শুক্রবার, ১১ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

নির্বাচন কমিশন ও কাফন চুরির গল্প

মহিউদ্দিন খান মোহন

নির্বাচন কমিশন ও কাফন চুরির গল্প

জাতি হিসেবে এটা বোধহয় আমাদের দুর্ভাগ্য যে, অবিতর্কিত কোনো কিছু আমাদের কপালে জোটে না। বিশেষ করে যেসব বিষয়ের সঙ্গে রাজনীতি জড়িত, তা কখনই অবিতর্কিত থাকেনি। এক সময় যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল আমাদের পরম আরাধ্য, এখন তা পরিণত হয়েছে চরম অচ্ছুত বিষয়ে। যারা ওই সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে ঘর্মাক্ত হয়েছেন, এখন তারা ওই সরকারের নাম শুনলেই নাক সিটকান। যেন ওর চেয়ে জঘন্য জিনিস এই ধরাধামে দ্বিতীয়টি আর নেই। আবার এর অপর পিঠে রয়েছে একই চিত্র। এক সময় যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে অসাংবিধানিক, সভ্য-গণতান্ত্রিক দেশে নজিরবিহীন এবং পাগলের আবিষ্কার বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তারা এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য হা-পিত্যেশ করছেন। মনে পড়ে ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন করছিল, তখন ক্ষমতাসীন বিএনপির স্লোগান ছিল-‘তিন পাগলের আবিষ্কার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার’। কিন্তু সর্বদলীয় আন্দোলনের চাপের মুখে ১৫ ফেব্রুয়ারির (১৯৯৬) বিতর্কিত নির্বাচনে গঠিত স্বল্পকাল স্থায়ী জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস করার পরপরই বিএনপির স্লোগানের ভাষা পাল্টে গিয়েছিল। তখন তারা স্লোগান দিল-‘দেশনেত্রীর উপহার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার’। বোধকরি রাজনীতির মাহাত্ম্য এখানেই। এই ক্রিয়া-কর্মটি কখন যে কার মুখ দিয়ে কী বের করবে, তা আগে থেকে আন্দাজ করা বড়ই কঠিন। আজ যেটা ভালো, কাল সেটা মন্দেরও অধম। আবার আজ যেটা পরিত্যাজ্য, রাত পোহালেই সেটা হয়ে উঠতে পারে পরম কাক্সিক্ষত।

অনেক জল্পনা-কল্পনার পর গঠিত হয়েছে দেশের ত্রয়োদশ নির্বাচন কমিশন। ২৬ ফেব্রুয়ারি নতুন কমিশন নিয়োগের খবর প্রচারিত হওয়ার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সাবেক প্রতিরক্ষা সচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালকে প্রধান করে গঠিত এই কমিশন নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নতুন ইসি গঠনে সন্তোষ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, তারা মনে করে, নতুন ইসি দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করবে। দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে তার দল ইসিকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে’। অপরদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নতুন নির্বাচন কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, ‘ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতেই সরকার নিজেদের লোক দিয়ে সার্চ কমিটি গঠন করেছে। সরকারের তালিকা অনুযায়ী লোকদের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দিয়েছে। রাষ্ট্রপতিও সরকারের দেওয়া পাঁচজনের তালিকা প্রকাশ করেছেন’। অন্যদিকে নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টিতে দেখা দিয়েছে মতদ্বৈধতা। দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পাঠানো এক বার্তায় নয়া নির্বাচন কমিশনকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, আগামীতে তারা একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেশ ও জাতিকে উপহার দেবে বলে তিনি প্রত্যাশা করছেন। প্রায় একই সময়ে দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন ভিন্ন কথা। দলের প্রেসিডিয়াম সভার সিদ্ধান্ত জানিয়ে গত ১ মার্চ গণমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, নবগঠিত কমিশন আওয়ামী লীগ সমর্থিত আমলানির্ভর। আগামীতে এই কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। জাতীয় পার্টির শীর্ষস্থানীয় এই দুই নেতার বক্তব্যের ভিন্নতা রাজনীতিসচেতন মহলে ঔৎসুক্য সৃষ্টি করেছে। এটা দৃষ্টিভঙ্গিজনিত মতপার্থক্য, না সমন্বয়হীনতার বহিঃপ্রকাশ তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের এক সময়ের পার্টনার জাতীয় পার্টি নবগঠিত নির্বাচন কমিশন নিয়ে খুব বেশি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া যে ব্যক্ত করবে না, তা সংগত কারণেই অনুমেয়।

এদিকে নতুন ইসি গঠন নিয়ে বিএনপিতে সৃষ্টি হয়েছে তালগোল পাকানো অবস্থা। দলটি রাষ্ট্রপতি গঠিত সার্চ কমিটির বৈঠকে অংশ নেয়নি, কমিশনের সদস্য হিসেবে কারও নামও জমা দেয়নি। তবে বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সার্চ কমিটির বৈঠকে অংশ নিয়ে নামও প্রস্তাব করেছিলেন। তখন আওয়ামী লীগ নেতারা বলেছিলেন, বিএনপি বৈঠকে অংশ না নিলেও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মাধ্যমে নাম জমা দিয়েছে। বিএনপি তা সরাসরি অস্বীকার করে বলে যে, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি যেটা করেছেন ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত থেকে করেছেন। এরপর স্বয়ং জাফরুল্লাহ চৌধুরীও বলেছিলেন, তিনি কখনো বিএনপির সদস্য বা উপদেষ্টা ছিলেন না, এখনো নেই। ঘটনা তখন বেশি দূর এগোয়নি। তবে তার প্রস্তাবিত নাম থেকে কাজী হাবিবুল আউয়ালকে সিইসি নিয়োগের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী যখন সরকারকে অভিনন্দন জানালেন, তখন তার পছন্দের দল বিএনপিতে দেখা দিল ততধিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া। এক লহমায় তিনি বিএনপির বন্ধু থেকে শত্রুতে পরিণত হলেন। বিএনপি নেতা-কর্মীদের তীব্র বাক্যবাণের শিকার হতে হচ্ছে তাকে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘সরকার অনেক দিন পর সঠিক কাজ করেছে। আশা করি, তাকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হবে এবং তিনি দায়িত্ব পালন করে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনবেন। সব বিরোধী দলকে বলব, তাকে মেনে নিন’। সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে চেনেন উল্লেখ করে বলেন, তিনি সৎ লোক। তিনি খারাপ কিছু করবেন না।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এ মন্তব্যের পর বিএনপি তার ওপর চরম অসন্তুষ্ট হয়। যে কারণে তারা জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ৩ মার্চের একাধিক দৈনিক পত্রিকায় এ সংক্রান্ত খবরে বলা হয়েছে, সার্চ কমিটিতে নাম দেওয়া এবং ইসি গঠনের পর ইতিবাচক মন্তব্য করাসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ডা. জাফরুল্লাহর ওপর বিএনপি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। তাই দলটি তাকে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে সিদ্ধান্ত মোতাবেক দলের কোনো অনুষ্ঠানে তাকে আমন্ত্রণ না জানানো এবং তিনি কোনো অনুষ্ঠানে থাকলে সেখানে নেতা-কর্মীদের না যেতে মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী একটি দৈনিককে বলেছেন, ‘আমি থাকলে বিএনপি নেতারা আসবে না বা আমাকে বর্জন করবে-সেটি তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। জনবিচ্ছিন্নতার কারণে বিএনপি তাদের ভুল বুঝতে পারছে না। অনুধাবন করতে পারছে না, কে তাদের বন্ধু, আর কে তাদের শত্রু’। জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে বয়কটের সিদ্ধান্ত যে ‘অবিলম্বেই’ কার্যকর হয়েছে, তা বোঝা গেল ২ মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবে জেএসডি আয়োজিত জাতীয় পতাকা দিবসের অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গরহাজির থাকার ঘটনায়। ওই অনুষ্ঠানে তাকে প্রধান অতিথি করা হয়েছিল। অবশ্য তার অনুপস্থিতির কারণ হিসেবে রাজনীতিকদের চিরাচরিত কৈফিয়ৎ ‘অসুস্থতা জনিত কারণকেই উল্লেখ করা হয়েছে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নিয়ে বিএনপি বেশ কিছুদিন ধরেই অস্বস্তিতে ভুগছিল। দলটির কাজকর্ম এবং শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়ে তার সমালোচনামূলক কথাবার্তা দলটি হজম করতে পারছিল না। অবস্থাটা দাঁড়িয়েছিল-‘না পারে গিলতে, না পারে ফেলতে’র মতো। এবার বয়কটের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ায় বিএনপি সে অস্বস্তি থেকে মুক্তি পেল বলা যায়। তবে, রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিরা মনে করছেন, সিদ্ধান্তটি নেওয়ার আগে বিএনপির আরেকটু ভাবা উচিত ছিল। এভাবে যদি তারা ছাঁটাই কর্মসূচি অব্যাহত রাখে, তাহলে দলীয় পরিধির বাইরে তাদের শুভাকাক্সক্ষী-শুভ্যার্থীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে। সে বিষয়ে এখানে বিস্তারিত বলতে চাই না। গত ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত ‘বিএনপির শত্রু বৃদ্ধি কর্মসূচি’ শীর্ষক নিবন্ধে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছি।

এদিকে নতুন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, দেশের মানুষের ভোটাধিকার রক্ষায় তার কমিশন যথাসাধ্য চেষ্টা করবে। তবে তিনি এটাও বলেছেন যে, সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করা কেবলমাত্র নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এ জন্য সব পক্ষকে ভূমিকা রাখতে হবে। সিইসির এ বক্তব্যকে নির্দোষ বলেই ধরে নেওয়া যায়। তবে, নির্বাচনের ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে নির্বাচন কমিশন। ফলে একটি নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া না হওয়ার দায়টাও বর্তায় তাদের ওপরই। তাছাড়া বর্তমান কমিশন তথা সিইসি রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা তখনই পাওয়ার আশা করতে পারেন, যখন তারা তাদের কর্মকাণ্ড দ্বারা সবার আস্থা অর্জনে সক্ষম হবেন। তা না করে তারাও যদি তাদের সদ্য বিদায়ী পূর্বসূরির পদাঙ্ক অনুসরণ করেন, তাহলে সবকিছু গুবলেট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনকে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, তারা অতিনিন্দিত একটি নির্বাচন কমিশনের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। তাদের তাই ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে।

একট গল্প বলেই আজকের লেখার ইতি টানতে চাই-এক এলাকায় এক কাফন চোর ছিল। এলাকার কেউ মারা গেলে দাফন করার পরদিন রাতেই সে কবর খুঁড়ে কাফনের কাপড় নিয়ে যেত। অতিষ্ঠ এলাকাবাসী ওই চোরের মৃত্যু কামনা করতে থাকে প্রতি মুহূর্তে। লোকটি বৃদ্ধ হওয়ার পর তার ছেলে দুটোকে ডেকে বলল-‘দ্যাখ, আমি তো সারা জীবন কাফন চুরি কইরা মাইনষের গালি খাইলাম। কেউ আমারে ভালো কয় না। আমি মারা যাওয়ার পর তরা এমুন কাম করিস না, যাতে মাইনষে আমারে মরার পরও বকা দেয়, খারাপ কয়’। লোকটি মারা যাওয়ার পর ছেলে দুটি ব্যবসাপাতি করে ভদ্রভাবে জীবন চালাতে থাকল। কিছুদিন পর লোকজন বলতে থাকল, দেখো একেই বলে ‘জালেমের ঘরের আলেম’। বাপ আছিল একটা কাফন চোর, বদমাইশ। আর পোলা দুইটা কী ভদ্র, ভালো! এসব শুনে ছোটভাই বড় ভাইকে বলল, ‘দাদা আমরা এইডা কী করতাছি? মাইনষে তো বাবারে বকা-ই দিতাছে’। বড় ভাই বলল-‘রাখ, এমুন কাম করুম, মাইনষে বাবারে ভালো তা কইব-ই, বাপও ডাকব’। এরপর থেকে দুই ভাইয়ে কাফন চুরি শুরু করল। সেই সঙ্গে অতিরিক্ত একটি কাজ করল তারা। যে বাড়ির লাশ সে বাড়ির সামনে এনে ফেলে যেতে লাগল। পর পর কয়েকদিন এই ঘটনা ঘটার পর লোকজন জেনে গেল এই কাজ মৃত কাফন চোরের ছেলেদের। তখন তারা বলাবলি করতে লাগল-‘আরে অগো তুলনায় অগো বাপ তো ফেরেশতা আছিল’। লোকজনের কথা শুনে বড় ভাই ছোট ভাইকে বলল, ‘দেখছস, মাইনষে বাবারে ভালো কইতাছে!’ আমরা আশা করি নতুন কমিশন এমন কাজ করবে না, যাতে নূরুল হুদা কমিশনের প্রশংসায় আমরা পঞ্চমুখ হই।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক।

সর্বশেষ খবর