মঙ্গলবার, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

জমি দখল করে মসজিদ নির্মাণ বৈধ নয়

মাওলানা শেখ তারেক হাসান মাহদী

পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্রতম স্থান মসজিদ। মহান আল্লাহর বান্দারা স্বর্গীয় শান্তি ও স্বস্তি ফিরে পান দৈনিক পাঁচবার মসজিদে এসে নামাজ আদায় করে। কিন্তু আল্লাহর ঘর এ মসজিদের জায়গাটি যদি হয় অবৈধ ও দখলকৃত সম্পত্তির ওপর তবে তা যেমন দুঃখজনক, তেমনি মহান আল্লাহর সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণাও। রাজধানীসহ শহরকেন্দ্রিক এসব মসজিদ মূলত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মোড়লদের অবৈধভাবে নির্মিত শিল্পকারখানা ও দোকানপাটকে বৈধ করার প্রচেষ্টা মাত্র। চক্রটি প্রথমে ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সরকারি ভূমিতে একটি মসজিদ নির্মাণ করে। তারপর সেই মসজিদ কেন্দ্র করে গড়ে তোলে অবৈধ স্থাপনা। শরিয়তের আলোকে এসব অবৈধ দখলকৃত সম্পত্তিতে মসজিদ তৈরির বিধান না থাকলেও সরলপ্রাণ ধর্মভীরু মানুষের আবেগ কাজে লাগিয়ে একশ্রেণির দখলদার গোষ্ঠী হয়ে উঠছে বেপরোয়া। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অজুহাত দেখিয়ে আদায় করছে সাধারণ মানুষের সহমর্মিতা। এসব দখলদারির চিত্র শহরের চেয়ে গ্রামে আরও বেশি ছড়িয়ে পড়ছে। গ্রামের মাতব্বর ও পঞ্চায়েতরা মিলে বিরোধপূর্ণ ব্যক্তিমালিকানার সম্পত্তি মীমাংসার নাম করে কিছু অংশ নিজেদের নামে ও কিছু অংশ মসজিদ- মাদরাসার নামে জোর করে লিখিয়ে নিচ্ছে হামেশাই। মসজিদ আল্লাহর ঘর। একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের জন্যই মসজিদ নির্মিত হতে হবে। কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে যদি মসজিদ নির্মাণ করা হয়, তাহলে তা শরিয়তের বিধান অনুসারে মসজিদ হিসেবে গণ্য হবে না। মসজিদ নির্মাণ যদিও ভালো আমল কিন্তু জমি দখল করে মসজিদ নির্মাণ অসাধু কাজ। রসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি কাজের ভালোমন্দ নির্ভর করে তার নিয়তের ওপর।’ এ ধরনের মসজিদে জানা সত্ত্বে নামাজ পড়লে নামাজ হবে না বলে ফতোয়া দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

অসদুদ্দেশ্যে বানানো হয়েছে এমন একটি মসজিদ রসুলুল্লাহ (সা.) গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা ইসলামের ইতিহাসে ‘মসজিদে জেরা’র নামে পরিচিত। প্রখ্যাত মুফাসসির ইমাম কুরতুবি (রহ.) ও মাওলানা কাজি সানাউল্লাহ পানিপথী (রহ.) সুরা তওবার ১০৭-১১০ নম্বর আয়াতের তাফসির প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘মদিনায় আবু আমের নামে এক ব্যক্তি ছিলেন। যিনি আজীবন ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তিনি ইহুদিদের সঙ্গে মিলে কুবা মসজিদের অদূরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। উদ্দেশ্য এ মসজিদে বসে ইসলামকে ধ্বংস করার নীলনকশা প্রণয়ন। রসুল (সা.) তখন তাবুক যুদ্ধের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন। তাবুক যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে যখন তিনি মদিনার নিকটবর্তী এক স্থানে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, তখন সুরা তওবার কয়েকটি আয়াত নাজিল হয়। আয়াতগুলো রসুলুল্লাহ (সা.)-কে ওই মসজিদে যেতে নিষেধ করা হয় এবং মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেওয়া হয়। আয়াতগুলো নাজিল হওয়ার পর সাহাবিরা ওই মসজিদ আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেন।’ তাফসিরে কুরতুবি ও তাফসিরে মাজহারি। জবরদখলি জমিতে মসজিদ নির্মাণ করলে তা শরিয়তের বিধানমতে মসজিদ হিসেবে গণ্য হবে না। এ বিষয়ে বিজ্ঞ মুফতিদের ফতোয়া হলো কারও মালিকানাধীন জমিতে জোরপূর্বক মসজিদ নির্মাণ করা জায়েজ নয়। মসজিদ নির্মাণ করতে হলে নির্ভেজাল জমি মসজিদের নামে ওয়াকফ হওয়া জরুরি। রসুলুল্লাহ (সা.) মসজিদে নববীর জমি তাঁকে বিনামূল্যে উপহার হিসেবে দিতে চাইলেও তিনি তা গ্রহণ করেননি। তিনি জমির মূল্য বাজারদর অনুযায়ী পরিশোধ করার পর মসজিদ নির্মাণ করেছেন। সৈয়দ আমির আলী লিখেছেন, ‘যে জমির ওপর মসজিদে নববী নির্মাণের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল, তা ছিল দুই ভ্রাতার। জমিটি তারা দান করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু যেহেতু তারা ছিল এতিম তাই রসুলুল্লাহ (সা.) তাদের জমির মূল্য প্রদান করেছিলেন।’ দ্য স্পিরিট অব ইসলাম, পৃষ্ঠা ১১৭।

ওয়াকফবিহীন জমিতে মসজিদ নির্মাণ করা হলে তা শরয়ি মসজিদ হবে না। যদি কোনো জমির মালিক তাঁর জমি ওয়াকফ করতে রাজি না হন এবং জোরপূর্বক তাঁর জমিতে মসজিদ নির্মাণ করা হয় তাহলে ওই মসজিদ ভেঙে জমি তার মালিককে ফেরত দিতে হবে। ফাতওয়া হিন্দিয়া, খন্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৪৮; রদ্দুল মুহতার, খন্ড ৪, পৃষ্ঠা ৩৯০।

                লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর