শুক্রবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলা নবীজির সুন্নাহ

আবদুল্লাহ আল মামুন আশরাফী

বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলা নবীজির সুন্নাহ

বিশ্বময় ছড়িয়ে আছে মহান আল্লাহর অসংখ্য নিদর্শন। সেসবের মধ্যে এক অনুপম নিদর্শন ভাষা। পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে আছে হাজার হাজার ভাষা। আবহমানকাল থেকে মানুষ ভাষার মাধ্যমে মনের ভাব আদান-প্রদান করে। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না পরস্পর ভাগাভাগি করে নেওয়ার অপরিহার্য অনুষঙ্গ ভাষা। যাপিত জীবনের পরতে পরতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ভাষা। মানব জীবনে ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বমানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ১৪০০ বছর আগে রসুলুল্লাহ (সা.) যে আল কোরআনপ্রাপ্ত হয়েছিলেন তাতে ভাষার বৈচিত্র্যকে আল্লাহর অনন্য নিদর্শন বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে।

ইরশাদ হয়েছে, ‘তাঁর (আল্লাহর) এক নিদর্শন হচ্ছে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে।’ সুরা রুম আয়াত ২২।

পৃথিবীতে হাজার হাজার ভাষা ছড়িয়ে থাকলেও মাতৃভাষাই আমাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। মাতৃভাষায় কথা বলে আমরা মানসিক প্রশান্তি অনুভব করি। রসুলুল্লাহ (সা.)সহ দুনিয়ায় যত নবী-রসুল এসেছেন সবাই বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলতেন। মায়ের ভাষায় ইসলামের দাওয়াত দিতেন। মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করতেন। মাতৃভাষাকে তাঁরা অনেক বেশি ভালোবাসতেন। কারণ মাতৃভাষা মহান আল্লাহর এক বড় নিয়ামত ও অপূর্ব দান। মহান আল্লাহ বলেন, ‘দয়াময় আল্লাহ শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন। সৃজন করেছেন মানুষ। শিক্ষা দিয়েছেন ভাষা তথা বর্ণনা।’ সুরা আর রহমান আয়াত ১-৪।

রসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন ‘আফসাহুল আরব’ বা আরবের শ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধভাষী। আরবি শুধু দীনি ভাষাই নয়; বরং সংশ্লিষ্ট ভৌগোলিক জনপদের বাসিন্দাদের মাতৃভাষাও। রসুলুল্লাহ (সা.) বিশুদ্ধ ভাষার ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময় সাহাবায়ে কিরামকে ভাষার শাব্দিক ব্যবহারে সচেতন করতেন।

একবার এক সাহাবি রসুল (সা.)-এর কাছে এলেন। তিনি বাইরে থেকে সালাম দিয়ে বলেন, ‘আ-আলিজু?’ (আমি কি প্রবেশ করব?) ঢোকা অর্থে এ শব্দের ব্যবহার আরবি ভাষায় আছে; কিন্তু অনুমতি প্রার্থনার ক্ষেত্রে তা প্রমিত শব্দ নয়। প্রমিত শব্দ হচ্ছে, ‘আ-আদখুলু?’ তখন নবী (সা.) বলেন, তুমি ‘আ-আদখুলু?’ বল। আবু দাউদ।

রসুলুল্লাহ (সা.) এভাবে তাঁর শব্দ প্রয়োগ ঠিক করে দিয়েছেন। অথচ তা জিকির-আসকার বা এ-জাতীয় কোনো বিষয় ছিল না। মুসলিমে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ই আছে ‘কিতাবুল আলফাজ’ শিরোনামে। সেখানে বিভিন্ন হাদিসে আমরা দেখতে পাই নবী (সা.) শব্দ প্রয়োগ সংশোধন করেছেন, এশার নামাজকে ‘আতামা’ বোলো না, ‘এশা’ বল। আঙুরকে ‘করম’ বোলো না, ‘ইনাব’ বল ইত্যাদি।

মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বায় ‘কিতাবুল আদাব’-এর একটি শিরোনাম হলো ‘মান কানা ইউয়াল্লিমুহুম ওইয়াদরিবুহুম আলাল লাহনি’ অর্থাৎ সন্তানকে ভাষা শিক্ষা দেওয়া এবং ভুল হলে শাসন করা প্রসঙ্গ। এ পরিচ্ছেদে সহি সনদে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে কথাবার্তায় লাহন বা ভাষাগত ভুল হলে তিনি সন্তানদের শাসন করতেন। বিশুদ্ধ ভাষাচর্চা শুধু সাহিত্যের ভিত্তি কিংবা অনুষঙ্গই নয়, বরং এটা শরিয়তের কাম্য বিষয়াবলির অন্যতম। রসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনাদর্শের বিমল শিক্ষা হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনে একজন মুমিনের ভাষা বিশুদ্ধ ও শালীন হতে হবে। এটা দীনি ভাষার প্রসঙ্গ নয়, মাতৃভাষার প্রসঙ্গ। অতএব মাতৃভাষা যা-ই হোক তার বিশুদ্ধতা শরিয়তের কাম্য। আর এটা কখনো চর্চা ছাড়া হাসিল হবে না। যুগে যুগে আল্লাহ তাঁর নবী-রসুলদের স্বজাতির ভাষায় পারদর্শিতা দিয়ে পাঠিয়েছেন, যাতে তাঁরা তাঁদের উম্মতদের সহজে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিতে পারেন। উম্মতরা তাঁদের কথা বুঝতে পারে। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি রসুলদের তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি, যাতে তাদের (দীন) স্পষ্টভাবে বুঝতে পারেন।’ সুরা ইবরাহিম আয়াত ৪।

লেখক : খতিব, আউচপাড়া জামে মসজিদ, টঙ্গী, গাজীপুর।

সর্বশেষ খবর