শহরে শীতের হাওয়া একটু দেরিতেই এলো। ঘনবসতি, আজদাহার মতো দালানকোঠা, আর বড় বড় কলকারখানার কারণে শীতের আমেজ পেতে বেশ সময় পেরিয়ে গেল। দিনের বেলায় এখনো আমাদের ফ্যান-এসির দরকার পড়ে। রাতে হালকা গরম কাপড়েই চলে যায়। কিন্তু মফস্বলের খবর কি আমরা রাখি? অজপাড়াগাঁয়ের মানুষের কথা একবারও কি আমাদের মনের আয়নায় ভাসে? যখন আমাদের আঙিনায় শীত উঁকি মারছে, তখন ওই আঙিনার মানুষ শীতে কেঁপে মরছে। হ্যাঁ! এটাই বাস্তব চিত্র। মাস দু-এক আগেই শীতের হাওয়া বইতে শুরু করে দেশগ্রামে। আরেকটি কথা বলতে ভুলে গেছি। শহুরেদের গায়ে শীতের হাওয়া লাগে না, কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। এ শহরের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ রাস্তায়-বস্তিতে-রিকশায়-ভ্যানে একটি মাত্র কাঁথা-কম্বল গায়ে দিয়ে রাত কাটিয়ে দেয়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহুরে বাতাসেও ভর করে শীত নামক দৈত্যটি। ওইসব হাড়হাভাতে মানুষকে সামনে পেয়ে কেড়ে নেয় তাদের রাতের ঘুম। প্রচন্ড শীত গায়ে মেখে আধো ঘুম আধো জাগরণে কেটে যায় তাদের রাত। আহা! এভাবেই একশ্রেণির মানুষের জীবন কেটে যায় লাল-নীল বাড়ির এ শহরে।
আল্লাহর কদমে অগণিত শুকরিয়া, তিনি আমাদের অনেক বেশি ভালো রেখেছেন। শীতের যন্ত্রণা থেকে দিয়েছেন নিরাপত্তা। আলহামদুলিল্লাহ! আমাদের আশপাশে যারা শীতের যন্ত্রণায় ছটফট করে রাত কাটায় তাদের খোঁজ নেওয়া, সাধ্যমতো গরম কাপড় তাদের হাতে তুলে দেওয়া আমাদের ইমানি দায়িত্ব। খুব বেশি শীত পড়লে কিংবা শৈত্যপ্রবাহ দেখা দিলেই টিভি-পত্রিকায় এবং সামাজিক মাধ্যমে শীতবস্ত্র বিতরণের খবর শোনা যায়। তখন শীতবস্ত্র বিতরণ করা দরকার ঠিক আছে। কিন্তু এ সময়ও পাড়া-পড়শি বস্তিবাসী এবং গরিব মানুষের মধ্যে শীতের কাপড় বিতরণ করা জরুরি। সেদিন বাসায় ফেরার সময় দেখেছি একটি ছেলে পাতলা গেঞ্জি দিয়ে মাথা থেকে পা অবধি ঢেকে রেখেছে। কাছে যেতেই কেঁদে ফেলে বলল, ‘আমনেরা তো আরামেই ঘুমান। আমাগো খোঁজখবর কে রাখে?’ প্রায় রাতেই দেখি ব্রিজের নিচে রাস্তার পাশে পাতলা কাঁথা গায়ে মুড়িয়ে শুয়ে থাকে ছিন্নমূল মানুষ! বস্তিগুলোরও একই অবস্থা। এসব দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ে না। পড়লেও হয়তো হৃদয় নাড়া দেয় না। কারণ আমরা এখন নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। নিজেদের ভালো থাকা, ভালো রাখা আমাদের কাছে বড় হয়ে উঠেছে। তাই হাড়হাভাতে মানুষগুলোর কথা আমরা ভাবী না।
রসুল (সা.) তাঁর পুরো জীবন ব্যয় করে যে সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন সে সমাজ কি আমরা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি? রসুলের সমাজের প্রতি তাকালে দেখা যায় সেখানে ছিল সাম্য-শান্তি-ঔদার্য। কেউ খাবে কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না- এ তো রসুল (সা.)-এর লালিত স্বপ্নের কথা। আফসোস! আজ আমরা কেউ রাতে আরামে ঘুমাই আর কেউ শীতের সঙ্গে লড়াই করে রাত কাটিয়ে দিই। বিশ্বাস করুন! এ দৃশ্য যদি রসুল (সা.) দেখতেন, তাহলে তিনি হয়তো আমাদের নামটি পর্যন্ত মুসলমানের খাতা থেকে কেটে দিতে বলতেন। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘সে কখনই মুমিন হতে পারে না যে নিজে ভালো খায়, ভালো পরে, আরামে ঘুমায় অথচ তার প্রতিবেশী না খেয়ে নির্ঘুম রাত কাটায়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘মুমিন সে ব্যক্তিকেই বলা যায় যে নিজের জন্য যা পছন্দ করে অন্যের জন্যও তা-ই পছন্দ করে।’সুপ্রিয় পাঠক! এ দুটো হাদিস সামনে রেখে নিজেকে জিজ্ঞেস করুন আপনি-আমি কি আমাদের আশপাশে শীতার্ত অনাহারী মানুষের কখনো খোঁজ নিয়েছি? আমরা আরাম-আয়েশে দিন যাপন করছি, অন্য মানুষের জন্যও আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করছি কি? অন্তত মন থেকেও কি চেয়েছি সবার দিনগুলো আরাম-আয়েশে হাসি-খুশিতে কেটে যাক? যদি উত্তর হ্যাঁ হয় তাহলে আপনি মুমিন। আর যদি উত্তর না হয় তাহলে রসুলের ঘোষণামতে এখনো মুমিন হতে পারেননি। তাহলে মুমিন হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ শুরু হোক আপনার আশপাশের শীতার্ত মানুষকে শীতবস্ত্র উপহার দিয়ে। আল্লাহতায়ালা আমাদের ভিতর মায়া-মমতা-দরদ জাগিয়ে দিন। সবার সুখে হাসার এবং দুঃখে কাঁদার তৌফিক দিন।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি।
www.selimazadi.com