মঙ্গলবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

কর সংস্কৃতির সংস্কারে চাই মনোভঙ্গির পরিবর্তন

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

কর সংস্কৃতির সংস্কারে চাই মনোভঙ্গির পরিবর্তন

বাংলাদেশে বিদ্যমান কর সংস্কৃতির বিকাশ নিয়ে চিন্তা-ভাবনার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। কেননা দেশের আয়কর দেওয়ার প্রেক্ষাপট দ্রুত উন্নত ও কার্যকর হওয়া দরকার। বাংলাদেশের ট্যাক্স জিডিপি অনুপাত এখনো কম। এটি একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ পরিস্থিতিও নির্দেশ করে। জিডিপি এত হলে ট্যাক্স কম হয় কী করে? তার মানে মানুষ ট্যাক্স ঠিকমতো দিচ্ছে না। আহরিত রাজস্বের মধ্যে প্রত্যক্ষ কর আয়করের অবস্থান এখনো তৃতীয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আহরিত মোট রাজস্ব আয়ের ৩৬/৩৭ শতাংশ ভ্যাট, ৩৩/৩৪ শতাংশ কাস্টম ডিউটি (সম্পূরকসহ আমদানি শুল্ক) এবং ৩০/৩১ শতাংশ আয়করের অবদান। অথচ অর্থনীতির স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম হচ্ছে, আয়কর হবে সর্বোচ্চ। অন্যগুলো থাকবে তার পরে। যে অর্থনীতিতে কোটি কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়, সম্পদ ভোগ করতে পারে তারা কেন আয়কর দেবে না? আয়কর তৃতীয় অবস্থানে থাকবে কেন? অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের এ ধরনের নাজুক কাঠামোর কারণে স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকে দেশ ৭০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশি ঋণ এবং প্রায় ৩৮ বিলিয়ন ডলার অনুদান গ্রহণ করেছে। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গৃহীত ঋণের পরিমাণ পাহাড়সমান। বিদেশি ঋণের আসলের বার্ষিক কিস্তির পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা। দেশি-বিদেশি ঋণের বার্ষিক সুদ পরিশোধে বাজেটের প্রায় ২০-২১ শতাংশই চলে যাচ্ছে। এ রকম একটি অর্থনীতিতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে খাতওয়ারি অসামাঞ্জস্যতাকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে আয়কর পরিস্থিতি উন্নয়নের বিকল্প নেই। আয়কর যথাযথভাবে দেওয়া হলে ট্যাক্স জিডিপি অনুপাত বাড়বে, অসামাঞ্জস্যতাও দূর হবে। যে দেশের ৬ লক্ষাধিক লোক ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করতে পারে, মাসে শত শত গাড়ি আমদানি হয়, সেখানে আয়কর থেকে এত কম রাজস্ব আসতে পারে না। এটা খুবই দুঃখজনক।

দেশে বিদ্যমান আয়কর আইনের কাঠামো এবং এর প্রয়োগ কৌশল সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়টিই আজ বিশেষভাবে বিবেচ্য হয়ে উঠছে এ কারণে যে করদাতা আর কর আহরণকারীর মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন যত বাড়বে কর সংস্কৃতির বিকাশ তত বাধাগ্রস্ত হবে। কর আইনের রাজনৈতিক প্রয়োগ শুধু সাময়িক তিক্ততার সৃষ্টি করবে না দীর্ঘ মেয়াদে অপপ্রয়োগের পথ উন্মোচিত হবে। আইন মানুষের জন্য, মানুষ আইনের জন্য নয় কিংবা মানুষের জন্য আইন, আইনের জন্য মানুষ নয় এ স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপারটি বিশ্লেষণে গেলে এটাই প্রতিভাত হয় যে মানুষের কল্যাণেই আইনের প্রয়োজন। তবে মানুষ আগে আইন পরে।

আয়করব্যবস্থা যেখানে সামাজিক সুবিচার ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে পারষ্পরিক পরিপূরক দায়িত্ব পালনের বিষয়, ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামোয় সংগত কারণেই যার যথার্থতা অনুসরণ ছিল অনুপস্থিত, আজকের বাংলাদেশ অতীতের ঔপনিবেশিক শাসনামলে যেভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য বিনিয়োগ তথা আর্থসামাজিক রাজনৈতিক দিক দিয়ে বিপুল বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার ছিল তা কি এখনো অব্যাহত থাকবে?

এ কথা অনস্বীকার্য থেকে যাবে যে বাংলাদেশের আয়কর আইনের ভাষা হবে সহজবোধ্য, জটিলতা পরিহারী এবং এর প্রয়োগ হবে স্বচ্ছন্দে সর্বজনীন ব্যবহার-উপযোগী। করদাতা যেন নিজেই নিজের আয়কর ফরম পূরণ, কর নির্ধারণ এবং সরাসরি তা দাখিলে সক্ষম হন। অর্থনীতির বিভিন্ন পর্যায়ে অবস্থানরত আয়কর দাতারা যেন অভিন্ন আচরণে আইনগতভাবে আয়কর প্রদানে দায়িত্বশীল হতে স্বতঃস্ফূর্ততা বোধ করেন। কর আদায় নয়, কর আহরণে করদাতা ও কর আহরণকারীর মধ্যকার দূরত্ব যত কমে আসবে, যত অধিক মাত্রায় করদাতা করজালের আওতায় আসবেন তত কর রাজস্ব আহরণে সুষম, সহনশীল ও দায়িত্ববোধের বিকাশ ঘটবে। এরূপ পরিস্থিতিতে করদাতাকে তাড়া করে ফেরার স্পর্শকাতরতার অবসান ঘটবে। তবে এ সবকিছুই নির্ভর করবে আয়কর আইনের ভাষা আর দৃষ্টিভঙ্গিতে কার্যকর ও কল্যাণপ্রদ পরিবর্তন আনয়নের ওপর। আর সে প্রত্যাশা পূরণ প্রয়াসে আইন পরিষদ, নির্বাহী বিভাগ এবং করদাতা নির্বিশেষে সবার সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক হবে।

করদাতা ও কর আহরণকারীর মনোভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তনের পাশাপাশি দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা ব্যবস্থারও নেতিবাচক অবস্থা থেকে ইতিবাচকতায় আসার আবশ্যকতা রয়েছে। যে অর্থনীতি থেকে কর আসবে, রাজস্ব আহরিত হবে সে অর্থনীতিকে গতিশীল, সুস্থ সবল, সচল থাকতেই হয়। সে অর্থনীতিতে সম্পদের সুষ্ঠু বিতরণ ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকতে হবে। সে অর্থনীতি ও সমাজে দুর্নীতিজাত অর্থ বা সম্পদ অর্জনে শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, কঠোর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকতে হবে। যে সমাজ ও অর্থনীতিতে দুর্নীতি, দুর্নীতিই দুর্নীতিকে উসকে দেয়, উৎসাহিত করে, প্রশ্রয় দেয়, পৃষ্ঠপোষকতা করে সেখানে কর সংস্কৃতি বিকাশলাভ তো করেই না বরং মানুষকে করবিমুখ করে। সবাই কর দিচ্ছে কি না তা দেখভাল কিংবা সবাইকে করজালের মধ্যে আনার কাজ কর বিভাগের একার হতে পারে না, এ দায়িত্ব সবাইকে স্ব স্ব অবস্থান থেকে পালন ও প্রয়োগের প্রয়োজন। করদাতা রাষ্ট্রকে কর দেবে বিনিময়ে রাষ্ট্র করদাতা বা সব নাগরিককে সেবা দেবে।

যদি দেখা যায় করের টাকা লোপাট হচ্ছে, কতিপয়ের আত্মসাৎ তছরুপে ব্যবহার হচ্ছে এমনকি করদাতাকেই দমন বা বঞ্চিতকরণের কাজে ব্যবহার হচ্ছে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বাসস্থান, যোগাযোগ খাতে রাষ্ট্রীয় সেবা মিলছে না, তাহলে মানুষ কর দেওয়ার আগ্রহ, তাগিদ, তাৎপর্য ও যৌক্তিকতা হারিয়ে ফেলতে পারে। মানুষকে করমুখীকরণের পথে আরেকটি মনস্তাত্ত্বিক বাধা হলো বৈষম্য। যিনি নিয়মিত কর দেন তার ওপর করের চাপ বাড়ানোর ব্যাপারে তাকে আয়ের উৎসসহ কত কিছু জানার জন্য জিজ্ঞাসাবাদের অন্ত নেই, পক্ষান্তরে যিনি কর দেন না তার বেলায় নানান ছাড়, হ্রাসকৃত করহার ও জরিমানা এবং আয়ের উৎস নিয়ে বিনা প্রশ্নের অ্যামনেস্টি দিতে তৎপর পরিবেশে সুস্থ ও কার্যকর কর ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠা কঠিন। এখানেও মনোভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন নীতিনির্ধারকের। রাজস্ব বিভাগ কর সংগ্রাহক, কর ফাঁকিবাজকে ধাওয়া করার দায়িত্ব ব্যাংক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য সংস্থা বা দফতরের। সমন্বিত সহযোগিতা বা প্রয়াস ছাড়া করজালের মধ্যে সবাইকে আনা সম্ভব নয়। অন্যের সমালোচনায় মুখর না হয়ে আত্মসমালোচেনায় বসলে করদাতা খুঁজে পেতে কষ্ট হয় না। যারা কর বিভাগের কাছে হয়রানিমুক্ত আচরণ প্রত্যাশা করেন তারা নিজেদের দায়িত্বশীল পেলে কর বিভাগের হয়রানি, পরস্পরের দোষারোপের অবকাশ সীমিত হয়ে আসবে। ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’ এ দৃষ্টিভঙ্গিতে তারতম্য ঘটলে কর ন্যায্যতার পরিবেশ বিকাশ লাভ করবে না।

সমাজে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা আনয়নে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থায় দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে অধিষ্ঠিত ভূমি ও কর রাজস্ব আহরণকারী দফতরের কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্ব পালনে অর্পিত ক্ষমতা প্রয়োগে প্রতিশ্রুত (commitment) ও দৃঢ়চিত্ততার প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গটিও সঙ্গে সঙ্গে এসে যায়। নিজেদের অধিক্ষেত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে স্বার্থবাদিতায় জারিত হয়ে যদি তাদের কর্মধারা পরিচালিত হয় সে ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠানই কার্যকরভাবে জবাবদিহিমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে না।

এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচার ও স্বচ্ছতার অভাবে আকীর্ণ হয়ে উঠতে পারে, স্বেচ্ছাচারিতার অজুহাত যৌক্তিকতায় হয়রানির পরিবেশ বা ক্ষেত্র তৈরি হয়। পাবলিক সার্ভিসে প্রত্যেক কর্মকর্তার নিজ নিজ দায়িত্ব যথাযথ পরিপালনের মাধ্যমে একটা স্বচ্ছ ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির সুযোগ থাকার দরকার। যারা নীতি প্রণয়ন করেন, নীতি উপস্থাপন করেন তাদের সবারই নিজস্ব দৃঢ়চিত্ততা ও নীতি-নিয়ম পদ্ধতির প্রতি দায়িত্বশীল থাকা আবশ্যক। সুশাসন, স্বচ্ছতা-জবাবদিহির প্রয়োজন সবার স্বার্থে, রাজস্ব সংগ্রহের স্বার্থে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে। কারণ এটা পরস্পরের পরিপূরক। আরেকটি বিষয়- নীতিনির্ধারকরা বাস্তবায়নকারীদের দিয়ে তাদের ভুল বা ব্যত্যয়ধর্মী নীতি বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করিয়ে নিতে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি কিংবা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির ক্ষেত্রে তাদের নানান সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিয়ে প্রলুব্ধ করতে পারেন কিংবা ক্ষেত্রবিশেষ ষড়যন্ত্রের টোপে ফেলে বিব্রত করতে পারেন। উন্নয়নশীল থেকে মধ্যম আয়ের দেশের পথে আছে এমন দেশ বা অর্থনীতিতে রাজস্ব বা কর সংস্কৃতির সংস্কার অপরিহার্য।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান।

সর্বশেষ খবর