রবিবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

স্বপ্নের নাম কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

প্রফেসর ড. মো. ফরহাদ হোসেন

স্বপ্নের নাম কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি স্বপ্নের নাম কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

স্বপ্নটা  কুড়িগ্রামের অগণিত মানুষ তথা সমগ্র দেশবাসীরও। কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এ অঞ্চল তথা বিদেশে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে কাজ করবে। কৃষি বাংলাদেশের মানুষের প্রাণ। কৃষির উন্নয়নের সঙ্গে এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন জড়িত। বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান প্রায় ১৩.০২ শতাংশ। সামগ্রিক অর্থে কৃষির উন্নয়নের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এ দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা নামিদামি সব বিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণ কর্মীরা। বিভিন্ন ধরনের কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে আজ শীর্ষ কাতারে। কৃষির বিভিন্ন গবেষণা এবং সম্প্রসারণ প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত ব্যক্তির নিরলস পরিশ্রমের ফলে এ অভূতপূর্ব জাগরণ সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদে কৃষির বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করা হয়। কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েও ওই বিষয়গুলোরই সন্নিবেশ জরুরি। তবে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিছু নতুন বিষয় কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে থাকতে পারে। বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী কৃষকরত্ন শেখ হাসিনার পরপর কয়েকবারের শাসনামলে তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবু বাংলাদেশে কৃষির গড় উৎপাদন অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় কম। নতুন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধির এ চ্যালেঞ্জ নিতে পারবে। পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক ফসলের ফলন বৃদ্ধিতেও অবদান রাখার সুযোগ আছে। কুড়িগ্রাম জেলা চরবেষ্টিত এক দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। চরাঞ্চলের কৃষি, মাছ ও পশু পালন বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কৃষি অনুষদের পাঠ্যক্রম সাজানো যেতে পারে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কুড়িগ্রাম জেলার প্রতি বিশেষ নজর আছে বলেই এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সুতরাং এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও ছাত্রছাত্রীর বিষয়টি সব সময় মনে রেখে গবেষণার মাধ্যমে এ দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে হবে। শস্য উৎপাদনে দক্ষ কৃষক গড়তে হলে প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। একজন কৃষক যত প্রশিক্ষণ পাবে তত দক্ষ হবে এবং একজন দক্ষ কৃষক শস্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারবে। কুড়িগ্রাম জেলায় ৪২০টির মতো চর আছে। প্রতি বছর বন্যার শুরু এবং শেষে বেশির ভাগ চরের মানুষের ঘরবাড়ি ভেঙে যায় এবং তারা অন্য চরে বসতি গড়ে। কয়েক বছর পর আবার তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে অন্য চরে বসতি করতে হয়। বেঁচে থাকার তাড়নায় তাদের অল্প সময়ে চরের অনুর্বর মাটিতে ফসল ফলাতে হয়। চরাঞ্চলের কৃষকরা উন্নত প্রশিক্ষণ, লাগসই প্রযুক্তি ও কিছু অর্থনৈতিক সহযোগিতা পেলে অল্প সময়েই অধিক ফসল উৎপাদন করতে পারবে। কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নামে একটি আধুনিক কৃষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করা যেতে পারে যা এ অঞ্চলের কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে অবদান রাখতে পারবে। গবাদি পশু-পাখি পালন কৃষকদের আদিকালের অভ্যাস। খুব ধনী ও অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠী বাদে প্রায় সব কৃষকের ঘরে গবাদি পশু আছে। যথাযথ লালনপালন জ্ঞানের অভাবে ওইসব গবাদি পশু পালনে কৃষক তেমন লাভের মুখ দেখে না। কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অ্যানিমল সায়েন্স অ্যান্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদে গবাদি পশু-পাখির জাত উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ থাকবেন যারা উন্নত জাত তৈরি ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিতে পারবে। পাশাপাশি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রাণী সেবাকেন্দ্র থাকবে যেখানে পশু, পাখি ও প্রাণীর চিকিৎসা নিশ্চিত করা হবে। এ অনুষদের অধীন প্রাণিসমূহের জাত উন্নয়ন করা হবে যেখান থেকে একটি নির্দিষ্ট বয়সের প্রাণী স্বল্পমূল্যে কৃষক কিনে ছোট ছোট খামারে লালনপালন করতে পারবে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলা ১৬টি নদীর বেষ্টনীতে আবদ্ধ। আগে এসব নদী স্বাদু পানির বিভিন্ন ধরনের মাছে ভরপুর ছিল। বর্তমানে এসব নদী বলতে গেলে মাছশূন্য। এর মূল কারণ নির্বিচারে মাছ নিধন। কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মৎস্য অনুষদ নামে বিশেষায়িত একটি অনুষদ থাকবে যে অনুষদের বিজ্ঞানীরা স্বাদু পানির মৎস্য সম্পদ বৈজ্ঞানিক উপায়ে বৃদ্ধির কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারবে। স্বাদু পানির মাছ শিকারিদের সঙ্গে সমঝোতা করে বছরের নির্দিষ্ট সময় মাছ আহরণ বন্ধ করতে পারলে এবং স্বাদু পানির মৎস সম্পদ নিয়ে মৎস্য বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে উন্নত জাত উদ্ভাবন করার কার্যকর উদ্যোগ নিলে ওইসব নদীতে মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধি পাবে।

জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি ও কৃষক যার প্রভাব পড়ে দেশের খাদ্য নিরাপত্তায়। কপ-২৬ সম্মেলনে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫০ সে. এর মধ্যে সীমিত রাখার কথা বলা হয়েছে। তবু তাপমাত্রা বৃদ্ধির এ ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আমাদের যেন রেহাই নেই। অনুন্নত দেশ ও অনুন্নত দেশের দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলগুলোর জন্য বিশেষায়িত কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে যার ফলে ওই অঞ্চলের মানুষ কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত কোনো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েই এ ধরনের বা এ নামে কোনো অনুষদ নেই। কুড়িগ্রামসহ উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কিছু জেলা দুর্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ। কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের একটি অনুষদ থাকলে যে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবে তারা দুর্যোগ মোকাবিলার সহায়ক অনুষঙ্গ নিয়ে কাজ করবে। দুর্যোগ মোকাবিলায় মানুষকে সচেতন করবে এবং আগাম সতর্কতা বা দুর্যোগ-পরবর্তী মোটিভেশন বিষয়ে কৃষক বা ঝুঁকিপূর্ণ মানুষগুলোকে ঝুঁকি মোকাবিলায় পরামর্শ দিতে পারবে। একদল দক্ষ গবেষক এবং শিক্ষক দিয়ে এ অনুষদের পাঠ্যক্রম সাজানো যেতে পারে যেখানে পাঁচ থেকে ছয়টি বিভাগ থাকবে। সর্বোপরি বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে এ নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কাজ করবেন। বাংলাদেশের কোনো শহরেই আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। প্রতিদিন ওইসব শহরের বিভিন্ন জায়গায় দোকানপাটের, গৃহস্থালির, হাটবাজারের প্রচুর বর্জ্য তৈরি হয়, যা এলাকায় যেমন স্থান দখল করে, অন্যদিকে এসব আবর্জনা কোনো স্থানে ডাম্পিং করার ফলে বিশাল এলাকার পরিবেশ দূষিত হয়। কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম থেকেই একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র থাকবে এবং বৈজ্ঞানিক উপায়ে ওইসব বর্জ্য থেকে জৈবসার এবং গ্যাস তৈরি করা হবে।  কুড়িগ্রাম বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া জনপদগুলোর অন্যতম। দারিদ্র্যের হার বেশি। কৃষি ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়নের আর কোনো চালিকাশক্তি নেই। এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের মাইলফলক হতে পারে কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। এজন্য প্রথম থেকেই সঠিক পরিকল্পনায় কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তুলতে হবে।

লেখক : পরিচালক (ছাত্র পরামর্শ ও নির্দেশনা), শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

 [email protected]

সর্বশেষ খবর