সোমবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

ভালোবাসা নিরন্তর ভালোবাসা অনন্ত

নাফিসা বানু

ভালোবাসা শব্দটির ব্যাপ্তি বা পরিধি অনেক বড় বা বিশাল। ভালোবাসা মা-বাবা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ভালোবাসা বলতে বোধ বা অনুভূতিকে বোঝায়। এটা অনুভব করার ব্যাপার, বোঝার ব্যাপার। কেউ কাউকে ভালোবাসলে সেটা মুখে বলা না হলেও আচার-আচরণ, কথাবার্তা, ইশারা-ইঙ্গিত ইত্যাদির মাধ্যমেও বোঝানো যায় বা অনুভব করা যায়। কিছু কিছু ভালোবাসা প্রকৃতি প্রদত্ত, আত্মিক বা রক্ত সম্পর্কিত। মা-বাবা, ছেলেমেয়ে, ভাই-বোনের ভালোবাসা এই ভালোবাসা নির্মল। এই ভালোবাসা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জন্মায়। অন্য সব ভালোবাসা যেমন স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ইত্যাদি ভালোবাসার সম্পর্ক গড়তে হয়। যা লালন করতে হয়। ভালোবাসাকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়। একেক সম্পর্কের ভালোবাসা একেক রকমের হয়ে থাকে। যার হৃদয়ে ভালোবাসা নেই তাকে স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে গণ্য করা যায় না। তবে ভালোবাসা প্রায় সবার হৃদয়েই কম বেশি থাকে। ভালোবাসা ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভালোবাসাকে মেকি ভালোবাসা বলা যায়, যা শুধু মানুষকে খুশি করার জন্য প্রকাশ করা হয় অন্তর থেকে নয়। কথায় আছে ভালোবাসা দিয়ে বিশ্ব জয় করা যায়। ভালোবাসা ধর্ম, বর্ণ, সমাজ, ছোট-বড়, উঁচু-নীচু জাত-পাত কিছুই মানে না। ভালোবাসা মহিয়ান। ভালোবাসা অম্লান। সত্যিকারের ভালোবাসা কৃত্রিমতা বিবর্জিত অর্থাৎ অকৃত্রিম।

পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে অনেক দিন ধরে ১৪ ফেব্র“য়ারির দিনটি ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৩ সালে প্রথম বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবস পালিত হয়। উল্লেখ্য, বিশিষ্ট সাংবাদিক শফিক রেহমান প্রথম বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবস পালনের প্রচলন শুরু করেন। ভালোবাসা দিবসে তিনি প্রথম গোলাপ ফুল উপহার দিয়ে দিবসের প্রচলন শুরু করেন। আমরা এখন নানাভাবে এই দিবসটি পালন করি। ফুল, বিশেষ করে লাল গোলাপ উপহার হিসেবে ভালোবাসার মানুষকে দেওয়ার রীতি প্রচলিত আছে। অনেকে আবার ভালোবাসার রং লাল বিধায় ভালোবাসা দিবসে লাল পোশাক পরিধান করে। ভালোবাসা অনাবিল। আমাদের দেশে বর্তমানে বেশ আয়োজনের সঙ্গে শহর এলাকায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তরুণ-তরুণী ভালোবাসা দিবস পালন করে থাকে ব্যক্তিগতভাবে। সরকারিভাবে এ দিবস পালনের জন্য কোনো আয়োজন করা হয় না। ভালোবাসা একদিনের জন্য নয়, প্রতিদিনই ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসা চলমান প্রক্রিয়া। ভালোবাসা নিরন্তর, ভালোবাসা অনন্ত।

ভালোবাসা দিবসের শুরু কীভাবে সে সম্পর্কে নানা গল্প প্রচলিত আছে। তার মধ্যে তিনটি গল্পকে ভালোবাসা দিবসের শুরু বা উৎপত্তি হিসেবে ধরা হয়ে থাকে। প্রথম গল্পটি প্রচলিত আছে এভাবে যে, ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ছিলেন একজন শিশু প্রেমিক, সামাজিক ও সদালাপি মানুষ। তিনি খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী ছিলেন এবং রোম সাম্রাজ্যের বাসিন্দা ছিলেন। তৎকালীন রোম সম্রাট দ্বিতীয় ক্লোডিয়াস দেব-দেবীর পূজারি ছিলেন। সম্রাট দ্বিতীয় ক্লোডিয়াস দেব-দেবীর পূজারি ছিলেন। সম্রাট তখন ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে দেব-দেবীর পূজা করার জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু ধর্মযাজক ভ্যালেন্টাইন তা অস্বীকার করেন। এর ফলে সম্রাট ক্ষুব্ধ হয়ে ধর্মযাজককে বন্দি করেন এবং পরবর্তীতে তাকে মৃত্যুদন্ড দেন। সেই দিনটি ছিল ১৪ ফেব্র“য়ারি তখন থেকেই ভালোবাসার প্রেমিক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই দিবস অর্থাৎ ১৪ ফেব্র“য়ারি ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

দ্বিতীয় গল্পটি প্রচলিত আছে এরকম যে, কারারুদ্ধ সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে তরুণ-তরুণীদের অনেকেই দেখতে আসতেন সঙ্গে আনতেন ফুল। কারারক্ষীর এক অন্ধ মেয়েও ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে কথা বলতে আসতেন। এক সময় ভ্যালেন্টাইন তার প্রেমে পড়ে যান। ধর্মযাজক ভ্যালেন্টাইনের আধ্যাত্মিক চিকিৎসার মাধ্যমে মেয়েটি এক সময় তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়। তরুণ-তরুণীদের প্রতি ধর্মযাজক ভ্যালেন্টাইনের ভালোবাসা এবং ভ্যালেন্টাইনের প্রতি তরুণ-তরুণীদের ভালোবাসার কথা জানতে পেরে সম্রাট ক্ষিপ্ত হয়ে যান এবং সেই সময় অর্থাৎ ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্র“য়ারি ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করেন।

তৃতীয় গল্পটি ছিল এমন; রোম সম্রাট দ্বিতীয় ক্লোডিয়াসকে তার সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে দরকার ছিল বিশাল এক সেনাবাহিনীর। এ জন্য সেনাবাহিনীতে যুবকদের যোগদান করতে বাধ্য করতে বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন তৎকালীন সম্রাট ক্লোডিয়াস। তার এ ধরনের ঘোষণায় এ দেশের যুবক-যুবতী ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনও এ নিষেধাজ্ঞা মেনে নিতে পারেননি। তিনি গোপনে তার গির্জায় বিয়ে পড়ানোর কাজ পালন করতে থাকেন। তখন তিনি পরিচিতি পেলেন ‘ভালোবাসার বন্ধু’ বা “Friend of Lovers” নামে। যখন ভ্যালেন্টাইনকে দেওয়া এই উপাধিটি সম্রাট ক্লোডিয়াসের কানে গেল তখন তিনি সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। ২৭০ খ্রিস্টাব্দে ১৪ ফেব্র“য়ারি সৈন্যরা ভ্যালেন্টাইনকে হাত-পা বেঁধে সম্রাটের কাছে নিয়ে হাজির করেন। তখন সম্রাট তাকে হত্যার আদেশ দেন। এরকম নানা গল্প প্রচলিত আছে ভালোবাসা দিবস উদযাপনের পেছনে।

 

মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা চিরন্তন। ফলে এই ভালোবাসা থেকেই ভালোবাসা দিবসের উৎপত্তি। ভালোবাসা মানুষের হৃদয়ে, অন্তরে, চিত্তে, মননে বিরাজ করে। হৃদয় থেকে হৃদয়ে ভালোবাসার জন্ম হয়। এই ভালোবাসা সর্বজনীন। ভালোবাসা সব মানুষের মধ্যে বিরাজ করে কম বেশি। এর বহিঃপ্রকাশ একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম। ভালোবাসা নির্ভর করে মানুষের চিন্তা-চেতনা, আবেগ অনুভূতির ওপর। একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষের চিন্তা-চেতনা, আবেগ-অনুভূতির মিল না হলে সেখানে ভালোবাসার সম্পর্ক বেশি দিন স্থায়ী হয় না। সম্পর্ককে সঠিকভাবে লালন করার ওপর ভালোবাসার স্থায়িত্ব নিহিত। ভালোবাসার সম্পর্ককে সম্মান করতে হবে। যে কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখা যায় সম্মানবোধ প্রয়োজন। সম্পর্ককে সম্মান দিতে হবে, মর্যাদা দিতে হবে। সে যে সম্পর্কের ভালোবাসাই হোক না কেন। ভালোবাসার সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সম্মানের সঙ্গে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ অনেকাংশে ভূমিকা রাখে। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে সম্পর্কে জড়িত সবাইকে দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতে হয়।

ভালোবাসার পরিধি বৃহত্তর, এই বৃহত্তর ভালোবাসার পরিধিতে দেশকে ভালোবাসাও এক ধরনের ভালোবাসা। দেশকে ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রতি সম্মানবোধ থাকতে হবে। দেশের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে নিজ নিজ পরিসর থেকে পালন করতে হবে। প্রত্যেক নাগরিকের কাছে তার দেশ মাতৃসম। দেশ মাতাকে ভালোবাসা সব নাগরিকের দায়িত্ব। যে দেশের জনগণের মধ্যে তাদের দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশপ্রেম, দেশাত্মবোধ যত বেশি সে দেশ তত উন্নত। দেশের প্রতি ভালোবাসা বা দেশপ্রেম না থাকলে সে দেশ উন্নত হতে পারে না। দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে হলে সবার আগে প্রয়োজন জনগণের মধ্যে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলা। দেশের প্রতি ভালোবাসা, দেশের সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ ও অন্যান্য সবার মধ্যেই থাকতে হবে। এ ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রত্যেক নাগরিককে তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশকে ভালোবাসতে হবে। আসুন আমরা সবাই মিলে এ ভালোবাসা দিবসে মা-বাবা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে ভালোবাসার পাশাপাশি দেশকেও ভালোবাসার প্রতিজ্ঞা করি। ভালোবাসা বিরাজ করুক সবার অন্তরে, হৃদয়ে সর্ব ক্ষেত্রে সর্বস্তরে।

লেখক : সদস্য (অর্থ) নির্বাহী বোর্ড, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ।

সর্বশেষ খবর