রবিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

করিম বখশ খাসলত ও নির্বাচন

খায়রুল কবীর খোকন

করিম বখশ খাসলত ও নির্বাচন

মসিহ্উদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী এ দুই পরিচালক মিলে সামান্য সরকারি অনুদানের অর্থে অনেক কষ্টে-বেদনায় বানিয়েছিলেন ছায়াছবি ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’। ১৯৭৯ সালে ছবিটি মুক্তি পায়। আবু ইসহাকের অসাধারণ উপন্যাসের চিত্ররূপ দেওয়ার সেই বিশাল কাজটি ওই সামান্য রাষ্ট্রীয় অর্থে ছিল একবারেই সমুদ্রে পাড়ি দিতে ডিঙি-নৌকায় অভিযান যেন। আমাদের চলচ্চিত্রজগতের ‘শেঠ-ইতরদের’ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, অবজ্ঞা সহ্য করে, প্রতিকূল পরিবেশে, প্রচন্ড পরিশ্রমে তাঁরা বানালেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাংলার দুর্ভিক্ষপীড়িত সমাজের নিঃস্ব মানবগোষ্ঠীর বাঁচা-মরার লড়াইয়ের এক অসামান্য দলিল। দেশে-বিদেশে চলচ্চিত্র পন্ডিত ও বোদ্ধামহলে ব্যাপক প্রশংসা পায় সেই ছায়াছবি।

ছবিটির প্রধান চরিত্র প্রথমে বিধবা এবং পরে দ্বিতীয় স্বামী- পরিত্যক্ত তিন সন্তানের মা কিন্তু প্রচন্ড লড়াকু এক দরিদ্র শ্রমজীবী যুবা-নারী জয়গুন। জয়গুনের দ্বিতীয় স্বামী করিম বখশ ছিল পিতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধি, প্রচন্ড স্বার্থান্ধ, নারী পীড়নকারী, চরিত্রের দিক থেকে ‘নায়ক’ (আসলে খলনায়কের আরেক রূপ), নিদারুণ অভাবের সময় সেই করিম বখশ তার স্ত্রী জয়গুনকে দুই সন্তানসহ পদাঘাত করে বিদায় করে দেয়, তালাক তো ছিল মুখের কথারই। তবে নিজের শিশু পুত্রসন্তানটি কেড়ে রেখে দেয়। জয়গুন এক কিশোর ছেলে ও এক কিশোরী কন্যাকে নিয়ে অবিরাম লড়াই করে যায়। বেঁচে থাকার সেই যুদ্ধ, তবে সে কোথাও হাত পেতে ভিক্ষা করে না, কোনো নোংরা পথে গিয়ে সহজে অর্থ উপার্জনের কথা কল্পনায়ও আনে না, এমনকি অর্থবিত্তবান গ্রাম্য মোড়লদের পরিবারে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বউ হয়ে খেয়ে-পরে সুখে-শান্তিতে জীবন কাটানোর গ্যারান্টিতেও সে ভুলতে চায় না। তাই এসব ভন্ড পুরুষের খপ্পরেও আর পা দিতে যায় না। তাদের শত প্রলোভন আর ভয়ভীতি সৃষ্টির ঘটনার মুখেও সে অটল থাকতে শিখে নিয়েছে, সে নিজে নানাভাবে শ্রমদানের রোজগারে বাঁচতে চায় সদা। জয়গুনের তৃতীয় সন্তানটি করিম বখশের দখলে ছিল, সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে জীবনাশঙ্কার পর্যায়ে করিম বাধ্য হয়ে পুত্রসন্তানটিকে বাঁচাতে তার মাকে মানে জয়গুনকে বাড়িতে নিয়ে গেল সেবা-শুশ্রুষার কাজে। ছেলেটি ডাক্তারের চিকিৎসার পাশাপাশি মায়ের সেবা-শুশ্রুষায় ভালো হয়ে উঠল। তখন এক গভীর রাতে তামাক-সেবনের (মালসার ভিতরে জ্বলন্ত কাঠ-কয়লার) আগুন নেওয়ার ছল করে করিম বখশ আসে জয়গুনের সেই ঘরে (যেখানে সে ছেলেটিকে নিয়ে আলাদাভাবে থাকত) : ইনিয়ে-বিনিয়ে নানা কথার ছলে ভুলিয়ে করিম বখশ পরিত্যক্ত-স্ত্রী জয়গুনকে তার ঘরে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলে। করিম জয়গুনকে নিশ্চয়তা দেয়- সে তার পরে বিয়ে করা স্ত্রীকে তালাক দিয়ে দেবে। সে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রতি ইঙ্গিত করে বলে- ‘তুই অর কথা ভাবিস না, জয়গুন, অরে আমি ছাইড়া দিমু।’ এবার জয়গুন তার চোয়াল শক্ত করে প্রচ- দৃঢ়তায় জবাবটা ছুড়ে দেয়- ‘অরে ছাড়তে অইব না, আপনার খাসলত ছাড়েন।’ জয়গুনের এই দৃঢ়চিত্ত উত্তরে করিম বকশ আর কথা বলতে পারে না, স্থান-ত্যাগে বাধ্য হয়। (দুই পরিচালকের মুনশিয়ানায় আর করিম বখশ চরিত্রে কেরামত মাওলা এবং জয়গুন চরিত্রে ডলি আনোয়ারের অসামান্য অভিনয়ে এ চিত্রনাট্য -অংশ এমনভাবে ফুটে ওঠে যা বোদ্ধা-দর্শককে আপ্লুত করে ছাড়ে)।

কেন এই গল্পাংশের অবতারণা? আসন্ন সংসদীয় নির্বাচন প্রসঙ্গেই করিম বখশের কেচ্ছাটা বলা। আমাদের ডক্টরেটধারী বিদগ্ধ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন এই তো সেদিন ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলাপ-আলোচনার সময় নিবেদন করলেন, বিএনপি নির্বাচনে আসতে চায় না, তাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নির্বাচনে আনতে বন্ধুরাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তাদান করলে ভালো হয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ড. মোমেনকে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন দেখার প্রত্যাশায় রয়েছে। বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ আবেদনে যদি তারা বা বাংলাদেশের মানুষ একটা চমৎকার জবাব দেয়- ‘সরকার নির্বাচনী তামাশার মাধ্যমে বিরোধী দলকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার এ “খাসলত” ছাড়ুক, নিরপেক্ষ ও মুক্ত ভোটের নির্বাচনে জনগণ যাতে অংশ নিতে পারে সেই বন্দোবস্ত পাকাপাকি করুক (নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে), তাহলে তাদের আর এত কষ্ট করে আবেদন-নিবেদন কাউকে করতে হবে না, বিএনপি নিজের গরজেই নির্বাচনে আসবে।’ ক্ষমতাসীন দল এখন শাকের-নিয়ামত চলচ্চিত্র সূর্য দীঘল বাড়ীর করিম বখশ। তারা এখন দেশে-বিদেশে ধরনা দিচ্ছে- যাতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে তারা আরেকটি ‘তামাশার নির্বাচনে’ অংশ নিতে বাধ্য করে তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেওয়ার সুব্যবস্থা করে সবাই। কিন্তু সেটা তো হওয়ার নয়। আওয়ামী লীগ ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায় বসে ‘ফ্রিস্টাইল নির্বাচন’ ব্যবস্থা কায়েম করে কার্যত একদলীয় ব্যবস্থা জারি রেখেছে। বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে লাখ লাখ মামলায় জড়িয়ে সারা দেশকে এক কারাগারে পরিণত করেছে। অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী প্রকল্প আর সেসব বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের জনগণের অর্থের বারোটা বাজিয়ে চলেছে। দেশের মানুষকে অতিষ্ঠ করা আওয়ামী লীগের এই ‘করিম বখশ খাসলত’ কবে যাবে? আওয়ামী লীগ নেতারা একটানা বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদগার করে যাচ্ছেন। আবার বিএনপি নির্বাচনে আসুক সেই ধরনা দিতে ওয়াশিংটন অবধি লবিং করছেন রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিএনপি তো ওবায়দুল কাদের, ড. হাছান মাহমুদ এবং আরও অনেক আওয়ামী লীগ নেতার কাছে কোনো রাজনৈতিক দলই নয়, তাহলে বিএনপি নির্বাচনে এলো কি এলো না, তাতে আওয়ামী লীগের কী আসে যায়? নিরপেক্ষ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন যে এ দেশে আর হবে না তা নতুন করে প্রমাণের বাকি নেই। নির্বাচন কমিশন যদি ফেরেশতা আচরণও করতে চায় কোনো লাভ হবে না, দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলে তার মাঝারি ও পাতি-আমলা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দিয়ে মনপছন্দ ভোট করিয়েই ছাড়বে- ওপরে-নিচে কেউ নেই তাদের ঠেকায়।

                লেখক : বিএনপির যুগ্মমহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসু সাধারণ সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর