বুধবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২১ ০০:০০ টা

পেশাদারি নয়, ক্ষমতাই দেখেছি শুধু

ডা. সাকলায়েন রাসেল

পেশাদারি নয়, ক্ষমতাই দেখেছি শুধু

পক্ষ তো চারটা। চিকিৎসক, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট ও সাংবাদিক। কিন্তু আমি এদের কাউকেই দেখিনি। যা দেখেছি তা ক্ষমতা। বহু বছর আগে সায়েন্সল্যাব মোড়ে একটা গাড়ির বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছিল। বিশাল বিলবোর্ডে গাড়ির ছবির নিচে লেখা ‘পাওয়ার ইজ নাথিং উইদাউট কন্ট্রোল’। সেই নাথিং পাওয়ার আমার চোখে পড়েছে।

ঘটনাস্থল এলিফ্যান্ট রোড। যদিও রোডটির পরিবর্তিত নাম ড. কুদরত-ই-খুদা সড়ক। বহু বছর আগে রোডটির নাম পরিবর্তন করা হলেও ভোলানো যায়নি এলিফ্যান্ট রোড নামটি। ম্যাজিস্ট্রেট সরকার-ঘোষিত কঠোর লকডাউন বাস্তবায়নে তাঁর দায়িত্ব পালন করছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী প্রশাসনের পক্ষ থেকে পুলিশ সহায়তা দিচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার একজন নারী চিকিৎসক ডিউটি শেষে সে পথেই যাচ্ছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সম্মিলিতভাবে তাঁর আইডি কার্ড চাইলে ঘটনার সূত্রপাত হয়। ঘটনার পর সাংবাদিক পুলিশ চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত বিশেষণ আমার চোখে পড়েছে। প্রত্যেকেই নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করছেন। কোনো পক্ষ অবলম্বন আমার মোটিভ নয়। কিন্তু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার বিশ্লেষণ শেয়ার না করলে নিজ বিবেকের কাছে অপরাধী থাকব। আমি পেশায় চিকিৎসক। শখের বশে সাংবাদিকও। লেখায় কিছুটা বায়াসনেস আসতে পারে। তবে আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করব আমার অবস্থান সাধারণ মানুষের কাতারে রাখতে।

প্রথমেই জানতে চাই আইডি কার্ড দেখতে চাওয়া কি পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেটের অপরাধ? নাকি এটা তার ডিউটির মধ্যে পড়ে? সরকারি আদেশে তো বলাই আছে, চিকিৎসকদের মুভমেন্ট পাস লাগবে না। আইডি কার্ড হলেই হবে। তাই আইডি কার্ড দেখতে চাওয়া কি অন্যায় কিছু?

আপনি নিজেকে চিকিৎসক বলে পরিচয় দিয়েছেন। তারা এতে খুশি নন। আপনি যে নিশ্চিত চিকিৎসক তার সপক্ষে প্রমাণ হলো আপনার আইডি কার্ড। তারা তা দেখতে চেয়েছেন। আপনি তা সঙ্গে রাখেননি। সঙ্গে রাখাটা আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কারণ আপনার আইডি কার্ডই আপনার মুভমেন্ট পাস। সে মুভমেন্ট পাস তো আপনার সঙ্গে রাখতেই হবে। আপনি রাখেননি। যেহেতু রাখেননি সেহেতু আপনাকে বিনয়ী হতে হবে।

‘সরি, আমি তো ভুলে আজ আইডি কার্ড আনিনি’ অন্তত এতটুকু বলতে পারতেন। বল তখন ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশের কোর্টে পড়ত। নিশ্চয়ই তারা সৌজন্য দেখাতেন এবং এটাই কাম্য। না দেখালে বিষয়টা তাদের বিপক্ষে যেত। আমরা আদৌ জানি না এমন কিছু হয়েছিল কি না।

প্রশ্ন আরও আছে। গাড়িতে হাসপাতালের মুভমেন্ট পাসসংবলিত স্টিকার, গায়ে চিকিৎসকের পোশাক এবং একজন নারী। গাড়ির আরোহী যে আপাতদৃষ্টিতে একজন চিকিৎসক তা বোঝার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট। তবু কেন পরিচয়পত্র দেখতে চাওয়া?

এর সম্ভাব্য ব্যাখ্যাও জেনেছি। অনেক সময় অ্যাম্বুলেন্সে করে সাধারণ যাত্রী পরিবহন করা হয়। তাই গাড়ির ভিতরে অবৈধ কেউ আছেন কি না নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। অথবা সাদা অ্যাপ্রোন তো শুধু ডাক্তার না, অনেকেই পরেন। তাই নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন অ্যাপ্রোন পরিহিত চিকিৎসক কি না।

পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষ থেকে এসব ব্যাখ্যা আসতে পারে। আসতে পারে পুলিশকে দায়িত্ব পালনে অসহযোগিতার অভিযোগ।

আবার বিষয়টা অন্যরকমও হতে পারত। গাড়িতে হাসপাতালের স্টিকার, ভিতরে চিকিৎসকের পোশাকে নারী। কাছে আসামাত্র ইশারায় গাড়িকে চলে যেতে বলতে পারত পুলিশ। ইগনোর করতে পারত আইডি কার্ডের বিষয়টি। বাস্তবে তা-ই হচ্ছে। আমার গাড়িতেও হাসপাতালের অনুমোদিত স্টিকার আছে। চেকপোস্টের আশপাশে এলে মাঝেমধ্যে ইশারা করা হয় থামানোর জন্য। কাছে আসতেই কিছু জিজ্ঞেস না করে ইশারা করা হয় চলে যেতে। আলোচ্য ঘটনা ঠিক এমন হলে বিষয়টা এত দূর গড়াত না।

ফলাফল এখানে ক্ষমতা জিতেছে। চিকিৎসক পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেট হেরে গেছেন।

সরকার-ঘোষিত স্কেল অনুযায়ী এখানে পদমর্যাদায় সবার ওপরে চিকিৎসক। কিন্তু দায়িত্বের বিচারে সবচেয়ে ক্ষমতাবান সে মুহূর্তে পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি যদি পুলিশের সর্বনিম্ন পদমর্যাদারও হন তবু সে মুহূর্তে তিনিই ক্ষমতাবান। কারণ এ চেকপোস্টে যে কোনো ব্যক্তিকে চেক করার ক্ষমতা ও অধিকার তার আছে।

পেশাগত কারণে আমি নিজেও এমন চেকিংয়ের শিকার হয়েছি। পুলিশ আমার পরিচয় জানার পর বলেছে, সরি স্যার, আমি চিনতে পারিনি। উত্তরে বলেছি, এটা আপনার দায়িত্ব। আপনি চেক করতেই পারেন। এতে সরি হওয়ার কিছু নেই। আবারও প্রশ্ন, তাহলে ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ বারবার কেন আইডি কার্ড দেখতে চাচ্ছিলেন? ওই যে বলেছি ক্ষমতা। এ ক্ষমতাবলে তিনি মুভমেন্ট পাস চেয়েছেন। পরে চিকিৎসক বুঝতে পেরে আইডি কার্ড চেয়েছেন। তিনি বারবার বলছিলেন তিনি ডাক্তার, তিনি সহযোগী অধ্যাপক, তাঁর গাড়িতে হাসপাতাল অথরিটির দেওয়া স্টিকার আছে। এমনকি অ্যাপ্রোনটি যে একজন ডাক্তারের তার প্রমাণ হিসেবে আঙুল দিয়ে অ্যাপ্রোনের লোগো দেখিয়েছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! হাতে ক্ষমতা আছে। এ ক্ষমতাই ঘটনাকে এত দূর নিয়ে এসেছে। শুরুটা হয়েছিল নিশ্চয়ই অ্যাপ্রোচ থেকে। আইনের চোখে সবাই সমান। কিন্তু এসব চেকপোস্টে মাঝেমধ্যে এমনভাবে অ্যাপ্রোচ করা হয় যেন সবাই চোর। হতে পারে নারী চিকিৎসকের প্রতি শুরুতে তাদের অ্যাপ্রোচ ভালো ছিল না। যার কারণে তিনি ক্ষিপ্ত হয়েছেন। আবার এমনও হতে পারে পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতি নারী চিকিৎসকের অ্যাপ্রোচ ভালো ছিল না। যার কারণে তারা আইডি কার্ড চাওয়ার নামে নারী চিকিৎসকের ভাষায় অহেতুক হয়রানি করেছেন।

এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে। যদি মনে করেন আলোচ্য চিকিৎসক শুরু থেকেই মারমুখী ছিলেন তবে আপনাকে যেতে হবে ঘটনার শুরুতে। সমস্যা হলো ভিডিওতে তো ঘটনার প্রথম অংশ নেই। ঘটনার শুরুতে গেলে আপনি যা পাবেন সেটাই তো অ্যাপ্রোচ। পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেটের অ্যাপ্রোচ। কিন্তু আপনি যদি ঘটনার শুরু এখানেই মনে করেন তবে ভুল করবেন। ঘটনার শুরু আরও আগে।         

লেখক : চিকিৎসক।

সর্বশেষ খবর