সোমবার, ৩০ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

গতি যার নীচ সহ, নীচ সে দুর্মতি

তুষার কণা খোন্দকার

গতি যার নীচ সহ, নীচ সে দুর্মতি

শিরোনামের বাক্যটি আমার নিজের নয়। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ বধ কাব্য থেকে ধার করেছি। মহাকাব্য থেকে এমন ভারী ভাবের একটি শিরোনাম ধার করলাম কারণ আমি আজ চটুল কথা বলার মৌজে আছি। উপসম্পাদকীয় মানে গুরুগম্ভীর কিছু বলার জায়গা, এটি হাস্য রসিকতার আসর নয়। এমন চিরন্তন নিয়মের ব্যত্যয় ঘটাচ্ছি বলে শিরোনামটি মহাকাব্য থেকে ধার করে নিজের দোষ স্খলন করার পথ খুলে রাখলাম। কিছুদিন ধরে টেলিভিশনের পর্দায় ক্রমাগত একটি খবর দেখতে পাচ্ছি যেটাকে ধারাবাহিক নাটকের চটুল রঙ্গ থেকে কিছুতেই আলাদা করতে পারছি না। সেই রঙিলা খবরই আমার এমন মৌজমস্তির উৎস। কিছুদিন আগে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের এক নেত্রী পাপিয়া গণমাধ্যমকে গিলে খেয়েছিল। তার মাদক এবং দেহব্যবসার রগরগে চটুল কাহিনি গণমাধ্যমের পাঠক এবং দর্শকের বিপুল আনন্দ দিচ্ছিল। রাজনৈতিক নেত্রী পাপিয়া ঢাকা শহরের দামি হোটেলের মহাদামি কক্ষ ভাড়া করে মাদক এবং দেহব্যবসা জমিয়ে তুলেছিলেন। অনেক দিন ধরেই পুলিশ এবং প্রশাসনের নাকের ডগায় পাপিয়াকা  নির্বিঘ্নে মঞ্চস্থ হচ্ছিল। দীর্ঘদিন ধরে দামি হোটেলের দামি রুমে বসে পাপিয়া পতিতা এবং মাদকের ব্যবসা চালিয়ে গেলে তাতে কারও কোনোরকম মাথাব্যথার উদ্রেক হয়নি। কিন্তু হঠাৎ বেচারা পাপিয়ার বাড়া ভাতে সবাই ছাই দেওয়ার জন্য কেন ওঠেপড়ে লাগল সেটা তখন ঠিক বুঝে ওঠতে পারিনি। পাপিয়ার রাজনৈতিক শক্তির উৎস কী ছিল কে জানে। নামিদামি হোটেলের কক্ষ ভাড়া নিয়ে মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া এবং দেহপসারিণীদের পুষে তাদের দিয়ে বিত্তবান এবং ক্ষমতাবান খদ্দের ধরে ব্যবসা করার কাজটি সে একা নিজ ক্ষমতাবলে দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে গেছে এটি আমাদের বিশ্বাস করতে বলা হয়েছিল। পাপিয়া এবং তাদের পালনকর্তাদের ওপর আমাদের বিশ্বাস আছে কি নেই সেটি কোনো প্রশ্ন নয়। আমরা জানি, এ সমাজে গা বাঁচিয়ে বেঁচে থাকার জন্য আমজনতাকে সারল্যের ওপর বিশ্বাস রাখতে হয়। কাজেই যথারীতি আমরা পুলিশ এবং প্রশাসনের বয়ান সরলভাবে বিশ্বাস করার ভান করেছি। তবে আমরা সবাই মনে মনে জানি, পাপিয়ার মাথার ওপরে কেউ একজন ‘ধরে ছত্র ছত্রধর’। সেই মহাপরাক্রমশালী ছত্রধরের সন্ধান আমরা আমজনতা কোনোদিন পাব না এটাও জানি। পুলিশ বলল, পাপিয়ার মাথার ওপরে কেউ  নেই। এ পাপীয়সী পাপিয়া সবার চোখের আড়ালে বড়লোকের বখে যাওয়া স্কুল-কলেজগামী ছেলেদের সঙ্গে সখ্য গড়ে হোটেলের দামি রুমে বসে মদ এবং নারীর আসর পেতেছিল। সমাজের যারা অভিভাবক তারা এটি জানতে পেরে পাপিয়ার পাপের আস্তানা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। পুলিশের মুখ থেকে আমরা আমজনতা বিষয়টি বিশদে জানতে পেরে মারহাবা বলে জোকার দিয়ে যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম ঠিক তখনই আরেক পাপীয়সী পরীমণি আর তার সাঙ্গোপাঙ্গরা টেলিভিশনের পর্দায় কী অনাসৃষ্টি শুরু করল! গত কয়েক সপ্তাহ ধরে টেলিভিশনের পর্দায় নাটকের মতো খবর (শুধু প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য) অর্থাৎ আদি রসের ইঙ্গিতে ভরা পরীমণি নামের দৃশ্যকাব্য দেখে ভিরমি খেলাম। টেলিভিশনের পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে পত্রিকার পাতায় মন বসাতে গিয়ে দেখি সেখানেও সেই পরীমণি, পিয়াসা এবং পরীমণির পোশাক ডিজাইনার জিমি নামের চরিত্র। এরা সবাই মাদক এবং দেহব্যবসার সঙ্গে জড়িত। পরীমণির নাচের যেসব খন্ডচিত্র টিভি পর্দায় দেখলাম তাতে তো উনার গায়ে কয়েকটা কাপড়ের চিকন ফালি ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না। যার গায়ে পোশাকের বালাই নেই তার আবার পোশাক ডিজাইনার! জিমি নামের লোকটি পোশাক ডিজাইনার এটা শুনে সত্যিকার পোশাক ডিজাইনাররা বড় সংকোচে পড়ে গেছে। পরীমণি নাটকের প্রথম মহড়া হয়েছিল তুরাগের কিনারে বোট ক্লাবের বারে। পুলিশ বলছিল, তারা নাকি পরীমণি এবং তার পোষ্য পতিতাদের ৩০০ খরিদ্দারের সন্ধান পেয়েছে। পরীমণি নাকি সেই ৩০০ খরিদ্দারের নারীভোগের গোপন ভিডিও ধারণ করে সেই ভিডিও দেখিয়ে অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতাশালী খদ্দেরদের ব্ল্যাকমেল করেছে। ব্ল্যাকমেলিং এক ভয়ানক ক্রাইম। ব্ল্যাকমেলিংয়ের মতো ক্রাইমে না জড়িয়ে পরীমণির উচিত ছিল তার দেহব্যবসায় তুষ্ট থাকা। আসলে অতি লোভে তাঁতী নষ্ট। পরীমণি তার খরিদ্দারদের ক্ষমতার সীমা ভুলে গিয়েছিল। ভুলে গিয়েছিল, সে তার শরীরকে পণ্য হিসেবে বাজারে বিক্রি করতে গেছে। সেই বাজারের রীতি হচ্ছে ফেল কড়ি মাখ তেল। সমাজের যারা মাথা তারা পরীমণির কাস্টমার। তারা নগদ কড়ি ফেলে তেল কিনেছে। পরীমণির শরীরের খরিদ্দাররা নামিদামি মানুষ। তারা পরীমণির তুচ্ছ ভিডিওর কাছে ভেড়া বনে যাবে এটি সে কল্পনা করল কী করে। পরীমণিরা ভুলে যায়, তারা গতর বেচার পেশায় নাম লিখিয়ে নিজেদের খেলো করে ফেলেছে। তারা যদি গতর খাটিয়ে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করত তাহলেও তাদের গলা উঁচিয়ে কথা বলার অধিকার থাকত। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পরীমণি কথাটা মাথায় রেখে সে তার ব্যবসার ক্ষেত্র ঠিক করবে। আবার দেখুন, কিছু লোক বলছে, পরীমণির ৩০০ খরিদ্দারের তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। পুলিশ বলছে, পরীমণির কাস্টমাররা কেউ ফেলনা নয়। অর্থবিত্তশালী ক্ষমতাবান মানুষদের পর্নো ছবি প্রকাশ পেলে মানী মানুষগুলোর মানহানি হবে না? পরীমণির মতো দেহব্যবসায়ীর কথায় মানী মানুষদের মানহানি করার অধিকার কি পুলিশের আছে। দেখলেন না, এক পুলিশ কর্মকর্তা পরীমণির আসঙ্গলিপ্সায় মজে গিয়েছিল বলে পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন উনারা নাকি পুলিশ বিভাগের অর্বাচীন পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে বেশ বিব্রত আছেন। পুলিশের আরেক কর্তাব্যক্তি বললেন, সাকলায়েন নামের পুলিশ কর্মকর্তা নাকি পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে। হতে পারে! আমরা আমজনতা পুলিশ কর্মকর্তার এ অভিযোগের কী বিচার করব। চিরকাল দেখছি আমজনতার হাতে পুলিশ হাতকড়া পরায় কিন্তু আমজনতা কি কারোর হাতে হাতকড়া পরানোর অধিকার রাখে? পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা পুলিশ অফিসার সাকলায়েনের কান্ড দেখে জনতার দরবারে যেভাবে নালিশ দিলেন ওতে আমরা ভারি শরমিন্দা হলাম। কাজেই দুঃখের সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের সদয় অবগতির জন্য জানাচ্ছি, প্রাচীন ভারতে পরীমণিদের মতো দেহব্যবসায়ীদের বলা হতো জনপদকল্যাণী। প্রাচীন ভারতের সমাজপতিরা বিশ্বাস করতেন দেহপসারিণীরা আছে বলেই নারীসঙ্গ লালসায় উন্মাদ পুরুষগুলো টাকা ঢেলে তাদের নারীসঙ্গলিপ্সা মেটাতে পারছে। ফলে লম্পটরা সমাজে অনাসৃষ্টি করতে পারছে না। দেহপসারিণীরা আছে বলে সমাজে অন্য নারীরা পুরুষের লোলুপতা থেকে রক্ষা পাচ্ছে বলে সমাজপতিরা বিশ্বাস করতেন। এটি সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষার প্রাচীন ভারতীয় সমাজপতিদের দেওয়া টোটকা ফর্মুলা। বলতে পারেন দেহব্যবসায়ীদের জনপদকল্যাণী নামে চিহ্নিত করা পুরুষশাসিত সমাজের নির্মম গোঁয়ার্তুমি। পতিতাদের জনপদকল্যাণী বলে সম্বোধন করার মধ্য দিয়ে পুরুষের লাম্পট্যকে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। আজকের দিনে এসব ছেঁদো কথার কোনো দাম নেই। পরীমণির খরিদ্দাররা কেউ আইন ভঙ্গ করেনি এ কথা পুলিশ জোর দিয়ে বলছে। পেনাল কোডে বর্ণিত ব্যভিচারের ধারার আইনি মারপ্যাঁচ মাথায় রেখে পুলিশ এটি বলতেই পারে। এ প্রসঙ্গে আমার জিজ্ঞাসা, পরীমণির খরিদ্দাররা যদি নির্দোষ হয়ে থাকে তাহলে পরীমণি কোন দোষে দোষী হলো যে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞসাবাদ শুরু করে দিল? এ যেন একযাত্রায় দুই ফল। আমি বলি কী, পরীমণির খদ্দেররা যদি নির্দোষ হয় তাহলে পরীমণিও নির্দোষ। পরীমণির খদ্দেরদের তালিকা প্রকাশ করা উচিত হবে নাকি কাজটি বেআইনি হয়ে যাবে সেটি পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা আইনের বই ঘেঁটে নিশ্চিত হয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছেন এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তারা বিজ্ঞ মানুষ, সব দিক বিবেচনা করে যেটা ভালো সেটাই করবে। তবে পরীমণির খদ্দেরদের তালিকা প্রকাশ করা প্রসঙ্গে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাই। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পরে কমিউনিস্ট পার্টি রাশিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করল। একনায়ক শাসক হিসেবে লেনিন রাশিয়ার মানবাধিকারের প্রতি চরম অশ্রদ্ধাশীল হলেও পতিতাবৃত্তির ব্যাপারে তিনি বল প্রয়োগের পথে না গিয়ে ভীষণ লিবারেল ভূমিকা নিলেন। রুশ বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পরে রাশিয়ার সব শহরে পতিতাপল্লী বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। লেনিনের সেই উদ্যোগে রুশ কমিউনিস্ট পার্টির বাঘা বাঘা নেতারা বাগড়া সেধে বসল। লেনিন বললেন, ঠিক আছে। তোমরা যখন বলছ তাহলে বুর্জোয়া রাশিয়ায় দেহব্যবসা যেমন চলছিল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নে সেটি তেমনি চলবে। তবে দেহব্যবসা চালানোর ব্যাপারে আমার একটি শর্ত মানতে হবে। শর্ত হলো- পতিতাদের কাস্টমারের তালিকা পতিতালয়ের গেটে টানিয়ে রাখতে হবে। লেনিনের নির্দেশ যথারীতি পালন করা হয়েছিল। লেনিনের দেওয়া এ সমাধান বাস্তবে অনেকখানি কাজ দিয়েছিল। রাশিয়ার সমাজে নামিদামি লোক সে সময় নাম প্রকাশ হওয়ার ভয়ে পতিতালয়ে যেতে দ্বিধা করত। কাস্টমার না পেয়ে রাশিয়ার দেহব্যবসায়ীদের ব্যবসা লাটে উঠতে বসেছিল। আমাদের দেশের পুলিশ প্রশাসন পতিতাবৃত্তির রাশ টেনে ধরার জন্য কাস্টমারের তালিকা প্রকাশের কৌশল গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখতে পারে।

ওপরে যা কিছু লিখেছি তার একটিও আমার নিজের কথা নয়। আমি অতি সাধারণ মানুষ। দেশের আমজনতার ভাবনাকে বর্ণনায় রূপ দিয়েছি মাত্র। আমজনতার সবাই কিন্তু আমার মতো মিষ্টভাষী নয়। তাদের অনেকে ভয়ানক দুর্মুখ। তারা বলে, সাধারণ মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে পি কে হালদার সেফ প্যাসেজ দিয়ে সড়কপথে দেশত্যাগ করলেন তাকে কেউ আটক করার জন্য এগিয়ে এলো না। অথচ একজন পরীমণিকে নিয়ে কী টানাহেঁচড়া না চলছে। পি কে হালদার আরামসে দেশত্যাগ করার পরে উনার অসুর সহযোগীরা দেশের মধ্যে দিব্যি আয়েশে দিন কাটাচ্ছে তাতেও পুলিশ কিংবা প্রশাসন বাদ সাধছে না। পত্রিকায় পড়েছিলাম পি কে হালদারের নাকি ৮৮ জন গোপিনী ছিল। সেই  জনপদকল্যাণীদের একজনকে পুলিশ একবারের জন্য ডেকে আদর আপ্যায়ন করে দুটো কথা জিজ্ঞেস করলে পি কে হালদারের হাতে টাকা খোয়ানো দুঃখী মানুষগুলো একটু         সান্ত্বনা পেত। যাক! কী আর করা! সেটাও যখন ঘটল না তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, সর্বত্রই একযাত্রায় দুই ফল।

লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সর্বশেষ খবর