রবিবার, ১৮ জুলাই, ২০২১ ০০:০০ টা

মানুষের নীতি-নৈতিকতার এ ধস!

খায়রুল কবীর খোকন

মানুষের নীতি-নৈতিকতার এ ধস!

একবিংশ শতাব্দীর এই বিশে^ মানবসভ্যতা শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায়, নব নব আবিষ্কারে-উদ্ভাবনে যে বিশাল অগ্রগতি সাধন করেছে তা তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু শিক্ষিতজনের মধ্যে জীবনাচারে নীতি-নৈতিকতার, মূল্যবোধের যে দুঃসহ ধস নেমেছে এবং সে ধস যে ক্রমবর্ধমান তা কোনো অগ্রগতি দিয়েই তো ঠেকানো যাচ্ছে না।

আমার বড় ভাইয়ের চার দশকের বন্ধু মুরাদ মিরধা (ছদ্মনাম)। এ দেশের প্রথম দুই দশকের এক নম্বর বাংলা দৈনিকের দক্ষ রিপোর্টার মুরাদ মিরধা জীবিকার তাগিদে এখন বাংলাবাজারের একটি বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থার প্রকাশিতব্য বইয়ের ‘অখ্যাত সম্পাদনা’র কাজ করতে বাধ্য হন। পাঁচ দশকের লেখক সহজে কাবু হন না। কিন্তু তিনি কাবু হয়ে পড়েছেন একটি বইয়ের প্রæফ সংশোধনের কাজ করতে করতে। খ্যাতিমান লেখক-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-ইতিহাসবিদের একটি বই। বিষয়বস্তু হচ্ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ে ‘মিথ্যাচার’ (ইতিহাস-বিকৃতি) ইত্যাদি। অনাচারগুলো করেছেন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা শিক্ষকরা আর শিক্ষক-নামধারী টেক্সট বুক বোর্ড কর্মকর্তারা। শিশু ও কিশোর পাঠ্যবইগুলোয় তারা যে মিথ্যাচার করেছেন তার নজির বিশে^র অন্য কোথাও আছে কি না সন্দেহ। এ বই পড়তে পড়তে যখন সম্পাদনার কাজ করতে হয় তখন রীতিমতো অসুস্থ বোধ করেন মুরাদ মিরধা, কাজে এগোতে নিদারুণ কষ্ট হয় তাঁর। (তিনি নিজেই এ ঘটনার কথা আমাকে বলেছেন এবং তার মধ্যে মিথ্যাচারের রোগটা নেই বললে চলে)। ভাবী, অত্যন্ত বেদনাহত চিত্তে- এ দেশে সাধারণ নাগরিকের মধ্যে শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকা মানুষের কথা বাদই দিলাম, যারা রাষ্ট্রের অর্থে শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত হয়েছেন, সেসব সুবিধাভোগী মানুষের মধ্যে মূল্যবোধের এই যে ধস, এই যে নরক অবক্ষয় এসব কীভাবে ঠেকাব আমরা? বিশ্বসেরা একটি মুক্তিযুদ্ধে লড়েছে আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম, পাকিস্তানি বর্বর উপনিবেশবাদী শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, তারও আগে প্রায় আড়াই দশক ধরে সংগ্রাম করতে হয়েছে ওই নিষ্ঠুর শোষক গোষ্ঠীর বিপক্ষে মুখোমুখি হয়ে। আবার তারও আগে ২০০ বছর লড়তে হয়েছে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী শাসক-শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। একটা গণতন্ত্রের, সুশাসনের, সামাজিক ন্যায়বিচারের, সত্যনিষ্ঠ ও মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যেই তো এত বড় রক্তক্ষয়ী একটা স্বাধীনতার-সশস্ত্র যুদ্ধ আমাদের পূর্বপুরুষদের লড়তে হয়েছিল। যদি মিথ্যচারের সমাজই কায়েম করতে হবে তাহলে এত আত্মত্যাগ কীসের জন্য?

আমাদের দেশে কি সাধারণ নাগরিকের মধ্যে ব্যক্তিগত সততার বিষয়টি একেবারেই ম্লান থেকে ম্লানতর হতে হতে এখন তলানির শেষ পর্যায়ে? শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করে তাতে আগুন-নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থাই না রেখে, উল্টো খাবার ও পানীয় তৈরির কারখানায় অবৈধভাবে কেমিক্যাল এবং নানারকম দাহ্যবস্তুর গুদাম বানিয়ে রেখেছিলেন রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস কারখানার মালিক। শিশু-কিশোর শ্রমিক (যা এ দেশের আইনে নিষিদ্ধ) নিয়োগ করা হয়েছে প্রচুরসংখ্যক। তার সঙ্গে অনেক বয়স্ক শ্রমজীবী কাজে ঢুকিয়েছেন- সবাই কম বেতনের কর্মজীবী। তারপর সবাইকে কারখানার তালাবদ্ধ ফ্লোরে কাজ করতে বাধ্য করা হলো। এবং তাতেই এই ৫২ পোড়া-কঙ্কাল তৈরি হলো। (৮ জুলাই বিকালে অগ্নিকান্ড শুরু হয়ে চলে প্রায় ২৭ ঘণ্টাব্যাপী)। করল কে? হাসেম মিয়া আর তার ম্যানেজারেরা। এটা কোন নীতি-নৈতিকতার মধ্যে পড়ে? এ তো পুরোদস্তুর হত্যাকান্ড। সাধারণ সততার কথা বাদ দিলেও মানুষের মধ্যে যে কতটা নিষ্ঠুরতা কাজ করে, কতটা নির্মমতার বিকৃত আচরণ তা এই হাসেম গংদের দেখলেই বোঝা যায়। এমনকি আগুন লাগার পরেও ফ্যাক্টরি ভবনের চার তলার সিঁড়ির গেটের তালা খুলে দিয়ে শ্রমিকদের বেরোনোর ব্যবস্থা করেনি, তারা আগুন নেভানোর সময়েও দমকল বাহিনীকে জানায়নি, ছয় তলা ভবনটির চার তলায় শ্রমিকরা আছে আটকা পড়ে- তাদের উদ্ধার করতে হবে। কত বড় বর্বর এসব মানুষ নামধারী শিল্পকারখানার মালিক? হাসেম ফুডস মালিকপক্ষ ও তাদের ম্যানেজারদের মধ্যে কি সামান্যতম সততারও লেশমাত্র নেই? যে কোনো শিল্পকারখানা গড়ে তোলার সময়েই দমকল বাহিনী, শিল্পকারখানা পরিদর্শন অধিদফতর, বিস্ফোরক অধিদফতর, পরিবেশ অধিদফতর প্রভৃতি থেকে ‘ফিটনেস’ অনুমোদনপত্র বা সার্টিফিকেট নিতে হয়। তা ছাড়া স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসন, পৌরসভা বা স্থানীয় সরকার বিভাগ ও পুলিশ প্রশাসনের তদারকি থাকে। সেই তদারকি ও উপরোক্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের অনুমোদন বছর বছর নবায়নও দরকার পড়ে। এসব অফিস এ অগ্নিকান্ডের দায়দায়িত্ব এড়াতে পারে না, কোনোভাবেই না। প্রতিটি অফিসের কর্মকর্তাদের নীতি-নৈতিকতায় ধস নেমেছে বলেই এ রকম মানবসৃষ্ট অগ্নিদুর্ঘটনা সম্ভব হয়েছে। তাদের প্রত্যেককেই বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিদান অপরিহার্য।

এবং সারা দেশে শিল্পকারখানা মালিকদের মধ্যে খোঁজ নিলে এ রকম হাসেম গং পাওয়া যাবে শত শত, না শত শত নয়, হাজার হাজার। সারা দেশে যে ৩০ হাজার শিল্পকারখানা আছে নানা আকারের, তার মধ্যে তো ২৯ হাজারের কারখানা হিসেবে বিশ্বমানের স্ট্যান্ডার্ডে কোনো অনুমোদন লাভের ন্যূনতম যোগ্যতাই নেই। বড়জোর হাজারখানেক কারখানা শ্রমিকের সার্বিক নিরাপত্তা বিধানের সুবিধা দিয়ে সেসব প্রতিষ্ঠা করেছে। মানে শতকরা সাড়ে ৩ শতাংশ কারখানার ফিটনেস আছে হয়তো বলা যাবে। মানে সাড়ে ৯৬ শতাংশই কারখানা নামের অযোগ্য। প্রতিটি এক একটি মৃত্যুকূপ। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ঘটনায় প্রায় বারো শ শ্রমিক নিহত হন ভবন মালিক ও কারখানা মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতায়। আহত ও পঙ্গু হন শত শত শ্রমিক। সেই মামলার বিচার কিন্তু এখনো পাননি নিহত ও আহত ব্যক্তি ও তাদের অসহায় স্বজনরা। এর পরে তাজরীন গার্মেন্টের মালিকের গাফিলতিতে অগ্নিকান্ডে নিহত হন ১৩০ জন শ্রমিক, আহত হন অনেকে। কিন্তু তাজরীনের মালিককে আইনের কাঠগড়ায় নিয়ে সুবিচার লাভ করা যায়নি এখনো। আরও অনেক কারখানায় আগুন লেগে শ্রমিক নিহত হয়েছেন মালিকপক্ষ ও তাদের ম্যানেজারদের দোষে। কিন্তু কোনো বিচারই পাননি, নিহত ও আহত শ্রমিক ও তাদের স্বজনরা। এসবই রাষ্ট্রের ভিতরকার অসাধু নেতৃত্বের ক্ষমার অযোগ্য দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে। ব্যক্তির অসততা নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম। ব্যক্তিগত পর্যায়ে মানুষ সৎ হতে পারেন যদি সেই ব্যক্তির থাকে প্রচন্ড আত্মসংযম। এবং সেই সংযম আসবে তার শিক্ষা-দীক্ষা থেকে অর্জিত চেতনা থেকে। রাষ্ট্র যদি সৎ নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হয় তাহলে সেই সমাজে উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি হবে গণমানুষের জন্য এবং তাতে ব্যক্তিমানুষের মাঝে সততার চেতনা বেশি সহজে পাকাপোক্ত হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রের সমাজে যেখানে সৎ নেতৃত্ব কায়েমের আশাই প্রায় দুরাশা, সেখানে দেশ মানুষের বড় অংশকে ভালো শিক্ষিত মানুষে রূপান্তরের মাধ্যমে তাদের সততার চেতনা সৃষ্টির বিষয়টি একেবারেই সুদূরপরাহত।

তাহলে উপায়? উপায় তো খুঁজে বের করতেই হবে। উপায় হচ্ছে, তারুণ্যের ভিতরে গণজাগরণ সৃষ্টি। যে তারুণ্য ঊনসত্তর গণঅভ্যুত্থান ঘটায়, যে তারুণ্য একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করে। যে তারুণ্য আশির দশকের হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মতো দানব-স্বৈরাচারকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিদায় করে নব্বইয়ের শেষ প্রান্তে। যে তারুণ্য ২০১৩ সালের শাহবাগ গণজাগরণ ঘটায় এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি বাস্তবায়নে মূলশক্তির ভূমিকা পালন করে। সে তারুণ্যকেই জেগে উঠতে হবে। তাদের জাগাতেই হবে। শুধু ব্যক্তির আত্মসংযম দিয়ে জনে জনে যে সততা তা অর্জনের প্রচেষ্টা কোনো সুফল দেবে না, যতক্ষণ না রাষ্ট্র তার তারুণ্যকে জাগিয়ে দেবে- সুশিক্ষা লাভের একটা বিশাল কর্মযজ্ঞে, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথে, সুশাসন কায়েমের লক্ষ্যে, সমৃদ্ধ রাষ্ট্র সুপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে।

লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর