে ভেবে মানুষ বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিল। স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই ছিল না, ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যাপক জনসমাগম হচ্ছিল। পর্যটন কেন্দ্রগুলোয় মানুষ উপচে পড়ছিল। ফলে যা হওয়ার মার্চ, ২০২১ থেকে করোনার ব্যাপক সংক্রমণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতিদিন মৃত্যুর সারি দীর্ঘতর হচ্ছে। ফলে সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণে পয়লা বৈশাখ থেকে সর্বাত্মক লকডাউন ঘোষণা করেছে।
এক অদৃশ্য শক্তি, অণুজীব চীনের উহান থেকে যার যাত্রা সেখানকার বন্যপ্রাণীর বাজারের বাদুড় থেকে, আবার কারও মতে উহানের ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। মানুষের নাক মুখ বা চোখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে আক্রান্ত করে প্রথমে হালকা জ¦র, হাঁচি-কাশি, গা ম্যাজম্যাজ করা কেউ বা উপসর্গহীন।
এখন আসা যাক করোনা রোগী কেন ভীতিকর। রেডিও টিভি আর সংবাদপত্রের কল্যাণে রোগটি এত আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। এ রোগে আক্রান্ত হলে পরিবার, সমাজ সবার কাছে সে অবহেলার পাত্র আর অচ্ছুত হয়ে যায়। কেউ তাকে দেখতে আসে না, ছুঁতে চায় না, সেবা ও চিকিৎসা দিতে অনীহা প্রকাশ করে।সেজন্য এ রোগে আক্রান্ত হলে এক ধরনের ভীতি রোগীকে কুরে কুরে খায়। রোগী সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে আরও অসুস্থ হয়ে যায়। আসলে কি রোগটি ভীতিকর? না করোনা আক্রান্তের মধ্যে শতকরা ১৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। শতকরা ১০ জনের আইসিইউ প্রয়োজন হয়। শতকার ৫ জনের কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্রের প্রয়োজন হয়। করোনা আক্রান্ত সবার উপসর্গ থাকে না। রোগটি শনাক্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করাতে হবে। মনোবল অটুট রাখতে হবে। আতঙ্ক বা ভয় নয়, সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। সারা বিশে^ ১৪ কোটি ২ লাখ ১৬ হাজার ৬১৯ জন এ পর্যন্ত করোনা (Covid-19) আক্রান্ত হয়েছেন আর মৃত্যু হয়েছে ৩০ লাখ ৫ হাজার ৬৪৭ জনের। বাংলাদেশেও এ পর্যন্ত ৭ লাখ ১১ হাজার ৭৭৯ জন করোনা আক্রান্ত হয়েছেন আর মারা গেছেন ১০ হাজার ১৮২ জন। প্রতিনিয়ত আক্রান্তের হার বেড়েই চলেছে। তেমনি বেড়েছে মৃতের সংখ্যাও। কোনো এক অদৃশ্য শত্রু যা দেখা যায় না, অনুভব করা যায় না অথচ নীরবে প্রলয় ঘটিয়ে সারা বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে আর অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। এ মহামারীর শেষ কোথায়? কোথায় এর পরিণতি- ভবিতব্যই জানে।
বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দরিদ্র দেশ। এখানে প্রয়োজনীয় শিক্ষা নেই, শৃঙ্খলা নেই, নিয়ম মানার প্রবণতা নেই। প্রয়োজনীয় পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই, সচেতনতা নেই, হাসপাতালের বিছানা নেই। মহামারী নিয়ন্ত্রণে যেভাবে আন্তরিকতা নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দরকার সেরূপ আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসার মতো চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী নেই। আগেই বলেছি ভাইরাসটি নাক মুখ চোখ দিয়ে প্রবেশ করে এজন্য হাত বারবার সাবান বা স্যানিটাইজার দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। নাকে মুখে মাস্ক পরতে হবে তা কাগজের বা কাপড়ের হলেই হলো। চোখে চশমা, হাত না ধুয়ে নাক মুখ চোখ স্পর্শ করা যাবে না। যেখানে সেখানে কফ থুথু ফেলা যাবে না। ব্যবহৃত রুমাল বা টিস্যু, মাস্ক ফেলা যাবে না। রুমাল বা টিস্যু না থাকলে কনুই দিয়ে নাক মুখ ঢেকে হাঁচি কাশি দিতে হবে। লকডাউনে বের হওয়া যাবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। নির্দিষ্ট সময় টিকা গ্রহণ করতে হবে। উপরোক্ত ব্যবস্থা নিলেই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ সম্ভব।
কভিড-১৯ ভাইরাসটি বেশি বেশি পরীক্ষা করে শনাক্ত করতে হবে। আক্রান্তের চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পর্যাপ্ত কভিড-১৯ আক্রান্তের চিকিৎসার সুযোগ সম্প্রসারণ করতে হবে। পাশাপাশি সাধারণ রোগীও যেন করোনার অজুহাতে চিকিৎসাবঞ্চিত না হয় সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ থাকতে হবে। জেলা হাসপাতালগুলোয় আইসিইউর ব্যবস্থা রাখতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালেও কভিড আক্রান্তের চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থা রাখতে হবে, চিকিৎসা ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। হাসপাতাল ও রোগীর চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কভিড-১৯-এর নিয়ন্ত্রণ ত্বরান্বিত করতে হলে আমাদের সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক : অতিরিক্ত পরিচালক (হাসপাতাল), বিএসএমএমইউ শাহবাগ, ঢাকা।