বুধবার, ২৩ মার্চ, ২০২২ ০০:০০ টা

ধান ভানতে শিবের গীত

মাহমুদুল আলম খান বেনু

ধান ভানতে শিবের গীত

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১১ মার্চ শুক্রবার গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে বীরউত্তম মেজর হায়দার মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে ২৮ মার্চ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে অর্ধদিবস হরতালের ডাক দিয়েছেন এবং বলেছেন জনগণের উচিত হরতাল পালন করা। (১২ মার্চ বাংলাদেশ প্রতিদিনের খবর অনুযায়ী)। এ কথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই যে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়েনি। সয়াবিন তেল থেকে শুরু করে পিঁয়াজ, সবজি, মাছ মাংস- সবকিছুর দাম বেড়েছে। তিনি দেশ ও দশের কথা ভাবেন, বিজ্ঞ মানুষ জনস্বার্থে অথবা প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে হরতাল আহ্বান করতেই পারেন। এ ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিমত নেই। হরতাল ডাকা বা পালন করা যেমন মানুষের মৌলিক অধিকার তেমনি পালন না করাও মৌলিক অধিকার। হরতালের আহ্বান জানাতে পারেন, পালনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, প্রচার করতে পারেন কিন্তু এ কথা বলার অধিকার রাখেন না- হরতাল পালন করা জনগণের উচিত। জনগণ তাঁকে এ ক্ষমতা দেয়নি। জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। হরতাল পালন করা-না করা জনগণের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত অধিকার। তিনি শুধু আধাবেলা হরতাল ডেকেই ক্ষান্ত হননি উসকানিমূলক কথাও বলেছেন, যে কথা স্বাধীনতাবিরোধীরা বলে। তিনি বলেছেন, ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষে নাকি বাংলাদেশে ৩ লাখ লোক মারা গিয়েছিল।

হ্যাঁ, ’৭৪ সালে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছিল, কিউবায় পাট রপ্তানি ঠেকাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খাদ্যের জাহাজ মাঝপথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, তারপর ’৭৩ ও ’৭৪ সালের বন্যায় ফসলের ক্ষতি হওয়ায় খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। ফলে সরকারি হিসাবে ২৭ হাজার লোক মারা যায়। তবে আমাদের উপজেলায় একজন লোকও মারা যায়নি এবং লঙ্গরখানাও খুলতে হয়নি। আর তাঁর কথা ঠিক হলে প্রতি উপজেলায় গড়ে ৭০০ লোক মারা যাওয়ার কথা। এখন নিজেই হিসাব করুন ইচ্ছা করলেই বের করা যাবে কারণ ’৭৪ সালের অনেক লোক জীবিত আছেন। আমার আরও একটি প্রশ্ন এ ৩ লাখ সংখ্যাটি বলা নিয়ে। কারণ স্বাধীনতাবিরোধীরা বলে ১৯৭১ সালে নাকি ৩ লাখ লোক মারা গিয়েছিল। অর্থাৎ ৩০ লাখ শহীদকে তারা অস্বীকার করে। তিনিও কি সে পথের পথিক? যতই বাগাড়ম্বর করুন তাঁর মূল উদ্দেশ্য স্বাধীনতার পক্ষশক্তির উচ্ছেদ। তাই তিনি ধান ভানতে শিবের গীত গাইছেন। আমি তাঁকে পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই- যত দিন পর্যন্ত শেষ বাঙালি বা রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধার বংশধররা বেঁচে থাকবে তত দিন তিনি তা পারবেন না। সভা-সমিতিতে তিনি বিভিন্ন দল, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সরকারকে নানা ধরনের নসিহত করে যাচ্ছেন। তিনি সর্বরোগের দাওয়াই বিলিয়ে বেড়াচ্ছেন। এতে তিনি যে ঘরানার লোক অন্তত চিন্তা-চেতনায় সেই দল থেকেই অর্থাৎ বিএনপি তাঁকে আর দাওয়াই না দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে। তিনি প্রায়ই রাজাকার, আলবদর, যুদ্ধাপরাধীদের ’৭১ সালের কৃতকর্মের জন্য মাফ চাইতে বলেন। আমার প্রশ্ন- জাতি কি তাঁকে এ ক্ষমতা দিয়েছে? ৩০ লাখ শহীদের সন্তানরা ও ২ লাখ নির্যাতিত মা-বোনের সন্তানরা তাঁকে কি এ অধিকার দিয়েছে? এখনো তো নাৎসি যুদ্ধাপরাধী পাওয়া গেলে নুরেমবার্গ আদালতের রায় অনুসারে শাস্তি হয়। তাহলে মাত্র ৫০ বছর পরে আপনার কেন উৎকণ্ঠা যুদ্ধাপরাধীদের নিয়ে। আমরা যাঁরা ট্রেনিং নিয়ে দেশের ভিতর যুদ্ধ করেছি তাঁরা কোনো দিন ভুলতে পারব না ’৭১-এর সেই ভয়াবহ দিনগুলোর কথা। ’৭১-এর ১১ অক্টোবর সোমবার তরগাঁও গ্রামে সম্মুখযুদ্ধে আমার সহযোদ্ধা সাজ্জাদ ও গিয়াসের শাহাদাতবরণের কথা। মুক্তিযোদ্ধা আউয়াল নদীর পাড়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন, রাজাকাররা তাঁকে দেখিয়ে দিলে পাক হানাদার বাহিনী বেয়নেট চার্জে নির্মমভাবে হত্যা করে নদীতে তাঁর লাশ ভাসিয়ে দেয়। দয়া করে আর কোনো দিন এ ধরনের বক্তব্য বা আহ্বান জানাবেন না, তাহলে আপনার ’৭১ সালের অর্জন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। আজ বীর সেজেছেন, বিপ্লবী সেজেছেন। এখন বিপ্লবী সাজার বয়স আপনার নেই, কারণ যোদ্ধারা সম্মুখ থেকে নেতৃত্ব দেয় যেমন ’৭১ সালে আমরা দিয়েছিলাম। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম। তাহলে এখন আমার প্রশ্ন- আপনি যদি এতই জনদরদি, ন্যায়পরায়ণ ও অন্যায়ের প্রতিবাদকারী হন তাহলে ’৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সবাইকে, শিশু রাসেলকে, মণি ভাইকে, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে, আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে সপরিবারে, এমনকি হাসানাত ভাইয়ের তিন বছরের শিশু সন্তান সুকান্তকে, মোহাম্মদপুর শেরশাহ রোডের বাড়িতে মর্টারের শেলের আঘাতে ১৩ নিরীহ মানুষকে এবং জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যাকারী রশীদ-ফারুক গংয়ের বিচার করা দূরের কথা পুরস্কৃত করেছেন। আপনি কি তার সামান্য প্রতিবাদ করেছেন? জিয়াউর রহমান ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য সব যুদ্ধাপরাধীকে জেল থেকে ছেড়ে দিয়েছেন, ক্ষমতায় থাকার জন্য ঘৃণ্যতম দালাল শাহ আজিজ, মাওলানা মান্নানসহ আরও যুদ্ধাপরাধীদের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি বানিয়েছেন, হ্যাঁ-না ভোটে ১০১% ভোট পেয়েছেন, গোলাম আযমকে এ দেশে আসতে দিয়েছেন তখন কি সামান্য প্রতিবাদ করেছেন? বিদ্রোহ করেছেন? জেলখানায় হাজার হাজার সেনা সদস্য, বিমান বাহিনীর লোককে রাতের অন্ধকারে ফাঁসি দিয়েছেন তখন কী করেছেন? যে বীরউত্তম হায়দারের নামে মিলনায়তন করেছেন, সেই শহীদ মেজর হায়দারের খুনিদের বিচারের জন্য কি কিছু করেছেন? তখন তো আপনার ভরা যৌবন এবং বিপ্লব করার বয়স ছিল। সময়ে কিছুই করেননি। পদ্মা-মেঘনায় অনেক জল গড়িয়েছে, এখন বাঙালি আপনাকে চিনতে পেরেছে। আপনি ব্যক্তিগতভাবে একজন আওয়ামী লীগবিরোধী লোক, বঙ্গবন্ধুবিরোধী লোক। বঙ্গবন্ধুর কোনো কৃতিত্ব স্বীকার করতে চান না এমনকি বঙ্গবন্ধু বলতে কুণ্ঠাবোধ করেন। আমি বলব, বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করা বাংলাদেশকে অস্বীকার করা। যত দিন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা থাকবে, শেষ বাঙালি বেঁচে থাকবে তত দিন বেঁচে থাকবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অতএব সাধু সাবধান! আবোল-তাবোল বকবেন না। জাতিকে এত উপদেশ দেওয়ার দরকার নেই। আগে আপনার কৃতকর্মের কথা ভাবুন। হঠাৎ করে বিপ্লবী সাজার চেষ্টা করবেন না। কথায় কথায় আপনি মওলানা ভাসানীর কথা বলেন, তাঁকে বঙ্গবন্ধুর ওপর স্থান দেওয়ার চেষ্টা করেন। আমি মওলানা ভাসানীকে সম্মান করি। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও তাঁকে সম্মান করেন। হুজুর মওলানা বলে সম্বোধন করেন। আওয়ামী লীগও সম্মান করে। কিন্তু ধান ভানতে শিবের গীত কনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

লেখক : রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর