মঙ্গলবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

বিএনপি যেন প্রাইভেট কোম্পানি

মহিউদ্দিন খান মোহন

বিএনপি যেন প্রাইভেট কোম্পানি

সাবেক বিএনপি নেতা তৈমূর আলম খন্দকারের সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। নারায়ণগঞ্জের একসময়ের আওয়ামী লীগ নেতা তৈমূর আলম বিএনপিতে যোগ দেন সম্ভবত ১৯৯৬ ফক ’৯৭ সালে। আমার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ১৯৯৮ সালে। আমি তখন দৈনিক দিনকালের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করি। মাঝেমধ্যেই তিনি আসতেন। কখনো সভা-মিছিলের খবর বা ছবি নিয়ে, কখনো বা নিবন্ধ নিয়ে। সে সময় তাঁকে নারায়ণগঞ্জে বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকান্ডে ব্যাপক আবদান রাখতে দেখেছি। আইনজীবী তৈমূর আলম খন্দকার ছিলেন বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার জুনিয়র। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সবখানেই রাজপথে ছিল তাঁর সরব বিচরণ। দিনকাল কার্যালয়ে আসা-যাওয়ার সূত্রেই তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। সে ঘনিষ্ঠতা আরও বৃদ্ধি পায় ২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের পর, তিনি যখন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। আমি তখন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সচিব। আমাদের ঢাকা-মাওয়া রুটে বিআরটিসি বাস সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নিই আমি। হুদা ভাইকে বলার পর তিনি তাঁর জুনিয়র এবং বিআরটিসি চেয়ারম্যান তৈমূর আলম খন্দকারকে নির্দেশ দিলেন বাস সার্ভিস চালু করার। তৈমূর ভাই ওই বাস সার্ভিস চালুর ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন। সেই থেকে তাঁর সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গ সম্পর্ক। এ সম্পর্ক এখনো রয়েছে। আমি বিএনপি থেকে পদত্যাগের পর দেখা হতো বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টকশোয়। সম্ভবত ২০১৬ সালে একটি টিভি চ্যানেলের টকশোয় আমি বিএনপির সাংগঠনিক অব্যবস্থা ও দলের ভিতরে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট সম্পর্কে কঠোর ভাষায় কথা বলায় তিনি আমার ওপর খেপে গেলেন। সদালাপী তৈমূর আলম খন্দকারের এই রূপ দেখে একটু হতবাকই হলাম। শো শেষে তিনি আমাকে বললেন, ‘মোহন ভাই, আপনি যা বলেছেন তা শত ভাগ সঠিক’। তাহলে অমন খেপলেন ক্যান, জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, ‘টিভি পর্দায় ওইটুকু না করলে যে দলে আমার চাকরি থাকবে না’। আমি তাঁকে বললাম, চাকরি বোধ হয় আপনার এমনিতেই থাকছে না। বিস্মিত তৈমূর আলম জিজ্ঞেস করলেন, মানে? বললাম, আপনার জেলা কমিটি মাসখানেকের মধ্যে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। আপনার পরিবর্তে একজন টাকাওয়ালা জেলার দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন। একটু খোঁজখবর রাখেন। তৈমূর আলম খন্দকার চিন্তিত মনে বললেন, ধন্যবাদ মোহন ভাই। দেখি কী হয়। এর কিছুদিন পরই নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির কমিটি ভেঙে কাজী মনিরুজ্জামান মনিরকে জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেবার তৈমূর আলমের অপরাধ ছিল দল থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাঁকে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বলেছিল। কিন্তু ২০১১ সালের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে তিনি রাজি হননি। এতে দলের সুপ্রিম কমান্ড ক্ষুব্ধ হন বিএনপির এই রাজপথের নেতার ওপর। সেবার বিএনপি নাসিক নির্বাচনে মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়েছিল অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খানকে।

এবার তৈমূর আলম খন্দকার দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নাসিক নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এজন্য দল প্রথমে তাঁকে নারায়ণগঞ্জ মহানগর কমিটির আহ্বায়কের পদ থেকে প্রত্যাহার করে এবং নির্বাচনের মাঝামাঝি এসে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদ থেকেও প্রত্যাহার করে নেয়। আমার এ নাতিদীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় কোনো রাজনৈতিক দলের এমন অভিনব সিদ্ধান্ত এর আগে দেখিনি। সাধারণত কোনো সদস্য তার দলের সিদ্ধান্ত অমান্য বা শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করলে তাকে প্রথমে ‘কারণ দর্শাও’ নোটিস দেওয়া হয়, তারপর সাময়িক বরখাস্ত বা বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু ‘পদ থেকে প্রত্যাহার’ করার নজির আগে কখনো সৃষ্টি হয়নি। বিষয়টি আমার বোধগম্য না হওয়ায় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এক সুহৃদের শরণাপন্ন হলাম। তিনি বললেন, এর একটা মারফতি মাজেজা আছে। তৈমূরকে প্রত্যাহার কারা হয়েছিল ওই দুটি পদ থেকে। বিএনপি সুপ্রিম কমান্ড ভেবে রেখেছিলেন তৈমূর আলম যদি জিতে যান তাহলে ওই চিঠি আবার তাঁরা প্রত্যাহার করে তাঁকে সপদে বহাল করে দেবেন। কিন্তু বিধিবাম! ফল হয়েছে উল্টো। তাই এখন তৈমূর পেলেন স্থায়ী বহিষ্কারের চিঠি। বিস্ময়ে অভিভূত আমি সোৎসাহে বলে উঠলাম, বাঃ কী চমৎকার আইডিয়া! এত বুদ্ধি নিয়ে বিএনপি নেতারা রাতে ঘুমান কী করে? ভদ্রলোক বললেন, ওই চিন্তা আপনার না করলেও চলবে। তাঁদের ঘুমের সমস্যা হয় না। তাঁরা তো আছেন আকাশের পানে চেয়ে। কখন সেখান থেকে ক্ষমতার বেহেশতি মেওয়া ঝরে পড়বে, আর তাঁরা খপ করে ধরে কোচরে গুঁজবেন। তাই কাকে বাদ দিলে দলের ক্ষতি তা নিয়ে তাঁদের আপার চেম্বারে কোনো টেনশন নেই। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছিলাম তৈমূর আলম খন্দকারের সঙ্গেও। ফোনকল ধরার পর পরিচয় দিতেই বললেন, কী ভাই, শেষ পর্যন্ত মনে পড়ল আমাকে? বললাম, তৈমূর ভাই, আপনি নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় খারাপ লেগেছে এটা ঠিক। তবে অবাক হইনি। এমনটা ঘটতেই পারে। কিন্তু আজ অবাক হলাম পত্রিকায় আপনার আর এ টি এম কামালের বহিষ্কারের খবর পড়ে। কারণটা একটু বলবেন কী? একটি ছোট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, এর কারণ আমার জানা নেই। তবে যেহেতু আপনি এই দলটির জন্মলগ্ন থেকে ছিলেন, তাই এর ভিতর-বাইরের অনেক কাহিনি আপনি বোঝেন। আমার নিজের জন্য দুঃখ নেই। তবে ওরা নারায়ণগঞ্জে আরেকজন এ টি এম কামাল বানাক তো দেখি। এভাবেই দলটাকে ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। আমি সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তাঁকে বললাম, ধৈর্য ধরেন ভাই। আবার হয়তো আপনাকে ডেকে নেবে। এভাবে বহিষ্কার-আবিষ্কার হতে হতেই হয়তো আরও বড় নেতা হয়ে যাবেন। ভুলে যাননি নিশ্চয়ই ২০০০ সালে বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীকে বহিষ্কারের পর তিনি এই বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন, বিএনপিতে কয়েকবার বহিষ্কার আর আবিষ্কার না হলে নেতা হওয়া যায় না। কথা শুনে তৈমূর আলম একটু হাসলেন। বললেন, দেখা যাক। বহিষ্কারের খবর জানার পর সংবাদমাধ্যমের কাছে তৈমূর আলম খন্দকার এই বলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তিনি দলের একজন কর্মী হিসেবে থাকবেন। নেতার পদ থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু কর্মীর পদ থেকে তো বহিষ্কার করা হয়নি। মুখে যা-ই বলুন তৈমূর এটা যে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের জন্য একটি বড় ধরনের ধাক্কা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নারায়ণগঞ্জের পরিচিতজনদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তৈমূর আলম খন্দকার ও এ টি এম কামালের এ বহিষ্কার স্থানীয় বিএনপির জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। নেতৃত্বের শূন্যতা তো আছেই, তাঁদের অনুসারী নেতা-কর্মীরা হয়ে পড়বেন হতোদ্যম। বিএনপির একজন ক্ষুব্ধ কর্মী বললেন, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করায় তৈমূর আলম খন্দকারকে বহিষ্কার করা হলো। কিন্তু সারা দেশে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে যে প্রায় ৬০০ বিএনপি নেতা নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের ব্যাপারে দল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না কেন? দল তো ইউপি নির্বাচনও বর্জন করেছিল। তাঁরাও তো দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করেছেন। তাহলে তাঁদের বহিষ্কার করা হচ্ছে না কেন? এটা তো এক যাত্রায় দুই ফল হলো! এদিকে ২১ জানুয়ারি একটি দৈনিকে ‘বহিষ্কার-অব্যাহতি নিয়ে বিএনপিতে অস্থিরতা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেতা-কর্মীদের বহিষ্কার আর পদ থেকে অব্যাহতি নিয়ে ও স্বেচ্ছায় পদত্যাগের ঘটনায় বিএনপিতে টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দলটি যেন নিজের আগুনেই পুড়ছে। পত্রিকাটি লিখেছে, এ নিয়ে দলটির নীতিনির্ধারকদের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে অসন্তোষ। তবে কেউ এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলছেন না। তাঁরা মনে করছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তাঁদের একটা সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের এসব সিদ্ধান্ত দলটির তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে দলটির আগামী দিনের রাজপথের আন্দোলনে। তাঁরা এও বলছেন, দলের একটি অংশের দুরভিসন্ধি থেকেই এসব ঘটছে। ওই চক্রটি শীর্ষ নেতৃত্বকে ভুল বুঝিয়ে এসব সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করছে। আর সদ্য বহিষ্কৃত তৈমূর আলম খন্দকার পত্রিকাটিকে বলেছেন, ‘আমরা এখন দলের কর্মী না কর্মচারী এটাই বুঝতে পারছি না। কেন্দ্র থকে কেউ আমাকে একটা ফোন পর্যন্ত করেননি।’

মারাত্মক প্রশ্ন তুলেছেন তৈমূর আলম খন্দকার। বিএনপিকে এখন আর একটি রাজনৈতিক দল বলা যায় কি না তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। যেভাবে যখন যাকে খুশি দল থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে বা পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছ বিএনপি এখন একটি ‘প্রাইভেট কোম্পানি’তে পরিণত হয়েছে; যেটি তার মালিকের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় চলে। প্রাইভেট কোম্পানিতে যেমন চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই, মালিকপক্ষ কোনোরকম কারণ দর্শানো ছাড়াই যে কাউকে ছাড়িয়ে দিতে পারেন, বিএনপিতে এখন চলছে সে অবস্থা। মালিকের ইচ্ছাই চূড়ান্ত। কারও কিছু বলার বা করার নেই। বিএনপি নেতৃত্ব অবশ্য তাঁদের এসব পদক্ষেপকে দলের শৃঙ্খলা রক্ষা এবং দলকে ঢেলে সাজানোর অংশ বলেই প্রচার করছেন। তবে রাজনীতি অভিজ্ঞ মহল বলছে ভিন্ন কথা। তাদের মতে বিএনপি দলকে সাজানোর জন্য ঢাললেও, ঠিকমতো সাজাতে পারছে না। বরং ঢেলে দেওয়ার পর আরও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এ যেন সেই ‘ধোয়ার চেয়ে অধোয়া ভালো, ধুইতে ধুইতে সবই গেল’ প্রবাদের বাস্তব রূপ। তারা বলছেন বিএনপি নেতৃত্বের এখনো বোধোদয় হওয়া উচিত। নচেৎ দলটি আরও কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে। কিন্তু শত কোটি টাকা দামের প্রশ্ন হলো, দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের সে বোধোদয় আদৌ হবে কি?

                লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর