শনিবার, ৮ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

কমিউনিটি প্যারামেডিকস

ডা. আবু মোহাম্মদ জাকির হোসেন

প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ধারণাটি ১৯৭৮ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আলমাআতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে স্বীকৃতি লাভ করে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ওপর আয়োজিত ওই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যগত মান অর্জনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। দেশে দেশে এর ভিন্নতা দেখা গেলেও সাধারণত সব দেশের মৌলিক স্বাস্থ্যশিক্ষা, পুষ্টির মানোন্নয়ন, নিরাপদ পানীয় জল সরবরাহ, মৌলিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা, শিশু ও মাতৃ স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা, প্রতিষেধক টিকাদান, সীমিত নিরাময়মূলক যত্ন, সংক্রামক ব্যাধি ও মহামারি প্রতিরোধ বিশ্বব্যাপী সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। আলমাআতা  ঘোষণা বাস্তবায়নে তৃণমূল পর্যায়ে দক্ষ স্বাস্থ্যসেবা দানকারীর প্রাপ্যতা ও অবস্থান অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখছি তৃণমূল মানুষের জন্য সরকারি হাসপাতাল অনেক দূরে হওয়ায় এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের অপ্রতুলতার কারণে তারা যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। ফলে তাদের রোগব্যাধির চিকিৎসার জন্য অদক্ষ সেবা প্রদানকারী, হাতুড়ে ডাক্তার, ওঝা, ফকির, কবিরাজের কাছ থেকে সেবা নিতে হয় অথবা তারা স্থানীয় ওষুধের দোকান থেকেও রোগের কথা বলে প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ কিনে খায়। মূলত এসব ওষুধের দোকানের বিক্রেতাদের রোগের বর্ণনা শুনে ওষুধ দেওয়ার কোনো যোগ্যতা বা সক্ষমতাই নেই এমনকি কোনো বৈধ সনদও নেই। এসব চিকিৎসা নিতে তাদের যেমন হয়রানির শিকার হতে হয়, তেমনই ভিত্তিহীন অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসার ফলে প্রায়ই রোগীর জীবনও বিপন্ন হয়ে ওঠে। তৃণমূল পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও যোগ্য কিংবা দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর অপ্রতুলতাও এর একটা কারণ। বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ৮.৩ জন স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োজিত রয়েছেন যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে সহস্রাব্দ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৩ (এসডিজি-৩)-এর ১২টি স্বাস্থ্যসূচক অর্জনের জন্য প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ৪৪.৫ জন স্বাস্থ্যকর্মী থাকা প্রয়োজন। এ পরিস্থিতি গ্রামীণ অঞ্চলে আরও উদ্বেগজনক, যেখানে বাসিন্দাদের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও যোগ্য স্বাস্থ্যকর্মীর অপ্রতুলতা আরও প্রকট। এজন্য গ্রামবাসীকে অদক্ষ সেবাদানকারীদের ওপর নির্ভর করে থাকতে হয়।

সরকার তার চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি খাত উন্নয়ন কর্মসূচিতে (২০১৭-২০২৩) মানবসম্পদে অপ্রতুলতা হ্রাস করার ওপর জোর দিয়েছে। তবে আগামী ২০-২৫ বছরে সেই ঘাটতি পূরণ হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন না। গত এক দশকে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। গড় আয়ু বৃদ্ধি, মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসের মতো বড় অর্জনও বাংলাদেশের রয়েছে। শিশুমৃত্যু হার রোধে সফলতার জন্য জাতিসংঘ বাংলাদেশকে পুরস্কারে ভূষিত করেছে। কিন্তু এ সাফল্যের মধ্যেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে। বিএমএমএস ২০১৬ অনুযায়ী এখনো ৫৩% প্রসব বাড়িতে হচ্ছে। বাংলাদেশে যত শিশু জন্মগ্রহণ করে তার ৩৩ শতাংশ এখনো অদক্ষ দাইয়ের হাতে। এর মূল কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যথেষ্ট পরিমাণে দক্ষ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর এখনো অভাব। গ্রামাঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ১৯৯৭-৯৮ সালে প্রণীত সেক্টরওয়াইড কৌশল ও কর্মসূচি এবং ২০০৯ সালে প্রণীত কমিউনিটি প্যারামেডিক নীতিমালা এর অন্যতম। কমিউনিটি প্যারামেডিক নীতিমালায় বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীরা এসএসসি পাস করার পর দুই বছর মেয়াদি কমিউনিটি প্যারামেডিক কোর্সে অংশগ্রহণ করতে এবং দুই বছরের পূর্ণাঙ্গ এ কোর্স সম্পন্ন করার পর তারা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারবেন।

স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিল (বানাএমিকা) এ কোর্সের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে রয়েছে। বানাএমিকা ২০১১ সাল থেকে এ কোর্স পরিচালনা করছে। শুরু থেকে অদ্যাবধি বাংলাদেশে প্রায় ৫ হাজার কমিউনিটি প্যারামেডিক কাজ করছেন। তারা তৃণমূল পর্যায়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ প্রদান করে যেমন গর্ভবতী ও প্রসূতি মাকে নিয়মমাফিক চেকআপ, হাসপাতালে বা দক্ষ সেবাদানকারী দ্বারা প্রসব করানো, জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানো, জন্মের তিন দিনের মধ্যে কোনোভাবেই শিশুকে গোসল না করানো, কিশোরীদের মাসিকের কারণে শরীরে আয়রনের চাহিদা বেড়ে যায় ফলে পর্যাপ্ত আয়রনসমৃদ্ধ খাবার না খেলে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয় এসব তথ্য জানানো এবং জন্মের ছয় সপ্তাহের মধ্যে শিশুকে ১০টি রোগের বিরুদ্ধে টিকা নেওয়ার জন্য টিকা কেন্দ্রে রেফার করেন।

প্রথম সন্তান জন্মের দুই বছর পর দ্বিতীয় সন্তান নেওয়া, সর্দি জ্বর ঠান্ডা কাশিতে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না নিলে নিউমোনিয়া হয়ে মৃত্যুও হতে পারে। কমিউনিটি প্যারামেডিকরা পানিতে ডোবা, সাপে কাটা, জখম হয়ে যাওয়া রোগীকে দক্ষতার সঙ্গে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের পাশাপাশি তারা অসংক্রামক রোগ (এনসিডি) থেকে সুস্থ থাকার জন্য গ্রামবাসীকে হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ হলে নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করে, নিয়মিত ওষুধ খাওয়া, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ না করা, উচ্চ রক্তচাপে খাবারে লবণ পরিহার করা, রান্নায় পরিমাণমতো লবণ দেওয়া, ডায়াবেটিসে নিয়মিত রক্তে চিনির পরিমাণ মাপা, নিয়মমাফিক ওষুধ সেবন করা, শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানো ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শ ও সেবা দিয়ে থাকেন। উল্লেখ্য, এই কমিউনিটি প্যারামেডিকরা রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষণের পর তাদের সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার পরামর্শ প্রদান বা রেফার করে থাকেন বা কোনোরকমের জটিলতা দেখা দিলে নিকটস্থ উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগাযোগের জন্য পরামর্শ দেন। যা তৃণমূল পর্যায়ে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। কমিউনিটি প্যারামেডিকরা গর্ভবতী মায়েদের রক্তচাপ পরিমাপ, তাদের রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ নির্ণয়ের মতো পরীক্ষাগুলো করে থাকেন। গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টি এবং পরিচ্ছন্নতা ও শিশুর যত্ন সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান করে থাকেন।

 

লেখক : সাবেক পরিচালক, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্চা ও রোগ নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, স্বাস্থ্য অধিদফতর।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর