রবিবার, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

প্রতিটি মুসলিম নবজাতকের আকিকা করা সুন্নত

মুফতি রুহুল আমিন কাসেমী

প্রতিটি মুসলিম নবজাতকের আকিকা করা সুন্নত

ইসলাম একটি শান্তি ও পূর্ণাঙ্গ ধর্ম। ইসলাম ধর্মে প্রতিটি মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু, তার আগে ও পরের সব বিধান পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যে ব্যক্তি ইসলাম ধর্মের সব বিধান মেনে চলবে তাকে খাঁটি মুসলমান বলা হয়। আর একজন খাঁটি মুসলমানের দুনিয়া ও আখিরাতের সার্বিক সফলতা, ইসলামের বিধান পালন এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে। একটি নবজাতকের জন্ম, মানুষের সর্বোচ্চ চাওয়া-পাওয়া, সুখ-শান্তি, আনন্দ ও ভবিষ্যৎ বংশধারা রক্ষার নিশ্চয়তা বহন করে। আল্লাহতায়ালার প্রদত্ত নিয়ামতের মধ্যে এটি অন্যতম। যেন মা-বাবার ছোট্ট কুটিরে দীপ্তিময় সূর্যের আগমন। সেই ছোট্ট শিশুর হাসিমুখি কচি, নিষ্পাপ ফুলের মতো পবিত্র চেহারায় খুঁজে পায় মা-বাবার যুগল চেহারার আকৃতি। অপেক্ষায় থাকে কখন ডাকবে মা-বাবা বলে। তাই নবজাতকের জন্মের পর মা-বাবার জন্য কর্তব্য হলো নবজাতক শিশুর সুন্দর একটি ইসলামিক নাম রাখা। এবং জন্মের সপ্তম দিনে আকিকা করা। ছেলে হলে দুটি আর মেয়ে সন্তান হলে একটি কোরবানিতে জবাইযোগ্য পশু দ্বারা আকিকা করা। আকিকা করা মুসলিম নবজাতক শিশুর জন্য সুন্নত। কেননা আকিকার দ্বারা নবজাতক শিশুর হক আদায় করা হয়, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা হয় এবং আল্লাহ তাঁর নানাবিধ বালা-মুসিবত, বিপদ আপদ থেকে তাকে রক্ষা করেন। জীবের বিনিময়ে জীবনের নিরাপত্তা দান করেন। ইসলামপূর্ব যুগেও আকিকার প্রচলন ছিল, যদিও তার ধরন-প্রকৃতি ছিল ভিন্ন। এখনো ইহুদিদের মধ্যে আকিকার প্রচলন রয়েছে। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ইহুদিরা ছেলে সন্তানের জন্য আকিকা করে, মেয়ে সন্তানের জন্য কোনো আকিকা করে না। তোমরা ছেলে সন্তানের জন্য দুটি ছাগল, আর মেয়ে সন্তানের জন্য একটি ছাগল দ্বারা আকিকা করবে।’ হজরত আবু বুরাইদাহ (রা.) বলেন, ‘আইয়ামে জাহেলিয়ায় আমাদের কারও ছেলে সন্তান হলে আমরা একটি ছাগল জবাই করতাম।’ হজরত আলী (রা.) বলেন, ‘রসুলুল্লাহ (সা.) হাসানের জন্য একটি ছাগল দ্বারা আকিকা করেছিলেন।’ এ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় মুসলিম নবজাতক শিশুদের জন্য আকিকা করা সুন্নত। যদিও সব ইমামের ঐকমত্য, আকিকা একটি মুস্তাহাব আমল। নবজাতক সন্তানের পিতার পক্ষে আল্লাহর শুকরিয়া আদায়পূর্বক কৃতজ্ঞতার নিদর্শনস্বরূপ আকিকা করা মুস্তাহাব। সম্ভব হলে নবজাতকের জন্মের সপ্তম দিনে আকিকা করা উত্তম, কেননা রসুলুল্লাহ (সা.) সপ্তম দিনে আকিকা করতেন। সপ্তম দিনে সম্ভব না হলে চতুর্দশতম দিনে আকিকা করবে। তা-ও সম্ভব না হলে একবিংশতম দিনে, তা-ও সম্ভব না হলে যে কোনো দিন সম্ভব হয় করবে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে জন্মের সপ্তম দিনের প্রতি লক্ষ্য রাখা উত্তম। যেমন সোমবার জন্ম হলে যে কোনো রবিবার আকিকা করবে। বুধবার জন্ম হলে যে কোনো মঙ্গলবার আকিকা করবে। শনিবার জন্ম হলে যে কোনো শুক্রবার আকিকা করবে। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) তাদের নবজাতক সন্তানের জন্য দুটি সমবয়সী ছাগল আর মেয়ে সন্তানের জন্য একটি ছাগল আকিকা করার নির্দেশ করেছেন। অর্থাৎ নবজাতক সন্তান ছেলে হলে দুটি ছাগল, ভেড়া অথবা গরু-মহিষের দুই অংশ আকিকা করবে। আর সন্তান মেয়ে হলে একটি ছাগল, ভেড়া অথবা গরু-মহিষের একাংশ আকিকা করবে। আকিকা অনেকটা কোরবানির মতো, তাই কোরবানিতে যেসব পশু জবাই করা যায়, আকিকায়ও সেভাবে সেই প্রকারের পশু আকিকা করা যায় এবং তার বয়স ও গোশত বণ্টন একই রকম থাকবে। অর্থাৎ তিন ভাগে বণ্টন করে দেওয়া সুন্নত এবং নিজ পরিবারের মা-বাবা দাদা-দাদি নানা-নানিসহ সবাই খেতে পারবে। সন্তানের মা-বাবা গরিব হলে অন্য কারও পক্ষ থেকে সেই সন্তানের আকিকা প্রদান করা জায়েজ। বরং তা বহুৎ বড় একটি সৎকাজ ও নেক কাজের সহায়তাকারী বলে গণ্য হবে। নবীজি ইরশাদ করেন, প্রতিটি নবজাতক নিজ আকিকার সঙ্গে বন্ধক থাকে। যদি নবজাতক সন্তান পৃথিবীতে আসার পর কান্না করে এবং খাবার গ্রহণ করে এরপর তার ইন্তেকাল হয়ে যায়, তাহলে সেই নবজাতকের জন্য গোসল দেওয়া, জানাজা দেওয়া, দাফন করা এবং সুন্দর নাম রেখে আকিকা দেওয়া মুস্তাহাব। যদি মায়ের পেটে তার মৃত্যু হয় তাহলে নাম রাখবে না ও আকিকা দেবে না। বরং কাপড়ে পেঁচিয়ে, জানাজাবিহীন দাফন করে দেবে। মুসলিম নবজাতকের জন্য আকিকা করা, জবাইকৃত পশুর গোশত কাঁচা বা রান্না করে বিতরণ করা, শিশুর মাথা মুণ্ডন করে চুলের ওজনের সমপরিমাণ সোনা-রূপা বা তৎমূল্য দান করা এবং সুন্দর ইসলামী নাম রাখা সুন্নত ও মুস্তাহাব। কিন্তু এ সম্পর্কিত আমাদের সমাজে অনেক বিজাতীয় কৃষ্টি-কালচার, অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড ও কুসংস্কার বিদ্যমান রয়েছে। যা সম্পূর্ণরূপে বর্জনীয়। যেমন আকিকার গোশত সন্তানের বাবা-মা দাদা-দাদি নানা-নানি খেতে পারবে না। মাথা মুণ্ডন করার সময়ই আকিকার পশু জবাই করতে হবে। আকিকার সময় সন্তানের নানাবাড়ি থেকে বিভিন্ন প্রকার মূল্যবান উপহারসামগ্রী প্রদান করার বাধ্যবাধকতা। যা থেকে অবাঞ্ছিত ঘটনা ও মনোমালিন্যের সূত্রপাত হয়। আকিকা উপলক্ষে মহল্লা থেকে আনন্দ-উৎসব করে চাঁদা সংগ্রহ করে, তা দিয়ে নাপিতকে পারিশ্রমিক প্রদান করা ও আনন্দ উৎসবের আয়োজন করা। আকিকার গোশতের হার চিবিয়ে ও ভেঙে না খেয়ে আস্ত রেখে দেওয়া। সুতরাং এসব কুসংস্কার থেকে নিজেকে রক্ষা করে, কোরআন-হাদিস মোতাবেক একটি সুন্নত ও মুস্তাহাব আমল সুন্দরভাবে আদায় করা আমাদের জন্য কর্তব্য। সূত্র : ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম’।

লেখক : ইমাম ও খতিব, কাওলার বাজার জামে মসজিদ, দক্ষিণখান।

 

সর্বশেষ খবর