সোমবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আমার বাবা

বনানী রায় চৌধুরী

ভাষাসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আমার বাবা

ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। ডিসেম্বর এলেই বিজয়ের আনন্দের পাশাপাশি আমার মনটাও ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। আগামী ১৫ ডিসেম্বর আমার বাবা বিমল রায় চৌধুরীর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি ছিলেন ভাষাসৈনিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজসেবক। ২০১৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর ৯৩ বছর বয়সে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি যশোর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সিনিয়র সদস্য ছিলেন। এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক শোকবার্তায় বলেন, ‘কীর্তিমান এ রাজনীতিবিদ আজীবন নিরলসভাবে মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে।’ এই বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে একজন বিশিষ্ট সমাজসেবক হিসেবে তিনি বেশি পরিচিত ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে যশোরের ২২টি রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে আলাদাভাবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হয়। যশোরের এই বিশিষ্ট নাগরিকের মৃত্যুতে যশোর টাউন হল মাঠে নাগরিক শোকসভার আয়োজন করা হয়। শোকসভায় তাঁর নামে যশোরের একটি সড়কের নামকরণ করার প্রস্তাব করেন বক্তারা। আমার বাবার মৃত্যুর পর যশোরবাসী তাঁর প্রতি যে সম্মান, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেখিয়েছেন সে জন্য যশোরবাসীর কাছে আমরা চিরঋণী। আমার বাবা আওয়ামী লীগের জাতীয় পর্যায়ের কোনো বড় নেতা ছিলেন না। তারপরও আমার বাবার মৃত্যুতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শোক প্রকাশ করায় আমাদের পরিবার তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

রাজনৈতিক কারণে আমার বাবাকে বারবার কারাবরণ করতে হয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। এক মাস পর তিনি মুক্তি পান। ১৯৫৪ সালে আবার তাঁকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়। প্রায় দেড় বছর কারাভোগের পর তিনি মুক্তি পান। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পুনরায় তিনি গ্রেফতার হন। কিছুদিন পর তিনি মুক্তিলাভ করেন। আমার বাবা ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর একদিন গোপন সূত্রে খবর আসে দখলদার পাকিস্তানি সেনারা যশোর শহরতলীর বিরামপুরে অবস্থিত আমাদের বাড়িটি আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ খবর পাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বাবা লুঙ্গি পরে কোমরে গামছা বেঁধে অস্ত্র হাতে দ্রুত বাড়ি ছেড়ে চলে যান। আমাদেরও কোনো নিরাপদ স্থানে চলে যেতে বলেন। আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। আমরা যাযাবরের মতো এখানে ওখানে আশ্রয় নিয়ে অবশেষে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে শরণার্থী হই। পাঁচিলঘেরা অট্টালিকাসম আমাদের দোতলা বাড়িটি হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যরা পরবর্তীতে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। আমরা ভারতে বসে এ খবর পাই। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আমার বাবা পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁও সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। মুক্তিযোদ্ধা শিবিরে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হওয়ার পর ৭ ডিসেম্বর তিনি প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। ১৯৭৫ সালের আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনার পর বাবাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। আমাদের সামনেই চোখ বেঁধে তাকে গাড়িতে তোলা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, ভারতে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগ নেতাদের গোপনে সাহায্য করা। যশোর কারাগারে থাকাকালীন বাবা তাঁর মা অর্থাৎ আমার ঠাকুরমা’র মৃত্যু সংবাদ পান।

আমার বাবা বিমল রায় চৌধুরী টানা ২২ বছর যশোর সদরের নওয়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি যশোর রোটারি ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। যশোর চেম্বার অব কমার্সের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পাবনার হেমায়েতপুরে অবস্থিত ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র সৎসংঘের সভাপতি ছিলেন তিনি। আমার বাবার কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ ছিল না। তাঁকে কখনো ক্ষমতা বা অর্থের পিছনে ছুটতে দেখিনি। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন। সমাজের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। সমাজসেবা ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। এর বিনিময়ে তিনি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা পেয়েছেন। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি একজন মানুষের জীবনে আর কী হতে পারে! সবার উপরে মানবতা-বাবার কাছ থেকে এই শিক্ষা আমরা পেয়েছি।

আমার মাকে আমরা অকালে হারিয়েছি। বাবা ছিলেন আমাদের বন্ধুসম। মায়ের অভাব পূরণ করতে সর্বদা ছিলেন সচেষ্ট। বিরামপুরে আমাদের সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িতে আমার প্রয়াত মায়ের নামে ‘শীলা রায় চৌধুরী মাধ্যমিক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন আমার বাবা ১৯৯৪ সালে। বিদ্যালয়টি এখন এমপিওভুক্ত। এ বিদ্যালয়ে বর্তমানে তিন শতাধিক ছাত্রছাত্রী অধ্যয়ন করছে। জমিদার পরিবারের সন্তান হয়েও আমার বাবা পরিবারের জন্য তেমন কিছু রেখে যাননি। এ নিয়ে আমাদের কোনো দুঃখ নেই। একজন সমাজসেবক ও জনদরদি ব্যক্তির কন্যা হতে পেরে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি।

আজকের সমাজে আমরা বড্ড বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি। পরোপকারী মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। আমার বাবা ছিলেন প্রচারবিমুখ। আত্মপ্রচারের বাসনা থেকে নয়, আমার বাবার জীবন-কর্ম পড়ে নতুন প্রজন্মের একজনও যদি সমাজসেবার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন তবেই আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস সার্থক হবে বলে মনে করি।

লেখক : প্রয়াত বিমল রায় চৌধুরীর কন্যা।

সর্বশেষ খবর