শুক্রবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

লতা মঙ্গেশকরের সুধাকণ্ঠের মোহনীয় অনন্ত ঐশ্বর্য

এম জে আকবর

লতা মঙ্গেশকরের সুধাকণ্ঠের মোহনীয় অনন্ত ঐশ্বর্য

সময় মহাকালের অংশ। সময় শীতল। সময় নিঠুর। সময়কে ধরে রাখা যায় না। ধরে রাখা যায় ঘটনা। স্মৃতির মধুভাণ্ডারে ঘটনা টিকে থাকে, মস্তিষ্কের কোষে ঘুমিয়ে থাকে এবং জেগে ওঠার অপেক্ষায় থাকে। সম্ভবত আশির দশকে আমি বুঝতে পাই যে লতা মঙ্গেশকর শুধু অতুলনীয় সুধাকণ্ঠের অধিকারীই নন, তাঁর আছে মোহনীয় এক অনন্ত অশেষ ঐশ্বর্য।

আশির দশকের শেষ দিকে বাণিজ্যিক উড়োজাহাজের দেহকাঠামো প্রশস্ত হয়, আসনগুলো হয়ে যায় আগের চেয়ে আরামদায়ক আর আসন সংযুক্ত হাতলের রকমফের। যেসব যাত্রী ত্রিশোর্ধ্ব তাদের ধরে রাখার বিপণন কৌশল হিসেবেই সম্ভবত এয়ার ইন্ডিয়া পৃথক একটা অডিও চ্যানেল চালু করল। এ চ্যানেলে পঞ্চাশ ও ষাট দশকের নামকরা হিন্দি সিনেমার গান শোনার ব্যবস্থা ছিল। আকাশযাত্রায় আমার স্বাদু খাদ্য হয়ে পড়েছিল এ গান। আমার গন্তব্যে এয়ার ইন্ডিয়ার উড়োজাহাজ চলাচল করলে আমি তাতেই ভ্রমণ করতাম। ফিরতি ফ্লাইটেও গানের মায়ায় আবিষ্ট হতে পারতাম।

বিদেশে সপ্তাহকাল কাটালে মানুষের আফসোস শুরু হয়ে যায়। জনপ্রিয় গান আর বাজনা যেগুলো তার জীবনের অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছিল, সেগুলো শুনতে না পাওয়ার আফসোসে ভোগে সে। উড়োজাহাজে আসন নিয়েই যে কাজটা প্রথম করতাম তা ওই চ্যানেলের বোতাম টেপা। এমনকি নিউইয়র্ক বিমানবন্দরের ওপরকার কাদারং আকাশেও বোতাম টিপেই আবার ফিরে আসতাম আপন জগতে। কেননা ওতেই  লতা গাইতেন ‘ও চাঁদ খিলা, ও তারে হাসিন, ইয়ে রাত আজব মাতোয়ারি হ্যায়’। সমঝনেওয়ালে সমঝ চুকে হ্যায়, না সমঝে ও আনাড়ি হ্যায়’। কিংবা গাইতেন ‘তেরা জানা, দিল কি আরমানোঁ কা লুট জানা। কোয়ি দেখে বনকে তকদিরোঁ কা মিট জানা’। এমনই ছিল বলিউডে তৈরি পঞ্চাশ দশকের ছবিগুলোর গান। যেসব গান বিশুদ্ধ প্রেমের পথপরিক্রমায় মানব-মানবীর আশা-নিরাশার মুগ্ধকর বর্ণনায় মুখর।

এয়ার ইন্ডিয়ার ট্র্যাকে মোহাম্মদ রফি, মুকেশ, মান্না দে আর কিশোর কুমারের গানও ছিল। কিন্তু এ প্রতিভা চতুষ্টয়ের প্রভাব কখনই লতার মতো তাৎপর্যময় ছিল না। কেন এমন হয় তার কারণ নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। তবে এটা বোধহয় বলা চলে, ‘পুরুষ ঘোরে বনে বনে/নারী তারে ঘরে আনে’।

আমাদের ভারতীয় সিনেমায় ‘প্লেব্যাক গায়কের’ আধিপত্য চমৎকার একটা ব্যাপার। বাজনাবাদ্য আর কবিতার মিশ্রণকে জানান দেওয়া ছাড়া আমরা ভারতীয়রা প্রেম করতে বা শোক করতে, হাসতে বা কাঁদতে পারি না। দেব আনন্দ একবার আমায় বলেছিলেন, তাঁর দারুণ একটা ছবি ‘গাইড’ ১৯৬৫ সালে মুক্তি পেয়েছিল। ছবিটি প্রথম দিকে ব্যবসায় মার খায়। ‘ফ্লপ’ হওয়া ছবিটি এক সপ্তাহ পরে ‘হিট’ হতে শুরু করল। তত দিনে ছবিটির গান মানুষের মুখে মুখে উঠে গেছে। ‘গাইড’ শ্বাসরুদ্ধকর। চলতি সময়ের চেয়ে এগিয়ে যাওয়া আইডিয়ার গল্পের। আর নায়িকাপ্রধান ছবি। স্থপতি স্বামীর সঙ্গে জীবন-যাপনের একঘেয়েমিতে ত্যক্তবিরক্ত রোজি সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসে তার প্রেমিক রাজুর উসকানিতে। সে মুক্ত নারী হবে, হবে পেশাদার নৃত্যশিল্পী। রাজু তার ম্যানেজার। তারা লিভ টুগেদার করতে থাকে। শিল্পী হিসেবে রোজি সাফল্য পায়। তবে এর জন্য মূল্য দিতে হয়েছে। রাজুর অর্থলিপ্সা আর শোষণ মন ভেঙে দিয়েছে রোজির। প্রথা গুঁড়িয়ে দেওয়া ‘গাইড’-এর সাফল্যের কৃতিত্ব সুন্দরী ওয়াহিদা রেহমান আর সুদর্শন দেব আনন্দ, যতটা দাবি করতে পারেন, যতটা পরিচালক বিজয় আনন্দ ও সুরকার শচিন দেব বর্মণের অবদানের কারণে এ ছবি যতটা সার্থক তার চেয়ে বেশি সার্থক লতা মঙ্গেশকরের গানের জন্য। লতার গাওয়া প্রতিটি গান সুপারহিট হয়েছে। আজও কানে বাজে ওই ছবিতে লতার গাওয়া ‘মোহ সে চল কিয়া জায়ে, হায়রে হায় দেখো, সাঁইয়া বেইমান’।

প্রত্যেক নায়িকার জন্য গেয়েছেন লতা। ১৯৪৯ সালে ‘মহল’ ছবিতে ১৭ বছর বয়সী মধুবালার জন্য লতা গাইলেন ‘আয়ে গা, আয়ে গা আনেওয়ালা’। ৩৬টি ভাষায় গেয়েছেন লতা। তাঁর গাওয়া গানের সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়েছেন মধুবালা, মীনাকুমারী, নার্গিস, নিম্মি, নাদিরা, সুচিত্রা সেন, বৈজয়ন্তীমালা, নূতন, মালা সিনহা, সাধনা, আশা পারেখ, শাকিলা, ওয়াহিদা রেহমান, সায়রা বানু, হেমামালিনী, মমতাজ প্রমুখ। এসব নায়িকা লতার গানে যুক্ত হয়েছেন বলে লতা এঁদের মতো হয়ে যাননি, লতার মতো গাইছেন, পর্দায় এ রকম ভান করে এঁরাই একেকজন লতা হয়ে উঠেছেন। ‘আনপড়’ (নিরক্ষর) ছবিতে মদনমোহন সুরারোপিত আর রাজা মেহেদি আলী খান রচিত ‘আপ কি নজরোঁ নে সমঝে, পেয়ার কি কাবিল মুজে’ গেয়েছেন লতা মঙ্গেশকর। ঠোঁট মিলিয়েছেন মালা সিনহা। কী উজ্জ্বল দ্যুতিময়ই না হয়ে উঠেছিলেন সেই নায়িকা। মনে করা যায় ‘সংযোগ’ ছবির সেই গান যাতে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন অনিতা গুহ (এই নায়িকার প্রসঙ্গ এখন কমই আসে)- ‘ও ভুলি দাস্তান লো ফির ইয়াদ আ গেয়ি, নজর কি সামনে ঘটা সি ছা গেয়ি’।

বলিউডের সুন্দরতম তিনটি ছবিতে লতা মঙ্গেশকর তাঁর কণ্ঠসুধা ঢেলে দিয়ে ভাস্বর হয়ে আছেন এবং যত দিন ইউটিউব থাকবে তত দিনই থাকবেন। ছবি তিনটি হলো বিমল রায় পরিচালিত ‘মধুমতি’, দেব আনন্দের ‘গাইড’ ও কে আসিফ পরিচালিত ‘মুঘল-ই আজম’। সলিল চৌধুরীর সুরে মধুমতিতে লতার গাওয়া ‘আজা রে পরদেশি মাই তো কব সে খাড়ি ইসপার’ মন ছুঁয়ে যায় শ্রোতার।

সংগীত বিশ্বজনীন ভাষা। লতা ভারতীয় রাগ-এর সাধক। তবু তিনি বিটোভেনের মিউজিক শুনতেন মনোযোগ দিয়ে। বিটলসদের গানও। মানুষের আবেগের প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি স্তর তাঁকে স্পর্শ করেছে। অনেকে বিস্ময়ের সঙ্গেই দেখতে পেয়েছেন যে ১৯৬৩ সালে ভারতের জাতিসত্তার অনুভবটি তিনি তাঁর কণ্ঠসুধায় ধারণ করেন পরম নৈপুণ্যে- ‘আয়ে মেরে ওয়াতন কি লোগোঁ’। এ গান একান্তে নির্জনে শুনলে শোনার কোনো না কোনো একটি পর্যায়ে ভারতীয় নাগরিকের চোখ পানিতে টলমল করবেই।

লতার অন্যসব অনুরাগীর মতো আমিও প্রায়ই ভাবী- আচ্ছা, তাঁর কোন গানটি সেরা! বাছতে গিয়ে হয়রান হওয়াটাই সার। মনে হয়েছে সম্রাট শাহজাহানের বিপুল রত্নভাণ্ডার থেকে শ্রেষ্ঠ রত্নটি আহরণের বৃথা চেষ্টা করছি।

কালের যাত্রা ক্লান্তিহীন। মধুবালা চলে গেছেন ৩৬ বছর বয়সে, ৩৮-এ গেলেন মীনাকুমারী, নার্গিস ৫১-তে, নূতন ৫৪-তে, সাধনা ৭৬-এ। কার ডাক কখন আসবে কেউ জানে না। জীবন ও মরণ যুক্তি মেনে হয় না। লতাই গেয়েছেন ‘ইয়ে চিরাগ বুঝ রাহে হাঁয়, মেরে সাথ জ্বলতে জ্বলতে’, (আমার সঙ্গে জ্বলতে জ্বলতে প্রদীপটা নিভে যাচ্ছে)। আমাদের সৌভাগ্য যে লতা আমাদের সঙ্গে ৯২ বছর পর্যন্ত ছিলেন।

‘গুজরা হুয়া জমানা আতা নেহি দোবারা, হাফিজ খোদা তুমহারা’ (‘চলে যাওয়া সময় আর আসে না। তোমায় খোদার হাতে সঁপে দিলাম’)। ‘শিরি ফরহাদ’  ছবিতে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া গান।

লেখক : ভারতের সাবেক প্রতিমন্ত্রী।

সর্বশেষ খবর