মঙ্গলবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত ভিকটিমদের পুনর্বাসন আইন

অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত ভিকটিমদের পুনর্বাসন আইন

আমরা সবাই জানি অপরাধের শিকার ব্যক্তি দুই ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। একটি শারীরিক অন্যটি আর্থিক। শারীরিক ক্ষতির কারণে একজন ব্যক্তি সারা জীবনের জন্য অকর্মণ্য হয়ে যেতে পারেন; আর আর্থিক ক্ষতির কারণে হয়ে যেতে পারেন নিঃস্ব। অপরাধীকে আদালত বিচার প্রক্রিয়ার শেষে জেল ও সামান্য জরিমানা করে। এতে অপরাধের শিকার ব্যক্তির কী যায় আসে। যদিও আমাদের দন্ডবিধির ৭০ ধারা আদালতকে জরিমানা আদায়ের ক্ষমতা দিয়েছে এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৮৬ ধারায় সেই জরিমানা আদায়ের দিকনির্দেশনা দিয়েছে। যদিও এ ধারার শর্তাংশে জরিমানা অনাদায়ে আরও এত দিন কারাদন্ড দেওয়া হলো এবং কারাদন্ড ভোগ করলে আদালত সেই জরিমানা আদায়ের পদক্ষেপ নেবে না। কিন্তু জরিমানা অনাদায়ে অতিরিক্ত কারাদন্ড এটা আইনে বাধ্যতামূলক কিছু নয়, আদালতের ক্ষমতামাত্র। দন্ডবিধির ৬৪ ধারায় এ বিষয়ে স্পষ্টই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। আবার ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪৫ ও ৫৪৬এ ধারায় জরিমানার আদায়কৃত অর্থ থেকে ভিকটিমকে সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ ধারাগুলোর ব্যবহার আমাদের আদালতগুলোয় একেবারে হয় না বললেই চলে। আমাদের আদালতগুলো ভিকটিমবান্ধব নয়।

আবার অনেকে বলতে পারেন, শরীরের প্রতি ক্ষতিসাধন একটি ‘দেওয়ানি প্রকৃতির বিরোধ’। কারণ দেওয়ানি কার্যবিধির ১৯ ধারায় শারীরিক ক্ষতিসাধনের জন্য যে দেওয়ানি মামলা করা যাবে তা বলা রয়েছে। আবার আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪৫-এর (১বি) ধারায় বলা আছে, অপরাধের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিসাধন হলে দেওয়ানি মামলার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ আদায়যোগ্য হবে। তবে সেখানে বলা হয়েছে, সামান্য ক্ষতি বা জখমের কারণে প্রদেয় জরিমানার অর্থ থেকেই ভিকটিমকে তা প্রদান করার আদেশ দিতে পারবে আদালত। কিন্তু শারীরিক ক্ষতির জন্য সিভিল মামলা, ওই মামলায় রায় ও ডিক্রি বাস্তবায়ন একটি অলীক বস্তুর মতো। তবে ফৌজদারি মামলার পাশাপাশি অপরাধের শিকার ব্যক্তি দেওয়ানি মামলাও করতে পারে। তবে ফৌজদারি মামলায় রায়ের পর দেওয়ানি মামলা করলে সেটাই সিদ্ধান্তকৃত হবে। তা না হলে দুটি আদালতের আলাদা রায় হলে তা সাংঘর্ষিক হতে পারে। কারণ ভিকটিমের দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলার রায় ক্ষতিপূরণের জন্য দায়েরকৃত দেওয়ানি মামলার জন্য প্রাসঙ্গিক হবে বলে আমাদের সাক্ষ্য আইনের ৪৩ ধারায় ইঙ্গিত রয়েছে। এখানে বলে রাখা বাহুল্য, আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০ ধারার (২সি) উপধারায় বলা হয়েছে, অপরাধের শিকার ব্যক্তি ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ঘোষিত মিথ্যা, তুচ্ছ ও বিরক্তিকর ফৌজদারি মামলার পরও ক্ষতিপূরণের জন্য দেওয়ানি মোকদ্দমা করতে পারবেন। আবার মিথ্যা মামলা করে অসহায় নিরীহ মানুষকে হয়রানির হাত থেকে রক্ষায় ফৌজদারি কার্যবিধির ২৫০ ধারার বিধান করা হয়েছে। কেউ যদি এমন মামলা করে যা মিথ্যা বা তুচ্ছ ও বিরক্তিজনক তবে সে মামলায় আসামিকে খালাস দিয়েই যেন ম্যাজিস্ট্রেট নীরব না থেকে ফরিয়াদিকে তার এহেন কাজের জন্য প্রায়শ্চিত্তের আদেশ দিতে পারেন। আসামি যে টাকাপয়সা খরচ করল, যন্ত্রণা পোহাল এগুলোর জন্য ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দিতে পারেন ফরিয়াদির ওপর। এ ক্ষমতা শুধু ম্যাজিস্ট্রেটের ওপরই দেওয়া রয়েছে; অন্য কোনো সহকারী দায়রা জজের ওপর নয়। তবে একটি বিষয় জেনে রাখা দরকার, মামলার যে কোনো অবস্থায় ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে খালাস দিতে পারেন। কিন্তু বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া সব সাক্ষীকে পরীক্ষা ছাড়া ম্যাজিস্ট্রেট এরূপ ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন না বলে ৭ ডিএলআর ২৭০ পৃষ্ঠায় একটি সিদ্ধান্ত রিপোর্টেড রয়েছে। আমাদের ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৮৬ ধারায় জরিমানা আদায়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও এ সম্পর্কিত আইনি ব্যাখ্যা বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে প্রচার-প্রকাশ করে দায় এড়াতে চায়। এ পর্যায়ে একটি কেস স্টাডি দিয়ে বিতর্কের অবসানের চেষ্টা করছি মাত্র। পাবনার জেলা প্রশাসক বেড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বরাবর দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কাছে ত্রাণ হিসেবে বিতরণের জন্য ২০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিয়েছিলেন। ওই বরাদ্দকৃত চাল থেকে ২০ মেট্রিক টন বেড়া পৌরসভার কমিশনার রওশন আলীর বরাবর এ মর্মে বরাদ্দ দেওয়া হয় যে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার লোকজনের কাছে তিনি যেন মাস্টার রোলের ভিত্তিতে বিতরণপূর্বক উপজেলা পরিষদের কাছে জমা দেন। কিন্তু তিনি ১ লাখ ৯৬ হাজার ৮০০ টাকা মূল্যের ২০ মেট্রিক টন চাল ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের মধ্যে বিতরণ না করে আত্মসাৎ করেন। ফলে ওই কমিশনার রওশন আলীর বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৪০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি দমন ২ নম্বর আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগ দায়ের হয়। বিভাগীয় বিশেষ বিচারকের আদালত ১২ সাক্ষীর সাক্ষ্য এবং দালিলিক কাগজপত্র বিবেচনা করে ওই দুটি ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে আসামিকে তিন বছরের কারাদন্ড ও ১ লাখ ৯৬ হাজার ৮০০ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করেন। ওই আদেশে সংক্ষুব্ধ হয়ে আপিলকারী হাই কোর্টে আপিল করেন। শুনানি অন্তে হাই কোর্ট আপিলটি ডিসমিস করে দিয়ে জরিমানার ১ লাখ ৯৬ হাজার ৮০০ টাকা আপিলকারীর কাছে থেকে আদায় করার নির্দেশ প্রদান করেন। উপরোক্ত কেস স্টাডিটি মো. রওশন আলী বনাম রাষ্ট্র, ২০০২ বিএলডি, পৃষ্ঠা ৩৩-এ রিপোর্টেড রয়েছে। উপরোক্ত সিদ্ধান্ত থেকে সবার বোঝা দরকার যে ফৌজদারি আদালত কর্তৃক আসামির ওপর আরোপিত জরিমানা শারীরিক দন্ডের পরিবর্তে আর্থিক দন্ড বিশেষ। সে ক্ষেত্রে আসামি জরিমানা প্রদান করার পরিবর্তে তার ওপর আরোপিত কারাদন্ড ভোগ বেছে নিতে পারে না। কারণ হিসেবে স্পষ্টই বলা যায় যে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৮৬ ধারার বিধান অনুসারে জরিমানা দেওয়ানি আদালতের ডিক্রির মতো একটি অবশ্য পরিশোধযোগ্য আদেশ বিশেষ। আসামিকে যদি জরিমানা পরিশোধের ব্যর্থতায় স্বেচ্ছায় কারাদন্ড ভোগ করার সুযোগ দেওয়া হয় তাহলে জরিমানার উদ্দেশ্য রীতিরকম ব্যাহত হয়। কাজেই দুর্নীতির মামলায় আসামিকে তছরুপকৃত মালামালের মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ এ কারণে জরিমানা করা হয় যেন তদ্বারা রাষ্ট্রীয় ক্ষতির ক্ষতিপূরণ হতে পারে। যদি তা না করা হয় তাহলে অপরাধীকে তদ্রƒপ অপরাধ করতে উৎসাহিত করা হবে। শুধু যে ক্ষেত্রে দন্ডিত ব্যক্তির সম্পদের দ্বারা জরিমানার অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রে দন্ডিত ব্যক্তির জরিমানার পরিবর্তে কারাদন্ড ভোগ করতে হয় এবং অন্য ক্ষেত্রে নয়।

 

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক।

Emali : [email protected]

সর্বশেষ খবর