নবীগণ আল্লাহতায়ালার একান্ত প্রিয় বান্দা। প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং ইবরাহিম, নুহ, মুসা ও ইসা (আ.) তাঁরা হলেন নবীদের মধ্যে উলুল আজম বা বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ নবী। সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী-নবীকুল সম্রাট বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাপূর্ণ নবীগণের অন্যতম হলেন হজরত ইবরাহিম (আ.)। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ২৫টি সুরায় তাঁর নাম এসেছে। তাঁর নাম অনুযায়ী আল কোরআনে সুরা ইবরাহিম নামে একটি সুরা নামকরণ হয়েছে। আল কোরআনের ভাষায় তিনি মানব জাতির ইমাম। সুরা বাকারা আয়াত ১২৪। তিনি আদর্শ স্বভাবের স্থপতি। সুরা আন নাহল আয়াত ১২০। পরিপূর্ণ একাত্মবাদের অধিকারী তিনি। সুরা আন নাহল আয়াত ১২৩। তিনি শ্রেষ্ঠ খোদাভীতি ও আনুগত্যশীল মহৎ ব্যক্তি। সুরা আন নাহল আয়াত ১২০। মুসলিম উম্মাহ তাঁর অনুকরণে প্রতি বছর কোরবানি করে এবং পবিত্র হজ পালন করে। তাঁর স্মৃতি অনুসরণ করে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা প্রত্যেক হজ পালনকারীর জন্য ওয়াজিব। মহান প্রভু ঘোষণা করেন, ‘যখন আমি কাবাঘরকে মানুষের জন্য সম্মিলনস্থল ও শান্তির আলয় করলাম, আর তোমরা ইবরাহিমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাজের জায়গা বানাও।’ সুরা বাকারা আয়াত ১২৫। রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে অনেক ভালোবাসতেন। ইবরাহিম (আ.) -এর নামে রসুলুল্লাহ (সা.)-এর এক ছেলের নামকরণ করেন। মুসলিম। মহান প্রভু ইবরাহিম (আ.)-কে তাঁর একান্ত বন্ধু হিসেবে ঘোষণা করেছেন এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত ধর্ম অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে আল্লাহর নির্দেশের সামনে মস্তক অবনত করে সৎ কাজে নিয়োজিত থাকে এবং ইবরাহিমের ধর্ম অনুসরণ করে, যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁর চেয়ে উত্তম ধর্ম কার?’ অন্য আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘বলুন, আল্লাহ সত্য বলেছেন। সবাই ইবরাহিমের ধর্মের অনুগত হয়ে যাও, যিনি ছিলেন একনিষ্ঠভাবে সত্য ধর্মের অনুসারী। তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।’ সুরা আলে ইমরান আয়াত ৯৫। আল্লাহ ইবরাহিমকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছেন। সুরা নিসা আয়াত ১২৫। সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো মহান প্রভু নবী ইবরাহিম (আ.)- কে ইসলাম ধর্মের স্থপতি হিসেবে ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা তোমাদের পিতা ইবরাহিমের ধর্মে প্রতিষ্ঠিত থাক। তিনিই তোমাদের নাম মুসলমান রেখেছেন, আগেও এবং এ কোরআনেও।’ সুরা আল হাজ, আয়াত ৭৮।
বিশ্বমানবতার হেদায়াত ও কল্যাণে এ ভূপৃষ্ঠে নবী আদম (আ.)-এর মাধ্যমে নির্মিত হয় পবিত্র কাবাঘর। এরপর শিশ (আ.) একবার সংস্কার করেন। নুহ (আ.)-এর যুগে মহাপ্লাবনে কাবাঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মহান প্রভু ইবরাহিম (আ.)-এর মাধ্যমে এ পবিত্র বরকতময় ঘর পুনর্নির্মাণের ব্যবস্থা করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘স্মরণ কর যখন ইবরাহিম ও ইসমাইল কাবাঘরের ভিত্তি স্থাপন করছিল।’ সুরা বাকারা আয়াত ১২৭। প্রজ্ঞাময় প্রভু স্বীয় বন্ধু ইবরাহিম (আ.)-কে বিশেষ কুদরতে লালন করে তাঁকে পূর্ণত্বের স্তর পর্যন্ত পৌঁছানো এবং তাঁর মহত্ত্বকে ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রায় ৩০টি পরীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘যখন ইবরাহিমকে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, এরপর তিনি তা পূর্ণ করে দিলেন, তখন পালনকর্তা বললেন আমি তোমাকে মানব জাতির নেতা করব। তিনি বললেন, আমার বংশধর থেকেও! তিনি বললেন, আমার অঙ্গীকার অত্যাচারীদের পর্যন্ত পৌঁছাবে না।’ সুরা বাকারা ১২৪। ইবরাহিম (আ.)-এর পরীক্ষার বিষয়বস্তুর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো কর্মক্ষেত্রে দৃঢ়তা যাচাই, নমরুদের অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ, মাতৃভূমি ও স্বজাতি ত্যাগ করে সিরিয়া হিজরত, বিবি হাজেরা (রা.) ও তাঁর দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাইল (আ.)সহ শুষ্ক পাহাড় ও উত্তপ্ত বালুকাময়, তৃণলতাহীন প্রান্তর মক্কা নগরীতে একাকিত্ব অবস্থান, ছেলে ইসমাইল (আ.)-কে নিজ হাতে কোরবানি করার নির্দেশ, কাবাঘর নির্মাণ এবং ১০টি খাসায়েল বা প্রকৃতিসুলভ কাজ জীবনে বাস্তবায়ন ইত্যাদি ছিল ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য বড়ই কঠিন পরীক্ষা। সব পরীক্ষায় ইবরাহিম (আ.) শতভাগ সাফল্য লাভ করেছেন। সাফল্যের স্বীকৃতি ও সনদ আল্লাহতায়ালা কোরআনে ঘোষণা করেছেন। সাফল্যের প্রতিদান হিসেবে আল্লাহতায়ালা তাঁকে মানবসমাজের নেতৃত্ব প্রদান করেছেন। চলমান বিশ্বের সব নৈরাজ্য পরিত্রাণ করে পৃথিবীটাকে সুখ-শান্তির স্বর্গে পরিণত করার জন্য, আদর্শ নেতৃত্ব অর্জনের জন্য নবী ইবরাহিম (আ.)-এর গুণাবলি আমাদের অর্জন করতে হবে। আদর্শবান হতে হবে। হতে হবে চরম ধৈর্যশীল, ত্যাগী, পরম নীতিমান ও উত্তম চরিত্রবান।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা।