মঙ্গলবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

জহুরুল ইসলাম : স্বমহিমায় অমর যিনি

মো. জিল্লুর রহমান

জহুরুল ইসলাম : স্বমহিমায় অমর যিনি

আলহাজ জহুরুল ইসলাম এমন একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলেন যাঁর পরিচয় শুধু একজন সফল শিল্পপতি বা ব্যবসায়ীই নয় বরং মানুষ হিসেবেও অনুকরণীয়। এ জগৎ সংসারে প্রতিদিন কত মানুষের জন্ম হয় আবার কত মানুষ প্রয়াত হয়। এটাই জাগতিক নিয়ম। তবে এ জন্ম-মৃত্যুর মধ্যে এমন কিছু মানুষ থাকেন যাঁরা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও বহুকাল অমর হয়ে থাকেন তাঁদের কর্মে, সাফল্যে ও মানবহিতৈষী ভূমিকার জন্য। আলহাজ জহুরুল ইসলাম এ জনপদের তেমন একজন মানুষ। আজ তাঁর ২৭তম প্রয়াণ দিবস। ১৯৯৫ সালের ১৯ অক্টোবর তিনি ইন্তেকাল করেন। সময়ের বিবেচনায় অনেকটা অপরিণত বয়সেই তাঁর বিদায়। তবে স্বল্পসময়ের জীবনেই তিনি এমন কিছু কর্মের স্বাক্ষর রেখে গেছেন যে কারণে মরেও অমর হয়ে আছেন। এ দেশে তাঁর কর্ম ও সাফল্যের অসংখ্য ঘটনার কারণেই তিনি বেঁচে থাকবেন অনেক দিন। জহুরুল ইসলামকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আমাদের দেশের সংবাদপত্রে অনেক প্রবন্ধ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রবন্ধে তাঁর সম্পর্কে বিভিন্ন গুণীজনের মতামত ও মূল্যায়ন পড়েছি। তাঁদের মধ্যে দু-এক জনের লেখা প্রবন্ধের অংশবিশেষ উদ্বৃত করেই তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। এ মাটির একজন সফল রাজনীতিকের নাম তোফায়েল আহমেদ। তিনি জহুরুল ইসলাম সম্পর্কে সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে তাঁর প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে লিখেছেন- ‘ব্যক্তিগত জীবনে জহুরুল ইসলাম ছিলেন আমার শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে থাকার দুর্লভ সৌভাগ্যের অধিকারী। বঙ্গবন্ধুর ¯ন্ডেœহ-ভালোবাসায় আমার জীবন সিক্ত। জহুরুল ইসলামকে আমি ছাত্রজীবন থেকেই চিনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জহুরুল ইসলামকে ভালোবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন। বঙ্গবন্ধু যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি, কারাগারে বন্দী, ফাঁসির মঞ্চে দন্ডায়মান- সেই কঠিন দুঃসময়ের দিনগুলোয় জহুরুল ইসলাম আমাদের পাশে দাড়িয়েছিলেন।’ স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন- ‘’৬৯-এর গণআন্দোলনের পরে যখন বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকতে শুরু করি তখন দেখতাম জহুরুল ইসলাম প্রায়ই বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে আসতেন। বঙ্গবন্ধু গভীর আন্তরিকতা ও ভালোবাসা নিয়ে তাঁর সঙ্গে নিবিড়ভাবে কথা বলতেন।’ তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন- ‘আমার দেখা মতে বঙ্গবন্ধুর যখন অর্থের প্রয়োজন হতো জহুরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে তা দিয়ে যেতেন এবং বিষয়টা আমি চিরদিন মনে রাখব।’ তিনি জহুরুল ইসলামকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে- ‘তাঁর মতো এমন দূরদৃষ্টি, বেগবান এবং সক্রিয় শক্তিসম্পন্ন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা আমাদের সমাজে বিরল ও ব্যতিক্রম। তিনি ছিলেন একজন বিনয়ী পরমতসহিষ্ণু, সজ্জন ব্যক্তি।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনে চাকরিতে ছিলেন বাঙালি কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমদ। যুদ্ধের মাঝামাঝি চাকরির মায়া ত্যাগ করে ঝুঁকি নিয়ে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেন। লন্ডনে তখন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করছেন। এ সময় বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন তাঁদের অন্যতম মহিউদ্দিন আহমদ। চাকরি জীবনের শেষ দিকে তিনি বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। বছর পাঁচেক আগে জহুরুল ইসলামকে নিয়ে তিনি একটি দীর্ঘ নিবন্ধ লিখেছেন, যা দেশের একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর নিবন্ধে জহুরুল ইসলাম সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে জাতির সামনে গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য উপস্থাপন করেছেন। তথ্যটি ছিল এ রকম- মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জহুরুল ইসলাম প্রচন্ড ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা ছেড়ে লন্ডন চলে গিয়েছিলেন। লন্ডনে তিনি বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর হাতে ৫ হাজার পাউন্ড তুলে দেন। সেদিনের ৫ হাজার পাউন্ড দেওয়ার মতো এত বড় মাপের মানুষ এ দেশে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। বিচারপতি চৌধুরী এ অর্থদাতার নাম তখন প্রকাশ করেননি। মহিউদ্দিন সাহেবকে এ ৫ হাজার পাউন্ড ‘সুবিদ আলীর’ নামে জমা করার জন্য বলেছিলেন তিনি। পরে জানা যায় যে এই সুবিদ আলী হচ্ছেন জহুরুল ইসলাম। মহিউদ্দিন সাহেব কোনো কিছু গোপন না করে স্পষ্ট করে লিখেছেন- ‘এ ৫ হাজার পাউন্ডের ওপর ভরসা করেই লন্ডনে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন খোলা হয়।’ জহুরুল ইসলাম সম্পর্কে এমন অনেক তথ্য আছে যা আজকের দিনে অনেকেই বিশ্বাস করবেন না। এ দেশে এখন শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন অনেকেই, কিন্তু পাকিস্তানি জমানায় বাঙালি কোটিপতির সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ও পরে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে, অসংখ্য বাঙালি যুবকের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি এ দেশের রাজনীতিবিদদের সংসার নির্বাহে অর্থের জোগান দিতেন, কিন্তু কখনো প্রকাশ করতেন না। পাকিস্তান আমলে নানা গণআন্দোলনে তিনি প্রয়োজনীয় অর্থের জোগানসহ নানাভাবে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব অতিশয় নিষ্ঠা আর সততার সঙ্গে পালন করে গেছেন। জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি তাঁর জন্মস্থান কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার ভাগলপুরে একটি উন্নতমানের মেডিকেল কলেজ, একটি নার্সিং কলেজ ও ৫০০ শয্যার একটি আধুনিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। কিশোরগঞ্জ জেলা শুধু নয়, আশপাশের জেলাগুলো থেকে প্রচুর মানুষ এ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। যা অনেকের পক্ষেই রাজধানীতে এসে গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মেডিকেল কলেজ থেকে দেশি-বিদেশি বহু ছাত্র চিকিৎসাবিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে মানবসেবায় নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। জহুরুল ইসলামকে এ দেশে হাউজিং ব্যবসার জনক বলা হয়। রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরে তাঁর সৃষ্ট ‘ইস্টার্ন হাউজিং’য়ের অসংখ্য স্থাপনা চোখে পড়ে। তিনি মহানগরীতে আফতাবনগর, মহানগর, নিকেতন, বনশ্রীসহ নানা হাউজিং প্রকল্প গড়ে তুলেছেন। দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে গড়ে তুলেছেন পোলট্রি শিল্প, ওষুধ শিল্পসহ নানা প্রতিষ্ঠান। সবচেয়ে বড় সত্য হচ্ছে তিনি তাঁর উপার্জিত অর্থের সিংহভাগ ব্যয় করেছেন দেশের মানুষের কল্যাণে।

১৯৭৪ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় তিনি নিজ জেলার ১৩ উপজেলার নানা স্থানে লঙ্গরখানা খুলে লাখ লাখ অসহায় মানুষের মুখে আহার তুলে দিয়েছেন। এ লঙ্গরখানা চালু রাখতে ব্যাংক থেকে তাঁকে ঋণ নিতে হয়েছিল বলেও জানা যায়। ২৭তম প্রয়াণ দিবসে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে নিঃসংকোচে এ কথা বলা যায়- সমাজের অবহেলিত মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্ন তিনি বাস্তবে রূপ দিয়ে গেছেন। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

                লেখক : চেয়ারম্যান, কিশোরগঞ্জ, জেলা পরিষদ।

সর্বশেষ খবর